এবার ডোবায় মিলল শিশু আয়নীর মরদেহ

36

নিজস্ব প্রতিবেদক

হালিশহরের বড়পোল বস্তির শিশু সুরমা আক্তারের কথা নিশ্চয়ই ভুলে যান নি পাঠক? কিংবা জামালখানের হতভাগী শিশু বর্ষা? এবার তাদের পরিণতিই বরণ করতে হয়েছে পাহাড়তলীর ওয়ার্লেস মুরগীর ফার্ম এলাকার দশ বছর বয়সী আবিদা সুলতানা আয়নীকে। অপহরণের অভিযোগে আদালতে মামলার পরদিন গতকাল বুধবার ভোর রাতে আলম তারা পুকুরপাড়ার ডোবা থেকে শিশু আয়নীর বস্তাবন্দী অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করেছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিশন বা পিবিআই সদস্যরা। বিকালে আদালতে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আসামি মো. রুবেল। আসামি রুবেল পেশায় সবজি বিক্রেতা এবং ভিকটিম আয়নীর প্রতিবেশি।
পিবিআই মেট্রো অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) নাইমা সুলতানা বলেন, ডোব থেকে বস্তাবন্দী শিশু আবিদা সুলতানা আয়নীর গলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হয়েছিল, ধর্ষণের পর আসামি রুবেল আবিদাকে হত্যা করেছে। তবে বিকালে আসামি রুবেল ভিকটিমকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দি গ্রহণের পর আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে গত ২১ মার্চ শিশু আবিদা সুলতানা আয়নী স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর নগরীর পাহাড়তলী থেকে নিখোঁজ হয়। পরে শিশু আয়নী অপহরণের শিকার হয়েছে অভিযোগ করে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক শরমিন জাহানের আদালতে এ মামলা করেন তার মা পোশাক কারখানার কর্মী বিবি ফাতেমা। মামলায় তাদের প্রতিবেশি তরকারি বিক্রেতা মো. রুবেলকে আসামি করা হয়। শিশু আয়নী পাহাড়তলী এলাকার আব্দুল হাদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। পাহাড়তলীর কাজীর দীঘির পাড় এলাকায় তাদের বাসা। তার বাবা আবুল কাশেমও ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। আসামি রুবেল একই এলাকার মৃত আব্দুল নূরের ছেলে।
যেভাবে মরদেহ উদ্ধার : শিশু আয়নীর লাশ উদ্ধারের পর গতকাল বুধবার দুপুর ১২টায় এ বিষয়ে পিবিআই মেট্রো কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সংস্থাটি। এতে পিবিআই মেট্রো ইউনিটের পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, মামলার পর পিবিআই ঘটনাটির ছায়া তদন্তে নামে। ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে সন্দেহভাজন আসামি রুবেলকে আটক করা হয়। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তিনি হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়ার কথা স্বীকার করেন। এরপর তরকারি ব্যবসায়ী রুবেল আয়নীকে বিড়াল ছানা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অপহরণের পর একটি খালি বাসায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে শিশুটিকে গলাটিপে হত্যা করে বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। খুনের পর তিনি শিশুটির মরদেহ বস্তাবন্দী করে মুরগির ফার্ম বাজার এলাকার আলম তারা পুকুরপাড়ার ডোবার আবর্জনার নিচে মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখে। বুধবার ভোরে শিশুটির গলিত মরদেহ উদ্ধার করা হলে শিশুটির গায়ে একটি কালো গেঞ্জি, এক জোড়া স্যান্ডেল, একটি কালো পায়জামা ও একটি গাঢ় নেভি বøু-রংয়ের হিজাব জব্দ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তরকারি কেনার সুবাদে নিহত শিশু আয়নীর মায়ের সাথে আসামি রুবেলের পূর্বপরিচয় ছিল। আয়নীও আসামি রুবেলের পরিচিত ছিল। সে সুবাদে রুবেল ভিকটিম আয়নীকে বিড়ালছানা নিতে স্কুল শেষে ক্লাবের পাশে নির্দিষ্ট স্থানে আসতে বলে। তার কথামতো আয়নী স্কুল ছুটির পর স্কুল ড্রেস পরিবর্তন করে সেখানে গেলে রুবেল তাকে একটি খালি বাসায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এসময় শিশুটি চিৎকার করলে তাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়।
পুলিশের বিরুদ্ধে স্বজনদের অভিযোগ ঃ শিশু আয়নীর মরদেহ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থলের অদূরে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছিলেন তার মা বিবি ফাতেমা। তার অভিযোগ, ঘটনার পর থানায় গেলে ওসি মামলা নেয়নি। আসামির নাম বলার পরও তাকে ডেকে এনে কথাবার্তা বলে আবার ছেড়ে দিয়েছেন। উল্টো ওসি তাদেরকে বলেছেন, শিশু আয়নী প্রেম করে ঘর থেকে বেরিয়ে কারও সাথে পালিয়ে গেছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ক্লাস ফোরের একটা মেয়ে কী প্রেম করে কারও সাথে পালিয়ে যেতে পারে? তার বিলাপে উপস্থিত অনেকের চোখও জলে ভিজে যায়। তিনি তার একমাত্র মেয়েকে পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে হত্যায় জড়িত সকলের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, থানার ওসি যথাসময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে তার মেয়েকে হয়তো অকালে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হত না। তিনি পুলিশের আচরণেও সন্দেহ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর থানায় গিয়েছিলাম। পুলিশ যদি আমার মেয়েকে তখন থেকেই খুঁজতো তাহলে হয়তো তাকে এই ভয়ঙ্কর পরিণতি বরণ করতে হত না। আমি বার বার পুলিশকে বলেছি, রুবেলকে সন্দেহ হয়। সে আমাকে দেখলে হাসে। পুলিশ আমার কথার গুরুত্ব দেয়নি। মরদেহ উদ্ধারের সময় পাহাড়তলীর কাজীর দিঘীরপাড় এলাকায় ভিকটিমের স্বজন ছাড়াও স্থানীয় অনেক লোক জড়ো হন। তারা সবাই অভিযুক্ত রুবেলের ফাঁসি দাবি করেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে পাহাড়তলী থানার ওসি দুলাল মাহমুদ কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি ঃ নগরীর পাহাড়তলী থানাধীন মুরগী ফার্ম আলম তারারপুকুর পাড় এলাকায় শিশু আবিদা সুলতানা আয়নীকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন আসামি মো. রুবেল। গতকাল বুধবার বিকেলে মহানগর হাকিম জুয়েল দেবের আদালতে তিনি এই জবাববন্দি দেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক ইখতিয়ার উদ্দিন বলেন, গ্রেপ্তার রুবেল ধর্ষণের পরে শিশু আয়নীকে গলাটিপে হত্যার পর মরদেহ ডোবাতে ফেলে দেন বলে দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালত জবানবন্দি গ্রহণ করে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।
এর আগে গত ২৮ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক শরমিন জাহানের আদালতে আসামি মো. রুবেল বিড়ালছানা দেয়ার লোভ দেখিয়ে আবিদা সুলতানা আয়নীকে অপহরণ করার অভিযোগে তার মা বিবি ফাতেমা বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলাটি আদালত পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এজাহার হিসেবে নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।