একটি সুন্দর, স্বাস্থ্যকর বিশ্ব গড়ি

161

অমল বড়ুয়া

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার উপর যাপিত জীবনের সুখ নির্ভর করে। এর জন্য প্রত্যেক নাগরিকের চিকিৎসা সুবিধা বা স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। মানুষের জীবনধারণের পাঁচটি মৌলিক উপকরণের মধ্যে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য পরিসেবা অন্যতম। এটা মানুষের মৌলিক অধিকারেরও অন্তর্ভূক্ত। মৌলিক অধিকার শারীরিক ও মানসিক সীমানা সংকোচনকারী বাধা অতিক্রম করে সমতা ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ নিশ্চিত করে নাগরিকদের জীবন মর্যাদাপূর্ণ করে গড়ে তোলে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) এবং ১৮(১) অনুসারে চিকিৎসাসহ জনগণের পুষ্টি উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। বাংলাদেশ সরকার ২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত কল্পে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নের ফলে সরকার প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে অতিমারি কোভিড-১৯ এর প্রাদূর্ভাব ও বিস্তার মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও প্রশংসা লাভ করেছে। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে পুরো বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্চে আর মারা যাচ্ছে। এই সংকটাপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি, ডাক্তার, নার্স, রোগতত্ত¡ ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্যকর্মী, টেকনিশিয়ান, পুলিশ, প্রশাসন, ও স্বেচ্ছাসেবীসহ অনেকে কাজ করছেন। এই ভাইরাসের প্রথম আঘাতে বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যখাত ও বিশ্ব অর্থনীতি। ভাইরাসটি দ্বিতীয় ধাপে তার রূপ পরিবর্তন করে আরো শক্তিশালী মারাত্মক ও প্রাণঘাতি হয়ে মানবজাতির সামনে আর্বিভূত হয়েছে। তাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্যখাতে শৃঙ্খলা রক্ষা করে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত করা। কারণ কোভিড-১৯ মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, কিছু মানুষ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে সক্ষম এবং তারা অন্যদের তুলনায় ভালভাবে স্বাস্থ্যসেবাখাতে প্রবেশাধিকার ভোগ করে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এখনো প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা পাওয়া থেকে দুরে আছে। বিশ্বজুড়ে নিন্ম আয়ের মানুষেরা তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে গলদঘর্ম হচ্ছে। কর্মহীন হয়ে বহু মানুষ দুঃখ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। তারা নিরাপদ পরিবেশ, নিরাপদ পানি, খাদ্য সুরক্ষা হতে বঞ্চিত। তারা স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত। তাই প্রয়োজন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিসেবা ব্যবস্থা। তারই প্রেক্ষিতে ‘একটি সুন্দর, স্বাস্থ্যকর বিশ্ব গড়ি’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস-২০২১ উদ্যাপিত হচ্ছে।
১৯৪৬ সালের ফেব্রæয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ অর্থনীতি ও সমাজ পরিষদ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সম্মেলন ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই বছর জুন ও জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাংগঠনিক আইন গৃহিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রথম সম্মেলনের দিনটিকেই ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব পেশ করা হয়। ১৯৫০ সালে এই প্রস্তাব কার্যকর হয়। সর্বোচ্চ সম্ভাব্য সকল মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কল্যাণময় উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কাজ করছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যপদ লাভ করার পর থেকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এই দিবসটি পালন করে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১২ সালের জরিপ মতে, পৃথিবীতে প্রায় এক কোটি ২৬ লাখ মানুষ অস্বাস্থ্যকর কাজ করার জন্য মারা যান। অর্থাৎ প্রতি চার জনে একজনের মৃত্যু ঘটে এই কারণে। অস্বাস্থ্যকর বায়ু, দুষিত পানি, রাসায়নিক দ্রব্য ইত্যাদি এর জন্য দায়ী। এ সব বস্তু মানুষের শরীরে প্রায় একশ প্রকারের রোগ সৃষ্টিতে সক্ষম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই বিষয়গুলো কমিয়ে আনার ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর।
পুরো বিশ্ববাসীসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে কঠিন সময় পার করছে। বৈশ্বিক মহামারির কবলে পড়ে ইতোমধ্যে পাঁচবার বৈশ্বিকভাবে জরুরি অবস্থা জারি করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এগুলোর মধ্যে ইবোলার প্রাদূর্ভাব নিয়ে দুইবার, জিকা, পোলিও এবং সোয়াইন ফ্লু নিয়ে একবার করে জরুরী অবস্থা জারি করেছিল। কিন্তু এই সকল ব্যাধির মধ্যে করোনা ভাইরাসকেই সবচেয়ে মারাত্মক বলে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এরই মধ্যে সামনে এসেছে করোনার ভিন্ন ভিন্ন ধরন। সম্প্রতি বাংলাদেশেও ব্রিটেন থেকে আসা ছয়জনের দেহে পাওয়া গেছে এ নতুন ভ্যারিয়ান্ট। সংগৃহিত নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে আইইডিসিআর করোনা ভাইরাসের এ নতুন ধরন শনাক্ত করে। বর্তমানে ঝড়ের বেগে বেড়ে চলেছে সংক্রমণ। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী তের কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে; সুস্থ হয়েছে সাত কোটির বেশি এবং মৃত্যু হয়েছে আটাশ লাখের বেশি মানুষের। বিশ্বের ১৭৬টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই মহামারি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই অতিমারী থেকে সুরক্ষার জন্য আমাদের মাস্ক পরিধান করতে হবে, সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, সামাজিক দুরত্ব মেনে চলতে হবে ও জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। নিজের সতর্কতাই আত্ম-সুরক্ষার প্রধান কৌশল।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক