এডভোকেট ফজলুল হক চৌধুরী একজন আদর্শ শিক্ষক ও সমাজসেবক

34

শাহজামান চৌধুরী

বাংলাদেশের একমাত্র মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীর তীরে অবস্থিত একটি ছোট ইউনিয়ন ও গ্রাম-গড়দুয়ারা। গড়দুয়ারার দক্ষিণে চট্টগ্রামের শাসক পরাগল খানের নামানুসারে পরাগল খাল যা বর্তমানে পরাকপালী নামে পরিচিত। বাংলার বার ভূইয়া প্রধান ঈশা খান মোগল সেনাপতি খান ই-জাহান কর্তৃক যুদ্ধে পরাজিত হইয়া ১৫৮৪ সালে এই অঞ্চলে সৈন্য সংগ্রহ করে হাটহাজারী সদরের অদুরে বসবাস শুরু করেন। ঈশাখান এর নাম অনুসারে ইহার নাম হয় ঈশাপুর সেখানে তিনি দূর্গ গড়ে তুলেন। গড় শব্দের অর্থ দূর্গ। দূর্গের দুয়ার ছিল পূর্ব দিকে। তাই ইহার নাম হয় গড়দুয়ারা। স্বাধীনতার পূর্বে গড়দুয়ারা উত্তর মাদার্শা ইউনিয়ন এর সাথে সংযুক্ত ছিল। স্বাধীনতার পরে ইহা ৯নং গড়দুয়ারা ইউনিয়ন হিসেবে আলাদা হয়।
এডভোকেট ফজলুল হক চৌধুরী ১৯৩৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর গড়দুয়ারা গ্রামে ‘ত্বকী’ চৌধুরী বাড়ী’তে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ্ব মেরামত আলী চৌধুরী ও মাতার বিজা খাতুন। তিনি গড়দুয়ারা ম্যানেইজড প্রাইমারী বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বিনাজুরী হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণিতে মাদার্শা হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৫৪ সালের কানুগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে আইএস-সি, ১৯৫৬ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এডভোকেটশীপ লাভ করেন। তিনিই গড়দুয়ারা ইউনিয়নের প্রথম বিএ, এলএলবি ডিগ্রীধারী ছিলেন। এলএলবি ডিগ্রী লাভের পর তাঁকে গড়দুয়ারাবাসীর পক্ষ থেকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাটহাজারী ও পাঁচলাইশ থেকে নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, আইনজীবি, ইসলামিচিন্তাবিদ অধ্যাপক এবিএম সুলতানুল আলম চৌধুরী, ব্যারিষ্টার সাইফুদ্দীন সিদ্দীকি, ব্যারিষ্টার সলিমুল হক খান মিলকি, এডভোকেট সেকান্দার মিয়া, অধ্যাপক আহমদ হোসেন, তৎকালীন পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবুল খায়ের সিদ্দীকী, আবদুল্লাহ আল ছগীর আরও অনেকে।
১৯৫৬ সালে তিনি ফটিকছড়ি রোসাংগিরী হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদেন, ১৯৫৭ সালে ফটিকছড়ি জাহানপুর হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদেন, সেখানে তিনি খুবই সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন উল্লেখযোগ্য- কলেজিয়েট স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মরহুম আবদুল আজিজ, ড. শহীদুল্লাহ একাডেমীর প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মনমথ বড়–য়া, শিক্ষক সমিতির প্রাক্তন সভাপতি এটিএম রফিকুল আনোয়ার, জাফতনগর ইউনিয়ন এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান চৌধুরী আরও অনেকে। ফজলুল হক চৌধুরী ১৯৫৮ সালে তিনি মাদার্শা হাই স্কুলে যোগদান করেন। সেখানেও তার অনেক ছাত্র-ছাত্রী সমাজে সু-প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ইংরেজী, গণিত ও বিজ্ঞানে তিনি ছিলেন পারদর্শী তাই দীর্ঘদিন পরও ফজলুল হক চৌধুরীর ছাত্ররা তাকে শ্রদ্ধাভরে একজন আদর্শ নীতিবান শিক্ষক হিসেবে স্মরণ করেন।
১৯৫৯ সালে ফজলুল হক চৌধুরী কন্ট্রোলার অব ইম্পোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট, চট্টগ্রাম (সিসিআইএন্ডই) অফিসে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদেন। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দ্বায়িত্ব পালন করেন। ৬০ এর দশকে পাকিস্তান সরকার ওজিএল (ওপেন জেনারেল লাইসেন্স) ইস্যু করেন। তখন অবাঙালি ব্যবসায়ীদেরকে সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হত। লাইসেন্সগুলি ও বেশীর ভাগ অবাঙালিদেরকে দেওয়া হত। তখন আমদানী রপ্তানী চট্টগ্রাম এর নিয়ন্ত্রক ছিলেন শফিউল আজম। বাঙ্গালী যারা মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী ছিলেন তারা শুধু সওদাগড়ি ব্যবসা করত। তারা আমদানী ব্যবসায় বুঝতনা তারা অবাঙালি ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভরশীল ছিল। পুরো পাকিস্তানের মূল ব্যবসার কেন্দ্র ছিল খাতুনগঞ্জ। অবাঙালি ব্যবসায়ীরাই খাতুনগঞ্জের ব্যবসার নেতৃত্ব দিত। শফিউল আজম, ফজলুল হক চৌধুরী ও অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসাররা বাঙ্গালী ব্যবসায়ীদেরকে আমদানী করার জন্য উৎসাহিত করেন এবং শফিউল আজম ও ফজলুল হক চৌধুরীর পরামর্শ মতে আমদানী ব্যবসায় শুরু করে অতিশ্রীগ্রই উন্নতি লাভ করতে থাকেন। তাঁরা চট্টগ্রামের সওদাগর ব্যবসায়ীদেরকে ওজিএল লাইসেন্স গ্রহণ সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগীতা করেন। সেই লাইসেন্স গুলি ৮০ এর দশক পর্যন্ত চালুছিল। যার কাছে একটি লাইসেন্স ছিল সেটি বিক্রি করে সারা বৎসর পরিবার চলত। ওজিএল লাইসেন্স প্রাপ্তিতে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আমদানী রপ্তানী দফতরের সরকারী চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে খাতুনগঞ্জে ব্যবসায় আসার পর মৃত্যু পর্যন্ত খাতুনগঞ্জের তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত বড় বড় ব্যবসায়ীরা তাঁকে প্রচুর সম্মান করতেন। যারা এখনো বেঁচে আছে তারা তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। তখন বাঙালিদের জন্য পাকিস্তান সরকারের চাকুরী ছিল একটি দুর্লভ বস্তু। তবুও ফজলুল হক চৌধুরী ১৯৬৫ সালের শেষের দিকে লোভনীয় সরকারী চাকুরী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিজে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্ব প্রথম সকল হল ও অফিসে যাবতীয় আসবাবপত্র সরবরাহ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি আমদানী ও ইন্ডেন্টিং ব্যবসা চালু করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর আমদানী ও ইন্ডেন্টিং ব্যবসার পাশাপাশি তাঁত শিল্প, বেকারী শিল্প, ব্রিকফিল্ড শুরু করেন। ১৯৭৫ সালের জাপানের কয়েকটি প্রখ্যাত কাপড় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে সারা বাংলাদেশে একক ভাবে ব্যবসা শুরু করেন।
১৯৭৩ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বড় ইউনিয়নগুলিকে ভেঙ্গে পৃথক ইউনিয়ন করার ঘোষনা দিলে ফজলুল হক চৌধুরী একক প্রচেষ্টায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে তদবীর করে গড়দুয়ারাকে আলাদা ইউনিয়ন করার অনুমোদন লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২৩ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে ২য় বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে নবগঠিত গড়দুয়ারা ইউনিয়নকে একটি সমৃদ্ধ ইউনিয়ন হিসেবে গঠন করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। সর্ব প্রথমে তিনি রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, বিদ্যুতায়ন, হালদার ভাঙ্গন রোধ করা প্রচেষ্টা শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে জনাব ফজলুল হক চৌধুরী তারই শিক্ষক বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে হালদা নদীর ভাঙ্গন পরিদর্শনের জন্য গড়দুয়ারা নিয়ে যান। ১৯৮১ সালে সর্ব প্রথম বিদ্যুতায়ন শুরু হয়। উপজেলা পরিষদ গঠিত হওয়ার আগে প্রতিটি থানায় একটি উন্নয়ন কমিটি ছিল। নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের মধ্যে থেকে একজন শিক্ষিত যোগ্য ব্যক্তিকে থানা উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার বিধান ছিল। ১৯৭৯ইং সালে ফজলুল হক চৌধুরী হাটহাজারী থানা উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি সুনামের সাথে ১৯৮১ইং সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
নবগঠিত গড়দুয়ারা ইউনিয়নটিতে শূন্য থেকে কাজ শুরু করেন। ফজলুল হক চৌধুরী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ করার জন্য ১৯৭৯ সালে ১১ গন্ডা জমি দান করেন। ১৯৮১ইং সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব ওমরফারুক গড়দুয়ারা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ইউনিয়ন পরিষদের দীর্ঘদিন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন কালে ফজলুল হক চৌধুরী কোন দিন বেতন ভাতা গ্রহণ করেন নাই। তা তিনি ইউনিয়ন পরিষদের তহবিলে জমা করে উন্নয়ন কাজে ব্যয় করতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর ২৩ রমজান ইফতারের পর গেরিলা যোদ্ধারা ইকবাল রোডের মাথায় ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেয়। সেখান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করে দুইদিন কোতোয়ালী থানায় আটকে রাখে।
ফজলুল হক চৌধুরী ড. শহীদুল্লাহ একাডেমীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বিদ্যালয়ের মূলভবনের সম্পূর্ণ ইট তিনি দান করেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতার সময় প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি গড়দুয়ারা কেন্দ্রীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দান করেন। এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন মুফতি ফয়েজুল্লা সাহেবের নামে ‘ফয়েজুল্লাহ ফোরকানিয়া মাদ্রাসা’, ‘গড়দুয়ারা শাহী মসজিদ’ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এবং আজীবন মতোয়াল্লী ছিলেন। গড়দুয়ারা দারুল উলুম মুহিউল ইসলাম মাদ্রাসার তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি উত্তর জেলা বিএনপি এর সহ-সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা তাঁত মালিক সমিতির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৬ সালে ১০ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র পঞ্চাশ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক