এটি যদি মাংস হয়, বিড়াল গেল কই?

63

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

মোল্লা নাসিরুদ্দিন ১কেজি মাংস এনে স্ত্রীর হাতে দিয়ে কাজে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় স্ত্রীকে বলে গেলেন মাংস রান্না করে রাখতে, তিনি এসে খাবেন। মাংস দেখে মোল্লার স্ত্রীর সব মাংস একা খেতে ইচ্ছে হল। কাজ সেরে বাড়ি এসে মোল্লা স্ত্রীর কাছে খাবার চাইলেন। খিদেয় তাঁর নাড়ি-ভুঁড়ি চুঁ-চুঁ করছিল, তারউপর মাংস- সে খিদাকে আরো চড়াচ্ছে। স্ত্রী খাবার পরিবেশন করলেন, মোল্লা খেতে বসলেন কিন্তু পরিবেশন করা খাবারে মাংস নেই। মোল্লা মাংস নেই কেন তা স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন। স্ত্রী জবাব দিলেন, মাংস বিড়াল খেয়ে ফেলেছে। মোল্লা! সব খেয়ে ফেলেছে? স্ত্রী! হ্যাঁ। মোল্লা দৌড়ে গিয়ে তখন বিড়ালটিকে ধরে পাল্লায় উঠালেন। দেখেন বিড়ালের ওজন ১ কেজি! বিস্মিত হয়ে মোল্লা তখন স্ত্রীকে প্রশ্ন করছেন; ‘মাংস আনলাম এককেজি, এখন এটি যদি বিড়াল হয়, তবে মাংস গেল কই? আর এটি যদি মাংস হয়, বিড়াল গেল কই?’ হাহা…। সেদিন সংবাদে দেখলাম, লকডাউনের ১ মাসে সড়কে নিহত ২১১। আর তা দেখে তৎক্ষণাৎ মোল্লা নাসিরুদ্দিনের উক্ত গল্পটি মনে পড়ে গেল, লকডাউনে রাস্তায় মানুষ মরে কেমনে, তা’ও সড়ক দুর্ঘটনায়? লকডাউন তাহলে আর থাকে কি করে? গাড়ি চললে লকডাউন হয় কেমনে, আর লকডাউন হলে গাড়ি চলে কেমনে? গাড়ি না চললে মানুষ মরে কেমনে, মানুষ মরলে গাড়ি না চলে কেমনে? সুতরাং গাড়ি চলে আর মানুষ মরে, লকডাউন আর চলে কেমনে ?
আসলে মোল্লার উক্ত গল্পটির সাথে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ ঘটনার পুরামিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রায়সময় দেখি পুলিশ আসামী খুঁজে পায় না। পাতাল ফেড়ে, আসমান ফুঁড়ে পুলিশ সন্ত্রাসী ঢুঁড়ে, আর সন্ত্রাসী মন্ত্রী-এমপিদের সাথে ঘুরে। জনতা দেখে পুলিশ দেখে না, হাহা…। মোল্লার মত মনে তখন প্রশ্ন আসে, মন্ত্রীর সাথে আসামী ঘুরে পুলিশ দেখে না কেমনে, আর পুলিশ যদি দেখে তবে সন্ত্রাসী থাকে কেমনে? বলেছি, জনতা দেখে পুলিশ দেখে না। তেমন আবার অনেক কিছু আছে যা পুলিশ দেখে কিন্তু জনতা দেখে না। যেমনÑ মরা মানুষের পাথর ছুঁড়া, হজ্বে থেকে ককটেল মারা, ইত্যাদি। এসব কিন্তু পুলিশ দেখে, জনতা দেখে না। এমন মামলা বেশী দেখা যায় ভোটে আর লুটে। তখন নাসিরুদ্দিনের মত মনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, মরা যদি পাথর ছুঁড়ে তাহলে সে মৃত কেমনে? আর যদি সে মৃত হয় তাহলে পাথর ছুঁড়ল কেমনে ? অবশ্য অসম্ভব কিছু না, এখানে সব সম্ভব। কথায় আছে না দিনের বেলায় তারা দেখা? এটিও তেমন দিনের বেলায় তারা দেখার মত। আমরা দিনের বেলায় তারা দেখি রাতের আকাশে সূর্যও দেখি। তাই খাটের তলে পাই আমরা কাড়ি কাড়ি টাকার থলি। এখন আবার পাচ্ছি মোরা বড় বড় তেলের খনি, হিহি। ফলে কথা, খাট থাকলে তেল আসে কেমনে, তেল থাকলে খাট আসে কেমনে? মনে হয় তৈল চর্চার এ সুসময়ে তেল নিয়ে আদিখ্যেতার ফল খাটের তলে তেলের ঢল।
কথা হচ্ছে লকডাউন চলছে তার ভেতর ১ মাসে সড়কে ২১১ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। অতএব বুঝা যাচ্ছে লকডাউনের ভেতরও সড়কে হাল্কাপাতলা গাড়ি কিছু চলেছে। এখন হাল্কাপাতলাতে যদি হয় এ হাল, ভারিমোটাতে তবে কি অবস্থা হবে? তবে কাঞ্চন সাহেব বলেছেন, ২০১৯-এ ৫২২৭ জন মানুষ মারা গেছে। হিসেব করলে গড়ে মাসে পড়ে ৪৩৬ প্রায়। তাহলে লক-ডাউনে ভরা মাসের তুলনায় কি এমন কম হল? এখন তো বলতে গেলে গাড়ি তেমন চলেই না, দু’য়েকটা মাঝে মধ্যে পণ্যবাহী গাড়ি চলতে দেখা যায় মাত্র। তাতেই এ দশাÑ কিন্তু এমন কেন হচ্ছে? একবার যে মন্ত্রী বলেছিলেন, গরু-ছাগল চিনলে হয়, ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য চালকের আর কোন যোগ্যতা দরকার নাই। মনে হয় চালকরা তাই মানুষ চেনে না, গরু-ছাগল বাঁচিয়ে চালাতে গিয়ে তারা গাড়ি মানুষের উপর তুলে দেয়। কারণ মানুষ তো চেনা তাদের দরকার নাই, গরু-ছাগল চিনলে চলে, হেহেহে। স্বাভাবিকভাবে মনে তাই প্রশ্ন জাগে, নেতা যদি এ কথা বলে, জনতা বলবে কি? ছাগল চিনে চালক হলে, মন্ত্রী হবে কি চিনিলে? অতএবএটা’ই হল আমাদের দেশ। আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী, সাথী মোদের ফুলপরী; লালপরী, নীলপরী সবার সাথে ভাব করি। নিখোঁজ হলে দু’মাস পরে সীমান্ত হতে ধরি, পিছমোড়া বেঁধে তাকে কোর্টে হাজির করি। ভাবছি একজন সুপরিচিত, প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক হওয়া সত্তে¡ও শফিকুল ইসলাম কাজল ভিসাবিনে কেন ভারত গেলেন? আবার নিখোঁজ হওয়ার ৫৪ দিন পর সীমান্তরক্ষীদের কাছে ধরা দিলেন কেন?
অতএব মোল্লার ন্যায় স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে নিখোঁজ হলে ভারত গেলেন কেমনে, আর ভারত গেলে নিখোঁজ হন কেমনে? তেলেসমাতি কারবার কিছু বুঝি নারে বাবা, হাহাহা। তবে আজবকাÐ আমাদের নিখোঁজদের কেবল ভারতে পাওয়া যায়। আগরতলা, ত্রিপুরা, বেনাপোলে উ™£ান্তের ন্যায় ঘুরে, সীমান্ত রক্ষীরা ধরে হস্তান্তর করে। অনেকদিন নিখোঁজ রয়, পাগল বেশে উদ্ধার হয় কিংবা গ্রেফতার হয়। শুধু বুঝি না তারা কি নিখোঁজ হয়ে পাগল হয়, না পাগল হয়ে নিখোঁজ হয়? আর বুঝিনা সুস্থ, সবল, সুপুরুষ ঘর থেকে বের হয়েই দিন না যেতে পাগল হয় কেমনে, হেহেহে? আলোচনা করছিলাম পুলিশ আসামী খুঁজে পায় না। তার প্রতিফলন আবারও দেখলাম ফরিদপুরে ভাঙ্গা উপজেলার ল²ীপুর গ্রামে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ফাঁসির দÐমুক্ত আসলাম ফকির মুক্তির তিন বছরের মাথায় শহীদ মাতুব্বরকে শহীদ করে বসে আছে, মাশাল্লাহ্। দিনেদুপুরে এলাকায় প্রকাশ্য ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না, হাহাহাহা। জনতা দেখলে পুলিশ দেখে না, পুলিশ দেখলে জনতা দেখে না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, সে থাকলে পুলিশ থাকে কই, পুলিশ থাকলে সে থাকে কই? দেশে চলছে করোনার ভয়াবহতা, সেদিকে ব্যস্ত থাকায় সম্ভবত আসলাম বিষয়ে পুলিশ হদিস কিছু করতে পারছে না। আর সে’ও যেহেতু ফকির তাই ফিকির কিছু তো অবশ্যই করবে। ফকির মশায় ফিকিরকরে তোলেছে পুলিশে জিকির, মাগার পুলিশ পারেনি তাকে করিতে এখনো বাহির। তবে করোনার কথা লিখার মাঝে গেলই এসে যখন, চলুন সেথায় দেখি তাহলে কি ঘটছে এখন?
বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন খাটে শুয়ে লিটারের পর লিটার নিয়েছেন অক্সিজেন। আর আমাদের দেশে খাটেরতলে চলছে লিটারে লিটার তেলের সিজেন। মানুষের চলছে প্রাণ নিয়ে টানাটানি, কেউ করছে ত্রাণ নিয়ে হানাহানি। সেদিন দেখি হাটহাজারীতে ত্রাণ নিয়ে কথা কাটাকাটি, তারপর হাতাহাতি, তারপর মারামারি এবং শেষে খুনাখুনি। ত্রাণ নিতে প্রাণ যায় অথচ ত্রাণ অর্থ হলরক্ষা, মুক্তি, নিষ্কৃতি। ফলে স্বাভাবিক মনে প্রশ্ন আসে, ত্রাণ হলে প্রাণ যায় কেমনে, প্রাণ গেলে ত্রাণ হয় কেমনে, হেহেহে?গতবছর দেখলাম শ্রমিকের মজুরী বেশী তাই কাটার বদলে কৃষক পাকাধানে আগুন দিয়েছেন। তাতেই বহু সংগঠনকে দেখেছি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কৃষকদের ধান কেটে দিতে এগিয়ে আসতে। আর তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক হৃদয়বানদের দেখলাম কাঁচা ধান কেটে কৃষকদের সহযোগিতা করা শুরু করেছেন। সেই সাথে কি যে ছবির আপলোড ফেবুতে, ধান কাটার দৃশ্য সবাই দেশ সেবায় নিয়োজিত, বাহ্। এবার করোনার কারণেও দেখলাম একই কাÐ। লকডাউনে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না তাই দয়াবানরা এসে কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন। নেতা, এমপির সাথে প্রচুর কর্মী মিলে কাঁচাধান কেটে কৃষকদের প্রচÐ সহযোগিতা করা শুরু করলেন। অবশ্য উপায়ও নেই, ধান তখনও পাকেনি। তাই বলে কি সেবাব্রতে নিয়োজিত মান্যবরগণ সেবাদানে বিয়োজিত হবেন? কক্ষনো না, পুবের সূর্য পশ্চিমে উঠবে সেবা বন্ধ হবে না, ধান তো ধান প্রাণ গেলেও না, হাহাহা। অতএব আবার মনে প্রশ্ন আসে, কাঁচা কাটলে সেবা হয় কেমনে, সেবা হলে কাঁচা কাটে কেমনে? ফলে কবি যোগীন্দনাথ সরকারের ‘মজার দেশ’ মনে পড়ে যায়। এক যে আছে মজার দেশ সব রকমে ভালো, রাত্তিরেতে বেজায় রোদ দিনে চাঁদের আলোÑ হোহোহো।
দেশে ১৬ মে পর্যন্ত লকডাউন বাড়ানো হল, অথচ ১০ মে দোকানপাট ও শপিংমলগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে মনে আবারও প্রশ্ন এল, দোকান খোলা থাকলে লকডাউন থাকে কেমনে, লকডাউন থাকলে দোকান খোলা থাকে কেমনে? ধন্যবাদ দোকান মালিকদের দোকান না খোলার জন্য। ঠিক আছে মোল্লা মানেননি অনিয়ম সব আমরা মেনেনিলাম। তাইবলে ত্রাণ নিতে গিয়ে ধর্ষিত হওয়াটা মানি কেমনে? সেদিন পূর্বদেশে দেখলাম ত্রাণ নিতেগিয়ে ২৭ জেলায় এপ্রিল মাসে ৪২৪৯ নারী, ৪৫৬ শিশু ধর্ষণ ও সহিংসতার শিকার হয়েছেÑ ওরেবাবা! তাহলে ত্রাণ টোপ নাকি? আমরা যেমন মাছ ধরতে বড়শিতে টোপ দেই, এখানেও কি তাহলেÑ হেহেহেহে? তাই প্রশ্ন, এটি যদি ত্রাণ হয় টোপ গেল কই, আর এটি যদি টোপ হয় ত্রাণ গেল কই? আহারে দুর্ভাগা দেশ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করছে করোনার ভ্যাকসিন তৈরীর প্রতিযোগিতা, আর আমরা করছি সব খানে প্রতিরোধিতা, অনাচার আর অরাজকতা। চারিদিকে দেখি শুধু হতাশা আর নিরাশা, মনে তাই পাই না কোন ভরসা। কারণ তথ্য যদি দিতে থাকি পরিসর ফুরিয়ে যাবে তথ্য ফুরাবে না তাই এখানে ক্ষান্ত দেই। তবে শত হতাশার মাঝেও বুকে বল পাই যখন দেখি ইতালি, জার্মানি, চীন, যুক্তরাষ্ট্র করোনার ভ্যাকসিন তৈরীতে সফল হয়েছে। আল্লাহ্ মোদের তুমি মানুষ কর বিপদ হতে রক্ষা কর, আমিন।

লেখক: কলামিস্ট