একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার

219

রশীদ এনাম

ছেলেবেলায় মায়ের মুখে প্রথম শুনেছিলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা। সেই সময় নানাবাড়িতে আগুন দিয়েছিল পাকবাহিনী। চারদিকে আগুন, গোলাগুলি আর বোমাবজি। চিৎকার আর আহাজারির শব্দ। লাশের গন্ধ বাতাসে। মায়ের বয়স আর কত চার-পাঁচ। মাকে পাখির ডানার মতো শাড়ির আঁচলে আগলে রাখতেন নানুজি।
একাত্তরের সেই গল্প শুনে ভয়ে শিউরে উঠতাম। চোখে দেখিনি ’৭১। মুক্তিযুদ্ধের নাটক, ছবি আর ইতিহাস পড়ে উপলব্ধি করতাম, যুদ্ধের স্মৃতিকথা শুনে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভাবতাম অনেক শত্রু সেনাদের খতম করব। দেশ স্বাধীন করব, স্বপ্ন ডানায় চড়ে, লাল সবুজের বিজয় নিশান কপালে বেঁধে সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করে আনন্দ মিছিল করব। বিজয় মিছিলের স্লোগান হবে, জয় বাংলা! জয় বাংলা!
আহারে, শিকড়ের কাছে শোনা সেই গল্প, মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্ম হয়ে হৃদয় গহিনে ধারণ করে স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ানো। যুদ্ধদিনের গল্প স্মৃতির ঝাঁপিতে রাখার চেষ্টা করেছি মাত্র। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই নক্ষত্র মাটি। যে মাটিতে সবাই হেসে-খেলে ঘুরে বেড়াই, জোছনা ভরা রাতে জোছনা উপভোগ করে, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিতে ভিজে। ঝাকিয়ে যখন শীত নামে কুয়াশার চাদর ছিড়ে প্রভাতফেরিতে যায় এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। আনন্দ সুখ দুঃখ একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা যেন সোনার বাংলাদেশ। এতো সুন্দর আমার দেশের মাটি বিশ্বে আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ।
সেই মা-মাটির টানে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, খুব কাছের প্রতিবেশী পটিয়া করল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা এম. আবুল বাশার। ৩১ মার্চ ১৯৫২ সালে পটিয়া করল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এম আবুল বাশার। পিতা মৃত আবুল খায়ের মাতা মরহুমা সুফিয়া খাতুন। পিতা ছিলেন ঠিকাদারী ব্যবসায়ী। ছয় ভাই দুই বোনের মধ্যে আবুল বাশার চতুর্থ। পড়ালেখার হাতে খড়ি পাইক পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬৮ সালে আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন পটিয়া কলেজে ১৯৬৮ সাল থেকে ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাশ করেন। সে সময় তিনি পটিয়া থানা ছাত্র লীগের সভাপতি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি সরাসরি মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। এবং ভারতের ত্রিপুরা হয়ে বিএসএফ ট্রেনিং নেন। তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন পটিয়া মুক্তিযুদ্ধ সংসদের সাবেক কমান্ডার শামসুদ্দিন আহমেদ, আহমদ কবির, আবুল কালাম, শহীদ ছবুর, চৌধুরী মাহাবুবুর রহমান সহ আরও অনেকে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে খানমোহনা স্টেশন , বোয়ালখালী, করনা রেলওয়ে স্টেশন, ইন্দ্রপোলসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনীদের সাথে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। তখনকার দিনে পটিয়া কলেজে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ ছিল, কান্ডারী ও দিশারী। আমি দিশারী গ্রুপ সমর্থন করতাম। তবে কান্ডারী ছিল মূলতঃ ছাত্রলীগের খুব শক্তিশালী একটি গ্রুপ।
আমার খুব কাছের প্রতিবেশী এবং আমার বাবার ইশকুলবেলার বন্ধু ছিলেন বাশার চাচা। বাবার মুখ থেকে বাশার চাচার গল্প শুনেছিলাম। বাবা বলতেন, “আমরাা যুদ্ধে না গেলেও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলী আকবর টুকুসহ মিলে মানুষের কাছ থেকে চাল, ডাল, টাকা পয়সা তুলে দিয়ে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন”।
মুক্তিযোদ্ধা আবুশ বশর চাচা ছোটবেলা থেকে পড়ার সাথীদের ছাড়া চলতেন না বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বেশ পছন্দ করতেন”। সহজ সরল বিনয়ী মৃদুভাষী একাত্তরের বশর চাচা যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “শহীদ ছবুর কান্ডারি গ্রæপ করতেন। পটিয়া খান মোহনা রেলওয়ে স্টেশন এলাকার অপারেশনের কথা। রাজাকার ও আলবদর এবং পাকবাহিনীর সদস্যরা একই রকমের পোশাক পরে থাকত। ওদের চিনতে খুব কষ্ট হত। সেই অপারেশনের সময় প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সামশুদ্দিন, গাজী ছবুর, আবুল কালাম, আহমেদ কবির, আহমেদ ছপা, চৌধুরী মাহবুব সহ আরও অনেকে ছিল। প্রায় আধঘন্টা ফায়ার হওয়ার পর কোথাও সাড়া শব্দ না পেয়ে রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ পাশের একটি কক্ষের প্রবেশ করলাম, শহীদ গাজী ছবুর লাথি মেরে দরজা ভেঙে ফেলে। সেদিন আমাদের রাইফেলের গুলির শব্দ শোনে অনেক রাজাকার পালিয়ে গিয়েছিল। কক্ষের ভিতর দেখে এক রাজাকারের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে আছে, হাতে রাইফেল ও পকেটে কার্তুজ। গাজী ছবুর গিয়ে হাত থেকে রাইফেল ও পকেট থেকে কার্তুজ ও কাগজপত্র নিয়ে ফেলল। শহীদ ছবুর রাইফেল দিয়ে গুঁতো মেরে দেখল রাজাকার বেঁচে আছে কি না? মুক্তিযোদ্ধা আবুল বশর বলল, থাক, সে মরে গেছে, আর গুঁতো মারার দরকার নেই। শহীদ ছবুর রেগে অগ্নিশর্মা। সে বলল, “বশর ভাই আপনি কি দরদ দেখাচ্ছেন রাজাকারের জন্য। এসব মেয়েলি স্বভাব নিয়ে কিভাবে দেশ রক্ষা করবেন”। মুক্তিযোদ্ধা বশর চাচা বললেন, ঠিক আছে বন্ধু আর দরদ দেখাব না চল। আবার অপরেশন শুরু হলো। হাজির মাঠে (পূর্ব দরগাহ এলাকায়) পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রয় নিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। সে সময় নাকি প্রায় সময়ে খেতে হত ডাল, ভাত আর সব্জি। একদিন শহীদ গাজী ছবুর বলেন, এসব আর খেতে ভালো লাগছে না। প্রতিদিন একই খাবার। সেদিন নাকি পাহাড়ি এলাকার একটি গরু জবাই করে মুক্তিযোদ্ধারা রান্না করে খেলেন। পরবর্তীতে খরনা অপারেশনের সময় প্রায় ৩০ জন রাজাকারকে হত্যা করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা আবুল বশরের আরেকটি স্মৃতি খুব মনে পড়ে। যুদ্ধকালীন সময়ে অপারেশনের সময় নাকি খুব নীরবে হাঁটতে হতো। একেবারে বিড়াল যেভাবে হাঁটে শব্দ না হয় মতো। শব্দ হলে পাকবাহিনী এবং রাজাকার আলবদর টের পেয়ে যাবে। সেই ভয়ে সবাই আস্তে আস্তে হাঁটত। মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার হাঁটার সময় নাকি শব্দ হত। গাজী ছবুর ভাই রেগে যেতেন। বশর ভাই আস্তে হাঁটেন। পায়ে শব্দ না হয় মতো। একেবারে বিড়ালের মতো হাঁটবেন। ডিসকো বাতাসী মেয়েদের মতো শব্দ করে হাঁটলে আপনি আমাদের শেষ করবেন। যুদ্ধকালীন সময়ে বিশেষ করে অপারেশনের সময়ে শব্দ করে হাঁটা খুব অপছন্দ করতেন গাজী আবদুস ছবুর”।
লাল সবুজের পতাকার জন্য পাকিস্তানী হায়েনাদের কাছ থেকে দেশ রক্ষার জন্য ৭১ এ কত আত্ম ত্যাগ আমরা করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। ১৯৭১ সালে ২ অক্টোরবর পটিয়া খেলিশহরের ভট্টচার্য হাটে সহযোদ্ধার সেম সাইডে ছবুর শহীদ হওয়ার ঘঁনাটি তাঁকে খুব কষ্ট দিয়েছিল শহীদ ছবুরের রক্তমাখা শার্টটির কথা আজও মনে আছে শহীদ শাহ আলম এই দুই শহীদের কথা মনে পড়লে আজও নিরবে নিভৃতে কাঁদি। যুদ্ধদিনের সেই স্মৃতি কথা মনে পড়লে আজও শরীরের পশম কাড়া হয়ে উঠে।
১৯৭৩ সালে পটিয়া কলেজ থেকে বিকম পাশ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত। ৯৮২ সালে বাবা মায়ের পছন্দ অনুযায়ী গুলনাহার বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দুই ছেলে ও দুই কন্যার জনক । চট্টগ্রাম শহরে থাকলে তিনি নিজভূমের টানে পটিয়া করল গ্রামের বাড়িতে এসে মাঝে মাঝে থাকেন। বই পড়া তার শখের মধ্যে একটি নিহাররঞ্জন গুপ্তের বই পড়ে বেশ মজা পেয়েছিলেন, “যে অংক মিলেনি” তার প্রিয় বই।
১৯৯১ সালে নিজের এলাকায় ঘুর্ণিঝরে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিকভাবে সহযোগিত করেছিলেন। এলাকায় লতিফিয়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসা ও নুরে জামে মসজিদের সভাপতি। নিজের গ্রামে বনেদি পরিবারের সন্তান হিসেবে এবং একাত্তরের একজন বীরমু্িক্তযোদ্ধা ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে এলাকার সবাই তাঁকে সম্মান করেন। এই বীরমুক্তিযোদ্ধার কাছে পশ্ন করেছিলাম আপনার জীবনের চাওয়া পাওয়া কী ? তিনি বললেন, কিছুই চাওয়া পাওয়ার নেই। বঙ্গবন্ধুর তনয়া মানবতার মা প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটা চাওয়া পাওয়া এই স্বাধীন দেশে যেন সুষ্টু গণতন্ত্রটা বেঁচে থাকে অনন্তকাল। নিজেকে এখন ম্ুিক্তযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। বড় দুঃসময় চলে এসেছে। ভুয়া এবং নিতী নৈতিকতা বিহীন অনেক হাইব্রিড মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজে বসে আছে। সত্যিকারের অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে অপমানিত হতে হয় লাঞ্চিত হতে হয়। সুনীল জলদাসদের মতো মুক্তিযোদ্ধারা আজও ঝরাঝীর্ণ বাড়িতে থাকেন। একজন স্বাধীন দেশে একাত্তরের একজন মু্িক্তযোদ্ধা হিসেবে এটা প্রত্যাশা করি না এটার জন্য কি আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম ছি এটা লজ্জার”।
একাত্তরের বীর সেনাদের হৃদয় দিয়ে ভালোবাসুন সম্মান করুন। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কেউ অসম্মান করবেন না। দেশ মা মাটি ও মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসুন। জয় বাংলা ! পটিয়ার বীর সন্তান একাত্তরের প্রিয় বাশার চাচাকে জন্মদিনে নিরন্তর শুভেচ্ছা।

লেখক ও প্রাবন্ধিক