এবার নালায় পড়ে শিশু নিখোঁজ

21

নিজস্ব প্রতিবেদক

নগরীর ষোলশহরের চশমাখালে পড়ে মো. কামাল উদ্দিন নামে ১০ বছরের একটি শিশু নিখোঁজ হয়েছে। নিখোঁজ কামাল ষোলশহর স্টেশন এলাকার মো. কাউসারের ছেলে। গত সোমবার বিকালে শিশুটি নিখোঁজ হলেও খবর পেয়ে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই উদ্ধার অভিযানে নামে ফায়ার সার্ভিস। তবে রাত সাড়ে ৯টায় এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত শিশুটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে গত ছয় মাসে চারটি দুর্ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু এবং দুইজন নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে শিশুটি নিখোঁজের ব্যাপারে আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশনের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের উদ্ধার অভিযান এখনো চলছে। তিনজন ডুবুরির সমন্বয়ে আটজনের একটি টিম শিশুটি উদ্ধারে কাজ করছে। আমরা খালের মুখ পর্যন্ত পৌঁছে গেছি। ময়লা আবর্জনা বেশি থাকায় উদ্ধার কাজে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। আর কতক্ষণ উদ্ধার অভিযান চালাতে হয় জানিনা। তবে আমাদের একটি টার্গেট আছে। সেই টার্গেট নিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
স্থানীয়রা জানান, ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রাকিব ও কামাল নামে দুই শিশু চশমাখালে পড়ে যায়। রাকিব তাৎক্ষণিক উঠে আসলেও কামাল মুহূর্তেই হারিয়ে যায়। শিশুটির বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় ছেলেটি উদ্ধারে দ্রæত কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয়দের কাছে ঘটনাটি জানাজানি হলে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে উদ্ধার অভিযানে নামে।
এর আগে গত ৩০ জুন নগরীর দুই নম্বর গেটের চশমা পাহাড় লেনে একটি চলন্ত সিএনজি অটোরিকশা সিঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে নালায় পড়ে গেলে ঘটনাস্থলেই সিএনজি অটোরিকশা চালক ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ডে চট্টগ্রাম নগরীতে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এসব উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করছে সেবা সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা)। বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ তড়িঘড়ি শেষ করলেও পরবর্তীতে রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা দুর্ঘটনা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা। এসব অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনায় কেউ প্রাণ হারাচ্ছে, আবার কেউ বরণ করছে পঙ্গুত্ব।
নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় অন্ততঃ দেড় শতাধিক ড্রেন রয়েছে। যার ৯৫ শতাংশ অরক্ষিত। এছাড়া রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য খাল। এসব খালের পাশেও নেই কোনো সীমানা দেয়াল। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় অসাবধানতাবশতঃ ড্রেন কিংবা খালে পড়ে মারা যাচ্ছে কেউ না কেউ। এসব অরক্ষিত ড্রেন কিংবা খাল নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথাও নেই সিডিএ বা চসিক এর। বারবার দুর্ঘটনা ঘটলেও দুই সেবা সংস্থার টনক নড়ছে না। ফলে নগরবাসীর কাছে এখন নতুন আতঙ্কের নাম ড্রেন কিংবা খাল।
জানা যায়, গতবছর ঘটে দু’টি দুর্ঘটনা। চলতি বছরের শুরু থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অরক্ষিত ড্রেন ও খালে পড়ে মারা গেছে ৫ জন। আহত হয়ে পঙ্গু হয়েছে একজন। বাকিরা চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরলেও আজও সে দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে।
চলতি বছর ড্রেনে প্রথম দুর্ঘটনাটি ঘটে গত ১৯ জুন। এদিন নগরীর চান্দগাঁওয়ে বৃষ্টির পানিতে সড়ক ডুবে গেলে সিএনজি অটোরিকশা চালক রাস্তার নিশানা বুঝতে না পেরে তিন যাত্রীসহ নালায় পড়ে যায়। এ ঘটনায় শফিক নামে এক যাত্রীর পা ভেঙে যায়। বাকিরা আহত হয়।
এ দুর্ঘটনার মাত্র ১১ দিনের মাথায় ৩০ জুন সকালে নগরীর ষোলশহর চশমা হিলে সড়কঘেঁষা অরক্ষিত খালে পড়ে সিএনজি অটোরিকশা তলিয়ে যায়। এ ঘটনায় চালকসহ এক বৃদ্ধা মারা যান। আহত হয় আরও দু’জন।
গত ২৫ আগস্ট নগরীর মুরাদপুরে আয়োজন রেস্তোরাঁর সামনের নালায় অসতর্কতাবশতঃ পড়ে গিয়ে সালেহ আহমদ নামে এক ব্যক্তি নিখোঁজ হন। একমাস খোঁজাখুজির পরও তার হদিস পাওয়া যায়নি।
এরপর গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে আগ্রাবাদের বাদামতলী এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া মেহবুব। নালার আবর্জনার স্তুপে আটকে থাকা অবস্থায় তার মরদেহ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয়।
সর্বশেষ গত সোমবার নগরীর শুলকবহর ওয়ার্ডের ষোলশহর চশমা খালের উন্মুক্ত নালায় খেলনা সাদৃশ্য বস্তু ভাসতে দেখে দুই বন্ধু কামাল ও রাকিব নালায় নেমে পড়ে। পরে রাকিব উঠে আসতে পারলেও, পানির স্রোতে কামাল ভেসে যায়। গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত কামালের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, নালা কিংবা খালে বারবার দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও চসিক এবং সিডিএ এসবের দায় এড়িয়ে গেছে প্রতিবার। আইনগতভাবে কোনো ব্যক্তি কিংবা সংস্থা যদি কারও মৃত্যুর জন্য দায়ী হয়, সেক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিধান রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বারবার দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলেও এসব সংস্থার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। কার্যতঃ কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়নি সংস্থাগুলো।
নিখোঁজ কামালের বাবা আলী কায়সার ছেলের একটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘গত পরশু ছেলেকে নতুন ক্লাসে ভর্তি করাতে ছবি তুলেছি। আজ (মঙ্গলবার) আমার ছেলের হদিস নাই। আমার ছেলেকে জীবিত কিংবা মৃত আমার কোলে ফিরিয়ে দেন।’
এ ঘটনায় বেঁচে ফিরে আসা কামালের বন্ধু রাকিব জানায়, সোমবার বিকালে নালায় একটা খেলনা ভাসতে দেখি। পরে আমি আর কামাল ওটা তুলতে পানিতে নামি। এসময় স্রোতে দু’জনই ভেসে যাই। আমি দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে ময়লার সাথে আটকে কোনোরকম উঠে আসি। ওঠার পর কামালকে আর দেখতে পাইনি।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলে আছি। আমাদের টিম ওই শিশুকে খোঁজাখুঁজি করছে। কিন্তু তাকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটি ডুবুরি দলও কাজ করছে। শিশুটিকে না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

