এবার দুর্নীতিবাজদের স্বজনরাও আতংকে

69

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতি দমন কমিশনও কঠোর অবস্থানে। দুর্নীতি দমনের মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে দুদক। এবার শুধু দুর্নীতিবাজ নয়, তাদের সহায়-সম্পদ হেফাজতকারী স্ত্রী-সন্তান এবং স্বজনরাও বিপাকে পড়েছেন। তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গত ৬ মাসে দুর্নীতিবাজের ৩০ জন স্বজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন হাজারীর বিরুদ্ধে তিন কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। পাশাপাশি তাঁর স্ত্রীকেও অভিযুক্ত করে মামলা করা হয়েছে। তার কাছেও মিলেছে অবৈধ সম্পদ। তারা দুইজনই বর্তমানে জেলে রয়েছেন। এর আগে অপর এক কাস্টমস কর্মকর্তাকে স্ত্রীসহ জেলে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের ২৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের স্বজনদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলছে। প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হলে মামলা করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারী আবজাল হোসেন। তাঁর দুর্নীতি তদন্ত করতে গিয়ে দুদক কর্মকর্তারা হতবাক। প্রাথমিকভাবে তার কাছে সম্পদ মিলেছে তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। অনুসন্ধানে তা আরো বেশি হতে পারে বলে দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। দুদকের তথ্য অনুযায়ী মাসিক ৩০ হাজার টাকা বেতন পেলেও ঢাকার উত্তরায় তার ও স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে পাঁচটি। একটি বাড়ি আছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। আমেরিকা- কানাডায়ও তার বাড়ি রয়েছে। আর রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আছে অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ বহু সম্পদ। বর্তমানে এসব সম্পদের বাজার মূল্য চার হাজার কোটি টাকারও বেশি বলে জানায় দুদক।
দুদকের অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, আবজাল হোসেন গত এক বছরে সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ২৮ বারেরও বেশি সপরিবারে সফর করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির পর্টার স্ট্রিট মিন্টুতে যে বাড়িটি কিনেছেন, তার দাম দুই লাখ ডলারেরও বেশি।
ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষক আবজাল হোসেনের সব সম্পদ জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
আবজাল হোসেনের স্ত্রীরও রয়েছে হাজার কোটি টাকার সম্পদ। এ ছাড়া তার ১৫ জন আত্মীয়-স্বজনের নামেও বিপুল সম্পদ রয়েছে। তারা হলেন, তার দুই ভাই, তাদের স্ত্রী, দুই শ্যালক, তাদের স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়িসহ আরো কয়েকজন।
তার আত্মীয় ফরিদপুর টিবি হাসপাতালের ল্যাব এটেনডেন্ট বেলায়েত হোসেন, জাতীয় অ্যাজমা সেন্টারের হিসাবরক্ষক লিয়াকত হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক রকিবুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী বুলবুল ইসলাম ও খুলনা মেডিকেল কলেজের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলামের নামেও বিপুল সম্পদ রয়েছে বলে দুদক জানিয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব সম্পত্তি তারই। স্বজনদের নামে রেখেছেন।
দুদক জানাচ্ছে, আবজাল হোসেনের স্ত্রী রুবিনা খানমও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখায় স্টেনোগ্রাফার হিসেবে চাকরি করতেন। তবে বিপুল বিত্তবৈভব হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করছেন। প্রচার আছে পোশাকশিল্প গড়েছেন।
শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স (এনআইএনএস) হাসপাতালের কর্মচারী এমদাদুল হক সাদেক। ৮ বছরের চাকরি জীবনে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার স্ত্রীর নামেও রয়েছে অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ। তিন স্বজনের নামেও রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
বরিশাল জেলা পুলিশের পরিদর্শক ফিরোজ কবির ও তার স্ত্রী সাবরিনা আহমেদ ইভার বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনের সভায় ঘুষের ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা পাচারের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দেওয়া হয়।
ফেনী পৌরসভার সুইপার মো. হানিফ। বারাহিপুর এলাকায় রয়েছে কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি। পৌর এলাকায় তার নামে সম্পত্তিও রয়েছে। তার সম্পদের উৎস অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অথচ ভাতা পান দৈনিক ১শ টাকা। তার স্ত্রীর নামেও রয়েছে বিপুল সম্পদ।
ঢাকা পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী মো. রমিজ উদ্দিন সরকার।
রাজধানীতেই ৫টি বাড়ি, গাজীপুরে একরের পর একর জমি। জন্মস্থান কুমিল্লাতেও একই অবস্থা। পিছিয়ে নেই স্ত্রীও। তার নামেও রয়েছে জমি আর পুঁজিবাজারে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ। তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার দুর্নীতিবাজদের সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছেন দুদক কর্মকর্তারা। বেরিয়ে আসছে সাগর চুরির ঘটনা। সামান্য কর্মচারী হয়ে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন অনেকে।
জানা গেছে চট্টগ্রামের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারী, কাস্টমস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, শিক্ষা দপ্তর, পিডিবি, ভূমি অফিস, জেলা প্রশাসন, সিডিএ, সিটি করপোরেশন, আয়কর, ভ্য্যাট কমিশনারেট, ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতিবাজদের সম্পদের অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে দুদক।
দুদকের চেয়ারম্যান মো. ইকবাল আহমেদ সাংবদিকদের বলেন, দুর্নীতিবাজ যেই হোক ছাড় নেই। তাদের এবং তাদের সহায়তাকারীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। দুর্নীতি করে কেউ রেহাই পাবে না।
দুদক সূত্রে জানা যায়, দুর্নীতিবাজরা তাদের স্ত্রী-সন্তানসহ স্বজনদের নামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। তাদের ধারণা ছিল দুদক স্বজনদের দিকে নজর দেবে না। ফলে গোপনই থেকে যাবে তাদের সম্পদ।
তবে দুদক দুর্নীতিবাজদের স্ত্রী-সন্তান, বাবা, মা, শ্যালক, ভাই বোন, শ্বশুর-শাশুড়িসহ স্বজনদেরও টান দিচ্ছে। তাদের সম্পদের খোঁজ নেয়াও শুরু করেছে। গত ৬ মাসে একশ দুর্নীতিবাজের দেড়শ স্বজনের নামে মামলা হয়েছে। জেলে গেছে ৩০ জনের মত।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, দুর্নীতিবাজদের অর্থ হেফাজতকারীরাও সমান অপরাধী। তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে তাদেরও রেহাই নেই। মামলায় তাদেরও আসামি করা হবে এবং গ্রেপ্তার করা হবে।
সূত্র জানায়, দুদকের নতুন আইন অনুযায়ী অনুসন্ধানকালে অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারবে আদালতের অনুমতি নিয়ে। ইতোমধ্যে আবজাল হোসেনের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। একই সাথে স্বজনদের সম্পদও বাজেয়যাপ্ত করা যাবে।
দুর্নীতিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে আতংক বিরাজ করছে স্বজনদের মধ্যেও। তারা এখন সম্পদকে বোঝা মনে করছেন। তাদের নামে রাখা সম্পদ মূল মালিককে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন।
তবে দুদক বলছে, ফিরিয়ে দিলেও রক্ষা নেই। অনুসন্ধানে সব বেরিয়ে আসবে। মামলা তাদের নামেই হবে।