এক নাম্বার গোলকিপার

9

 

ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী

শিশুর বয়স ৪ বছর পার হতে চলল। আঁচ পাওয়া গেল-সে মারাত্মক শ্বাস কষ্টে ভুগছে। শিশুর নাকের দু’পাশের মাংসপেশী, বুকের খাঁচার নিচের অংশ দেবে দেবে যাওয়া, শ্বাসে বাঁশির আওয়াজের মত শাঁই শাঁই শব্দ-এগুলো ছিল মুখ্য লক্ষণাদি। ‘মারাত্মক অ্যাজমা অ্যাটাক’ এটা। প্রধান চিকিৎসা-শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তিপূর্বক অক্সিজেন ও সাথে শিরায় অন্যান্য আনুষাঙ্গিক ওষুধের প্রয়োগ।
শিশুকে কেন দেরি করে এরকম বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে কাহিনীর ঘনঘটা জানা গেল অতঃপর।
বাবলু সাহেবের চাকুরি-ব্যবসা মধ্যপ্রাচ্যে। তিনি ও তাঁর দুই মেয়ে ব্রাজিল সমর্থক। কিন্তু মা-ছেলে হলো আর্জেন্টিনা। রাতে সৌদি আরবের কাছে নাস্তানাবুদ-দফাস আর্জেন্টিনা।
বুবলি হঠাৎ ফোনের উপরে ফোন পেয়ে বুকধড়পর উঠে পড়েন। ফোন রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলার সাথে সাথে ওপাশ থেকে স্বামীর বিদ্রুপবাষ্প কণ্ঠস্বর-‘খেলা কী বুঝেছ এবার! তোমার মেসি, আর্জেন্টিনা ছেড়ে দাও। এখনো সময় আছে ব্রাজিল হয়ে যাও’।
বুবলি ক্ষীপ্ত হয়ে বলেন- ‘এভাবে কেউ ফোন করে? মানুষের তো হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে’।
‘আচ্ছা আচ্ছা এবার গোল হজম করে ঘুমাও তাহলে।’ – বলে ফোন কেটে দেন সাহেব।
বিশ্বকাপ এগোতে থাকে। হলুদ জার্সি ও সাদা-নীল জার্সি সমর্থকদের মনে আশা-নিরাশার রামধনু।
হায় হায়। নেইমারের দেওয়া নৈপুণ্য গোলে প্রায় জেতা ম্যাচটাতে যেন হাতে ধরে শেষ পেরেক ঠুকে দিল ব্রাজিল দল।
এবার ফিরতি ফোন বুবলির, স্বামীকে। দশ-বিশ-পঞ্চাশ বার। ফোন ধরার নাম নেই। সকাল গড়িয়ে দুপুর। ভোর থেকে ছেলের কাশ, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট। কীভাবে কোথায় চিকিৎসা নেবে। এতবার টেলিফোন করেও স্বামীর সাথে যোগাযোগ পরামর্শ মেলেনি।
বিকেলের দিকে অবশেষে সাহেবকে ফোনে পাওয়া গেলো। মাঠ থেকে নাকি বাসায় গিয়ে দিয়েছেন বিমর্ষ ঘুম। সব যোগাযোগ ছিন্ন করে। শামীমা এবার টিপ্পনি কেটে স্বামীকে শোনান- ‘তোমাকে শতবার বলেছি মাঠে গিয়ে ব্রাজিলের খেলা না দেখতে। গত বিশ্বকাপেও মাঠে খেলা দেখাতে ব্রাজিল হটেছে’।
বাবলুর ছোট ভাই কাবুল থাকেন কাতার। কিন্তু বিশ্বকাপের কয়েকদিন আগে দেশে ফিরে এসেছেন। বিশ্বকাপ শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে স্টেডিয়ামগুলোর আশপাশের জায়গাতে যেখানে অধিকাংশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতীয়দের বসবাস সেখানে কিনা বাড়িঘরের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দেয় কর্তৃপক্ষ। ফলে তারা দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
-‘ মনে হয় বিশ্বকাপ আয়োজকদের পরিকল্পনা এরকম ছিল! ‘তো টিকিটের দাম কত?’
-‘প্রথম দিকে ছিল খুব সস্তা। ধরেন ওদের টাকার হিসেবে ৪০ টাকা। আর এক ধরনের টিকিট হচ্ছে ৮০০ টাকা। যা দিয়ে খেলা দেখা ছাড়াও আশেপাশের কয়েকটা দেশ বিনা টিকিটে ঘুরে আসা যায়’। সৌদিআরব নাকি প্রচেষ্টা প্রস্তাব রেখেছিল যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজনের। তবে কাতারের সোজা-সাপ্টা জবাব- আমার পুরো ক্ষমতা আছে এককভাবে করার। তোমরা এলে আসো, না এলে আমাদের কিছু যায় আসে না।
-‘স্যার জানেন, কাতারে একজন মহিলা শুধু মোবাইলে নাম্বার লিখতে পারলেই, একটা দোকানে বসে ওখানকার হাজার হাজার টাকা বেতন পান। এতো ধনী তারা !’
-‘কাতারের পুরুষেরা কি একাধিক বিয়ে করেন?’
‘হ্যাঁ। একেক বউকে একেক মডেলের গাড়ি, ডুপ্লেক্সÑআলিশান বাড়ি, দারোয়ান সব দিয়ে পুরণ করে রাখেন। তাতে কার কি বলার আছে স্যার?’
তাহলে তো বলা চলে, সে হিসেবে বাঙালি রমনীই ‘গোল্ডেন গ্লাভসের’ দাবিদার।
রোলস রয়েস বা মার্সিডিজ কার, ট্রিপ্লেক্স বাড়ি, যাই দেওয়া হোক না কেন, গোলবারের আশপাশে ঘেঁষে-এসে পেনাল্টি শুট, বাই-সাইকেল কিক, ফ্রি-কিক, কর্নার-কিক, কোনো কিছু থেকে সতিনকে গোল করার সুযোগ দেন না।
সংসার-পৃথিবী গোলপোস্টের এক নাম্বার গোল কিপার!

লেখক- প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।