একুশ শতাব্দী এসেও এখনও অস্পৃশ্য হরিজন স¤প্রদায়, এ আঁধার কাটবে কবে

10

রতন কুমার তুরী

১৯৩৩ সালে মহাত্মা গান্ধী সমাজের দলিত স¤প্রদায়দের নাম দিয়েছিলেন ‘হরিজন’ স¤প্রদায়। প্রকৃতপক্ষে সমাজের মেথর, ঝাড়ুদার, ডোম, ময়লা সাফাইকারী এসমস্ত জনগোষ্ঠীর মানুষদের যাতে সমাজের অন্যান্য পেশা বা শ্রেণির লোকেরা অবহেলার চোখে না দেখে সে চিন্তা করে তাদের এ নামটি দিয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে আধুনিক সভ্যতার এ-যুগে এসেও হরিজন স¤প্রদায়রা সমাজে বড়োবেশি অবহেলিতো। তাদের সবসময় দেখা হয় অবজ্ঞার চোখে। তাদের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর মানুষ এখনও সেই পুরোনো পেশাকে আঁকড়ে ধরে জীবন নির্বাহ করে গেলেও সমাজে নেই এদের কোনো সম্মান এবং মর্যাদা। এদের পরিচয় একটাই, হরিজন! এ পরিচয় নিয়ে সমাজের অন্যান্যদের সঙ্গে মেশা তো দূরের কথা, হোটেলে বসে খেতেও পারেন না তারা। কোনো কোনো জায়গায় চেয়ারে বসারও অধিকারও নেই তাদের! পরিচয় জানলে হয়তো স্কুলেও ভর্তি করাবেনা এসব হরিজন স¤প্রদায়ের সন্তানদের । একবিংশ শতাব্দীতে এসেও অস্পৃশ্য হরিজন স¤প্রদায়। যেনো তারা মানুষ নয়, হরিজন!
ভোরের আলো ফোটার আগে যারা নগরকে পরিষ্কার করে সৌন্দর্যমন্ডিত করে, সেই হরিজনদের জীবনের আঁধারই কাটছে না। হরিজনরা মূলত ঝাড়ুদার, মেথর, ডোম ও নোংরা পরিষ্কারের কাজ করে। তবে তারা শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা, চিকিৎসা, ভূমি মালিকানা সবদিক থেকেই বৈষম্যের শিকার। মানুষে মানুষে বিভাজনই আসলে হরিজনের জন্ম দিয়েছে। যে বিভাজনের বেড়াজাল থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেননি হরিজনরা।
দূর অতীতে অবিভক্ত ভারতবর্ষের দলিত এই হরিজন জনগোষ্ঠীটি এতোবেশি অবহেলিতো ছিলো যে, উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে অনেকেই এদের মানুষই মনে করতোনা। তারা ভাবতো এদের জন্ম হয়েছে নোংরা ময়লা এবং আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য। তখনও এসব হরিজন স¤প্রদায়ের মানুষ ছিলো রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। অথচ ‘হরিজন’ শব্দটির অর্থ ঈশ্বরের সন্তান(হরির জন)। এই নামটি মূলত মহাত্মা গান্ধী এই সমাজের মানুষদের সম্মানিতো করতেই দিয়েছিলেন। তিনি ১৯৩৩ সালে অস্পৃশ্যদের চিহ্নিত করার জন্য হরিজন শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি চেয়েছিলেন সমাজের চলতি ¯্রােতের সাথে এদের মিশিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি তা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন শুধুমাত্র সমাজের কিছু মানুষের অসহযোগিতার কারণে। প্রকৃতপক্ষে
সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথার কারণেই দেশের সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে হরিজন স¤প্রদায়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথাটির বিষবৃক্ষ রোপণ করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল আর্যরা। তারপর বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী ক্রমাগত সেই জাত-পাতের বিভাজন করেই গেছেন। এই বিভাজন সামাজিকভাবে এমন নির্যাতনে রূপ নিয়েছিল যে, সমাজে নিম্নবর্ণের মানুষের টেকাই দায় হয়ে উঠেছিল। তাদের অস্তিত্বের সংকট শুরু হয়ে যায় রীতিমতো। বাংলাদেশে এই বিভাজনের মধ্য দিয়ে বিস্তৃতি ঘটে বিভিন্ন ধর্মের। কিন্তু জাতিভেদের সংকট পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা বাংলাদেশ থেকে আজও যায়নি। ইতিহাসে যুগযুগ ধরে দলিত তথা হরিজন স¤প্রদায়ের কান্নার কোনে শেষ নেই।
হরিজনরা পূর্ববঙ্গে আসে আঠারো শতকের প্রথম দিকে। ভারত উপমহাদেশের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে। তৎকালীন জমিদার ও ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা তাদের অন্ন ও বাসস্থানের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসেন। এরপর তারা পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন ছিল সুইপারের চাকরি।
দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই কম বেশি হরিজনদের বসতি রয়েছে। হরিজনদের আছে নানা গোত্র যেমন- হেলা, হাড়ি, ডোম, বাগদি, ডোমার, তেলেগু, লালবেগি, বাঁশফোড় ইত্যাদি। হরিজনদের ভাষা ভিন্ন হলেও এখন বর্তমানে কাজেকর্ম ও যোগাযোগের সুবিধার্থে তারা বাংলা ভাষার ব্যবহার করা শুরু করেছেন।
হিন্দু পুরাণ মতে ধর্মের শেষ বর্ণ শূদ্রে জন্মগ্রহণ করায় তারা সাধারণদের সঙ্গে চলতে পারে না। একই পুকুরে গোসল করতে পারে না। তাদের স্পর্শ করাও নিষিদ্ধ। যুগের পর যুগ অস্পৃশ্যতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে প্রতিবেশী বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন তো দূরের কথা, কথা বলতে পর্যন্ত ভয় পায় তারা। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান সবার কাছে এরা শুধুই মেথর। মেথর ছাড়া নিম্নবর্ণের এই জাতিসত্তাকে দলিত, অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়ে থাকে।
হরিজন পল্লী বাংলাদেশের বাইরের কোনো এলাকা নয়। হরিজনরাও আমাদের দেশের, সংস্কৃতিরই একটি অংশ।
“আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই”, রাগতস্বরে বলছিলেন রতন বাশফুর। বাশফুররা এখানে অচ্ছুৎ, বাংলাদেশের একদম নিচু জাতের মানুষ তারা। রতন বাশফুরের পদবিই বলে দিচ্ছে সমাজে তার অবস্থান কোথায়। বাশফুররা ‘মেথর জাতে’র অন্তর্ভুক্ত, তারা থাকে হরিজন পল্লীতে। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বড়সড় বস্তিপল্লী গড়ে তুলে মানবেতর জীবনযাপন করে যাওয়া এক স¤প্রদায় তারা। ময়মনসিংহের হরিজন পল্লীতে ১,২০০ বস্তিতে বসবাসরত বাশফুররা একেকটি ঘরে কম করে হলেও পাঁচজন লোক থাকে। ঠিক একই অবস্থা অন্য পল্লীগুলোরও। স্বদেশে থেকেও হরিজনরা যেন পরদেশী। নিজ সমাজের কাছেই অস্পৃশ্য তারা। তাদের এই করুণ জীবনের গল্প শোনার মতো সময়ও নেই কারো। অথচ তারাই আমাদের দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজে নিয়োজিত থেকে সহজ-স্বাভাবিক করে তুলছেন আমাদের জীবন।
হরিজন পল্লীতে বসবাস করা মানেই স্যানিটেশনের যাচ্ছেতাই অবস্থা, কাজের অপ্রতুল সুযোগ, সময়ে-অসময়ে বন্যায় ভেসে যাওয়া, পচা-বাসি খাবার খাওয়া- সভ্য জগতের কাছে একেবারেই অকল্পনীয় একটি জীবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া। তাদের বস্তিগুলো সাধারণ বস্তির মতো নয়। সেখানে বিল্ডিং তৈরি করা আছে, তবে সেই বিল্ডিংয়ের চারপাশে পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করার গাড়ির কোনো নামগন্ধও পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা যেন এমন- মেথরদের আবার স্যানিটেশন কী ?
হরিজন কথাটির উৎপত্তির সাথেও মিশে আছে প্রহসনের গল্প। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গান্ধী দলিতোদের মেথর, সুইপার না বলে ‘হরিজন’ বলার অমোঘ বাণী দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাদের সমাজ ও সামাজিকতার স্বীকৃতি দেননি, মূল সমাজের সঙ্গে যুক্ত করেননি। ক্ষমতা যখন যার হাতে থাকে, তখন সেই শাসক জাত-পাতের ভেদাভেদ ভুলিয়ে দেয়ার মন্ত্র মুখে উচ্চারণ করলেও, বিভাজন টিকিয়ে রাখার জন্য একটি শাসক শ্রেণী ঠিকই তৈরি করে দিয়ে গেছেন এই ভেদাভেদ। মহাত্মা গান্ধী ‘হরিজন’ স¤প্রদায়কে সমাজে একটি সম্মানজনক স্তরবিন্যাস করতে চাইলেও পরবর্তী তিনি তা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন কারণ তখন সমাজে ছিলো কঠোর জাতভেদ প্রথা। এবং এই ভেদাভেদ প্রথায় তখন ভারতের সব এলিট শ্রেণিদের শতভাগ সমর্থন ছিলো। ফলে মহাত্মা গান্ধী সমাজের দলিতো স¤প্রদায়কে ‘হরিজন’ নাম দিয়ে সমাজের মূল ¯্রােতের সাথে মেশানোর চেষ্টা করলেও তিনি সমাজের অন্যান্য শ্রেণির সাথে পেরে ওঠতে পারেননি। বর্তমান সময়েও হরিজনদের আলোর পথ দেখাতে কেউ তেমন একটা এগিয়ে আসছে বলে মনে হয়না ফলে সমাজ অগ্রগতির এই সময়ে এসেও হরিজনদের জীবন বেদনারই রয়ে গেছে।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক