এখনও কাঁদেন শিউরে উঠেন উপকূলের মানুষ

60

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। এই দিনে স্বজনহারা মানুষেরা বুকে মাটি চাপা দিয়ে পার করছেন দীর্ঘ ২৮ বছর। উপকূলীয় দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর লোকজন এখনও শিউরে ওঠেন- ১৯৯১ সালের ভয়াল ২৯ এপ্রিল স্মরণকালের সর্বগ্রাসী ঘূর্ণিঝড়ের বিধ্বস্ত জনজীবনের কথা মনে পড়লে।
ভয়াল ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। এইদিনে দ্বীপ-উপজেলা মহেশখালীর ওপর বয়ে যায় স্মরণকালের এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। প্রায় ৮ ঘন্টার স্থায়ী ঘূর্ণিঝড় বাতাসের তীব্র তান্ডবে দ্বীপের নারী-পূরুষ ও অসংখ্য শিশুসহ প্রাাণহারায় ১০ হাজারের অধিক মানুষ। সে সাথে সমস্ত গৃহপালিত পশুর মৃত্যুস্তুপ পড়ে উপজেলাজুড়ে। বিধ্বস্ত হয় সমস্ত কাঁচা ও পাকা ঘর-বাড়ি, সড়ক, অফিস-আদালত ও দ্বীপ-রক্ষার বেঁড়িবাঁধ। মুহুর্তেই লন্ড-ভন্ড করে দেয় দ্বীপবাসীর স্বপ্ন। এই মহাদুর্যোগের ২৮টি বছর অতিবাহিত হলেও দ্বীপবাসীর মাঝে এখনো কাটেনি শোকের ছায়া। এদিনটি এলেই দ্বীপবাসীর ঘরে ঘরে শোনা যায় নিস্তব্ধ কান্নার শব্দ। ১৯৯১’র আগে জন্ম নেয়া প্রজন্মের কাছে বিভীষিকাময় একটি রাত ২৯ এপ্রিল। এই প্রজন্মের পরিসমাপ্তি ঘটলে এটি রূপকথার গল্প হিসেবেও পরবর্তী প্রজন্মকে জানতে শেখাবে।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭ টার দিকে শুরু হয় বাতাসের প্রচন্ডতা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বৃষ্টি ও তীব্র দমকা হাওয়া শুরু হয়ে যাওয়ায় কোথাও বেরুবার পথ ছিলনা মানুষের। ঠিক রাত সাড়ে ৯ টার দিকে হঠাৎ দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে তীব্র গতিতে লোকালয়ে ওঠে আসে বঙ্গোপসাগরের লোনা পানি। সাগর আর তীর একাকার হয়ে যায় ওই ঘূর্ণিঝড়ে। তখন ঘরের ছাদ ও গাছ-পালাসহ যে যেখানে পেরেছেন আশ্রয় নিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। ঝড় আর বাতাসের তীব্রগতিতে মানুষ ও পশু-পাখিদের আশ্রয়স্থল থেকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় পানিতে। এভাবে সলিল সমাধি ঘটে দ্বীপের কয়েক হাজার মানুষের।
সূত্রে জানা যায়, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে উপজেলার ধলঘাট, মাতারবাড়ি ও কুতুবজোম ইউনিয়ন লন্ডভন্ড হয়ে যায়। বসতবাড়ি ভেঙে গিয়ে গৃহহারা হয়ে পড়ে কুতুবজোম, মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ। পরে ১৯৯৭ ও ৯৮ সালে আরো দু’টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে কক্সবাাজারের এই উপকূলে। এরপর সিডর, বিজলী ও আইলা, রানু, মোরা’র আঘাত। এতে অন্তত ১০ থেকে ১৫ হাজার ঘরবাড়ি ভেঙে যায়।
সেই সময় রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা প্রচার করতে থাকে দূর্যোগের খবর। কিন্তু দ্বীপবাসী যেন পাত্তাই দিল না। ওই অবহেলায় কাল হলো দ্বীপবাসীর। দীর্ঘ প্রায় ৩১ বছর পর এতো ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় হতে পারে তা মানুষ বুঝতে পারেনি। এলাকার বয়োঃবৃদ্ধদের তথ্যমতে, ১৯৯১ সালের আগে ঘূর্ণিঝড়টি হয়েছিল ১৯৬০ সালে। সে কারণে তেমন আত্মরক্ষার চেষ্টা করেনি মানুষ।
মহেশখালী উপজেলার হোঁয়ানক ইউপির চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা কামাল স্মৃতিচারণ করে বলেন, ওই দিন হোঁয়ানকস্থ আমার নিজ বাড়িতে ৪-৫ ফিট পানি ঢুকে বাড়ির সমস্ত মালামাল নষ্ট হয়ে যায়। গবাদি পশুপাখি ও কাঁচা বাড়ি-ঘর ভেঙে গিয়ে মানুষের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল। তিনি বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংকেত মেনে চললে হয়তো বড় ধরণের ক্ষতি থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যেতো। ১৯৯১ সালে আবহাওয়ার সংকেত অবহেলা করার কারণে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল।
ধলঘাটা ইউপির চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, টেকসই বেঁড়িবাঁধ, পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র/সাইক্লোণ সেল্টার না থাকার কারণে এবং আবহাওয়ার সংকেতকে অবহেলার কারণে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল।
ধলঘাটা ইউনিয়নে মৃত্যুবরণ করা স্বজনদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মিলাদ ও দোয়া মাহ্ফিলের আয়োজন করেন স্বজন হারা পরিবারগুলো। এছাড়াও ২৯ এপ্রিল তারিখকে স্মরণ করে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন স্মরণ সভা, মিলাদ ও দোয়া মাহ্ফিলের আয়োজন করে। মহেশখালী উন্নয়ন পরিষদের ব্যানারে আজ (সোমবার) বিকেলে উপজেলার বড় মহেশখালীস্থ নতুন বাজার মাঠে স্মরণ সভা ও মিলাদ মাহ্ফিল আয়োজন করা হয়েছে।