দুর্ঘটনার দায় নিয়ে রশি টানাটানি:
এমন অবহেলাজনিত কারণে কারো মৃত্যু হলে সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। সমস্যার সমাধান হয় না। বরং দুই সংস্থার দায় চাপাচাপির উত্তাপের মধ্যেই ড্রেন ও খালে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বর্তমানে নগরীর অরক্ষিত নালা-খালগুলো যেন এক একটা মরণফাঁদ।
মান্ধাতার আমলে নির্মিত এসব ড্রেনের সংস্কার শেষ হলেও সবক’টি ড্রেনের ওপরে স্ল্যাব কিংবা নিরাপত্তা বেষ্টনি দিতে পারেনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। বিষয়টি বারবার গণমাধ্যমে তুলে ধরার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও এ ব্যাপারে কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছেই।
জানা যায়, নগরীর যেসব নালা কিংবা খাল তিন ফুটের (গভীরতা ও প্রস্থে) বেশি- সেগুলো চসিক দেখভাল করে না। এসব খাল-নালা দেখভালের দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। তবে সিডিএ বলছে, নালা দেখাশোনা, বেস্টনি দেওয়া সিডিএ’র কাজ নয়। এসব দেখভাল করবে চসিক। এখন জনমনে প্রশ্ন- আসলে নগরীর ড্রেন কিংবা খালের মালিক কে!
নালায় পড়ে শিশু কামাল নিখোঁজের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম. রেজাউল করিম চৌধুরী। এসময় তিনি কামালের বন্ধু রাকিবকে বলেন, ‘সাঁতার না জানলে পানিতে নামছো কেন?’
নগরীতে কখনো ভাঙা রাস্তায় দুর্ঘটনা, কখনো নালা, কখনো খালে পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো পারস্পরিক দোষারোপেই ব্যস্ত। দুর্ঘটনার পর হৈ-চৈ হলে দায়সারা গোছের কাজ যেমন- রাতের আঁধারে ঘটনাস্থলে দেয়াল নির্মাণ, অস্থায়ী বেড়া তৈরি করে দেয়া হয়। সমন্বয়হীন কাজে মৃত্যু-দুর্ভোগ এখানে প্রাত্যহিক ঘটনা যেন। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম এখন যেন এক মৃত্যু ঝুঁকির শহর বলে মনে করে চট্টগ্রামবাসী।