এখনই সতর্ক হওয়া আবশ্যক

18

 

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি চিত্র ও সংবাদ পরিবেশ কর্মীদের মনে গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। সংবাদটি ছিল ঢাকার অদূরে একটি নদীতে জেলেদের জালে বিরল প্রজাতির মাছ ধরা পড়ার। অবশ্য এর আগেও কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যমগুলোতে বিরল প্রজাতির মাছ ধরা পড়ার ছবিসহ সংবাদ ছাপা হয়ে আসছিল। বিভিন্ন সংবাদ তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, উন্মুক্ত জলাশয় (নদী খাল, বিল, হাওর ও ডোবা) এবং বন্ধ জলাশয় (গৃহস্থ ও চাষের পুকুর) গুলোতে বিরল প্রজাতি ও প্রাকৃতিক মাছ ধরা পড়ার সংবাদ। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রায় সংবাদদাতা অজ্ঞতাবশত একে বিরল ও অদ্ভুদ আকৃতির মাছ বলে উল্লেখ করেছেন। আর গণমাধ্যমগুলো তথ্যের যাচাই না কওে হুবহু প্রকাশ করেছেন। ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে এভাবে সংবাদ প্রচার হতো না।
যাই হোক, বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ্বে সৌখিন নাগরিকদের বাড়িতে অ্যাকুরিয়াম সংস্কৃতি প্রবেশ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশে পারিবারিক বিনোদন সংস্কৃতি হিসাবে এর বিস্তার লাভ করে। সচ্ছল, উচ্চ ও মধ্যবিত্তের ঘরে ছোট বড় অ্যাকুরিয়াম শোভা পেতে থাকে। মধ্যবিত্তের অনেকের ঘরে অ্যাকুরিয়াম রাখাটা আভিজাত্য মনে করতেন। এই অ্যাকুরিয়ামে শ্যাত্তলা জমার কারণে ভারত থেকে অদ্ভুদ আকৃতির সাকার ফিসের আমদানি শুরু হয় আশির দশকে। দামে স্বল্পতা ও অ্যাকুরিয়ামের কাঁচ পরিষ্কার রাখার করণে সাকার মাছের চাহিদা বাড়ে। অন্যদিকে যৌক্তিক পরিবেশ পাওয়ায় এরা দ্রæত বেড়ে উঠে। তখন ছেট ছোট অ্যাকুরিয়ামের পালকগণ দুই তিন বছর পর পর পুরাতন বড় আকারের মাছগুলো উন্মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে ছেড়ে দিয়ে নতুন ছোট আকৃতির মাছ সংগ্রহ করে। এই সাকার মাউথ ক্যাটফিস উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে দেশে সংখ্যাতীতভাবে বাড়তে শুরু করে। যার প্রেক্ষিতে নদী খালসহ প্রভৃতি জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে দেখা দেয়। অবশেষে গণমাধ্যমও সামাজিক মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে।
সাকার মাউথ ক্যাটফিস চোষকমুখী মাছ (বৈজ্ঞানিক নাম Hypostomus Plecostonis এটি Plecostonis পরিবারের Hypostumns গণের একটি স্বাদুপানির মাছ। প্রধানতঃ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রবেশ করেছে এবং টিকে আছে। বাংলাদেশে IIUCN এর ২০০০ সালের তালিকাভুক্ত নয়। এরা পরভোজী হওয়ার কারণে তারা জীবন ধারণের জন্য অন্য জীবের উপর নির্ভরশীল। এরা ২৪ ঘণ্টা পানি ছাড়া বাঁচতে সক্ষম। এদের প্রাণ অতিশক্ত। পিষ্ট ও শরীদের দুই পাশে চারটি শক্ত পাখনা আছে। দেখতে অদ্ভুদ আকৃতির। দাঁতবেশ ধারালো। জলাশয়ের আগাছা, পোকামাড়ক, ছোট মাছ শিকার করে। বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকার তথ্য আছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় বুড়িগঙ্গার এক সময় প্রচুর শিং মাগুর মাছ পাওয়া যেত। দূষণের কারণে নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় এই মাছ প্রায় বিলুপ্ত। কিন্তু সেখানে এখন প্রচুর সাকার ক্যাটফিস পাওয়া যাচ্ছে। সাকার মাছ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। খাবার হিসাবে এর মান অতিনি স্তরের। মানুষের অজ্ঞতাহেতু ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের পাড়া মহল্লার বাজারে বিক্রি হতে দেখা গেছে বলে জানা যায়। বিরল মাছ বলে স্বার্থান্বেষী মহল জনসাধারণের কাছে চড়া দামেও বিক্রি করে থাকে। সাকার মাছের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো হচ্ছে এরা দ্রæত বংশবৃদ্ধি করে উন্মুক্ত জলাশয়ের দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশবৃদ্ধি ও প্রজননে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তারা দেশিয় প্রজাতির মাছের সাথে খাদ্য ও পরিবেশ নিয়ে প্রতিযোগিতা করে বা বসায়। জলাশয়ের ভূমি, পাড় ক্ষয় করে থাকে। দেশিয় প্রজাতির মাছের ডিম ও পোনা ভক্ষণ করে দেশিয় মাছের বংশ বিস্তারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং মূল্যবান মাছের প্রজাতি হ্রাসে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। জলাশয়ের উদ্ভিদ ও জৈব আবর্জনা খেয়ে জলাশয়ের সহনশীল খাদ্য শৃঙ্খলায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে। সাকার মাছের সঙ্গে স্বল্পায়ু তৃণভোজী, খরাকাতর দেশিয় মাছের অসম প্রতিযোগিতার ফলে দেশিয় মাছের উৎপাদন করে যায়। সর্বোপরি জীববৈচিত্র্য ধ্বংসে সহায়ক ভূমিাকা রাখে। সাকার মাছ এতো ক্ষতির কথা জানার পর আমরা কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করবো?
প্রথমত উন্মুক্ত জলাশয়ে না ফেলা, পাওয়া মাত্রই ধ্বংস করা, পুকুর, দীঘি ও চাষের জলাশয় সেচ দিয়ে এ মাছ সম্পূর্ণ ধ্বংস করা। আফ্রিকান মাগু, পিরানহা মাছের মতো মৎস্য সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৮৫-তে সাকার মাছ সম্পর্কে বিধিমালা সংযোজন করে আইনগত পদেক্ষেপ নেয়া। সভা সমাবেশ, সেমিনার, লিফলেট এবং পোস্টারিং করে জনগণকে সচেতন করা। আমদানি নিষিদ্ধ করা। বাজার ও অ্যাকুরিয়ামের মার্কেটগুলো মনিটরিং করা।
আমাদের দেশিয় প্রজাতির অনেক মাছ নানা কারণে ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অতএব দেশের উন্মুক্ত ও বন্ধ জলাশয়গুলোর বাস্ততন্ত্র ও প্রাণ প্রকৃতি এবং সর্বোপরি দেশিয় মাছ প্রজনন ও বৃদ্ধির স্বার্থে যতসম্ভব দ্রুত সাকার মাছ যোগান বন্ধ করতে হবে। আমাদের জলবায়ু ও প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য আইন প্রযোগকারী সংস্থা এবং জনগণকে সতর্ক হতে হবে। এ জন্য এখনই আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। পারিবারিক বিনোদনের জন্য অ্যাকুরিয়াম সংস্কৃতি পরিহার করা যাবে না। তবে আমাদের সকল মাছ পালনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা বাঞ্চনীয়।
লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)