একটি সাদা এপ্রোন আর একটি স্টেথোর হাহাকার

7

ডা. হাসান শহীদুল আলম

(৪র্থ পর্ব)
কর্মস্থলে নারী চিকিৎসকদের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কারনসমূহ বিবৃত হলো : ক] জরুরী বিভাগের পরিবেশ শৃংখলাবদ্ধ রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা না থাকা ঃ হাসপাতালের জরুরী রোগীর সাথে দশ-বারো জন অপ্রয়োজনীয় লোক প্রবেশ করে যাদের একাংশের হুমকী-ধমকী ক্ষমতা দেখাবার প্রবনতা বেড়ে যায়।এমনি বিশৃংখলা দমনের জন্য বা জরুরী বিভাগের পরিবেশ শৃংখলাবদ্ধ রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি আজ পর্যন্ত।জরুরী বিভাগে নারী চিকিৎসককে কিরুপ প্রতিকুল অবস্থায় কাজ করতে হয় সে ব্যাপারে নি¤েœর ফেসবুক স্ট্যাটাসটি দ্রষ্ঠব্য-
‘সিলেট উইমেনস মেডিকেল কলেজের আজকের দুপুরের ঘটনা। ইউরোলজি এর এক প্যাশেন্ট আসলো। ডিউটি ডাক্তারের অনুরোধে আমি গেলাম প্যাশেন্ট রিসিভ করতে। কারণ আমার এডমিশন ছিল। গিয়ে দেখি প্রায় ১৫/১৬ জন ছেলে সাথে আছে। প্যাশেন্ট এর হিসট্রি নিতে নিতে খুব বিনয়ের সাথে বললাম,আপনারা একজন থাকুন, বাকিরা বেরিয়ে যান। একজন বললেন, আমাদের সামনেই ট্রিটমেন্ট দেন। আমি বললাম, প্যাশেন্টকে এক্সপোজ করতে হবে। আর হসপিটালের তো একটা প্রটোকল আছে। তারা বললেন, তারা সবাই থাকবেন এবং সবার সামনেই ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। তারপর এদের মধ্যে একজনের অনুরোধে বাকিরা বেরিয়ে গেলেন। তিনজন দাঁড়িয়ে থাকলেন। প্যাশেন্টকে এগজামিন করতে করতে আবার মানুষ ঢোকা শুরু করলো। আমি তখন বললাম, দেখুন, আপনাদের আমি বার বার বলেছি, আপনারা একজন থাকুন, বাকিরা বেরিয়ে যান।’ যথেষ্ঠ বিনয়ের সাথে বললাম। তখন এদের মধ্যে একজন বললো, ‘তোমার এমডিকে আমি কানে ধরে দাঁড় করাবো। আমি তখন বললাম, কি বললেন আপনি?’ সে বললো, (আঙ্গুল উঁচিয়ে), কিছু বলি নাই, প্যাশেন্ট এর প্রেসিডেন্ট। ট্রিটমেন্ট দাও। আমি বললাম, ‘দেখেন ক্ষমতাধর ব্যক্তির জন্য যে ট্রিটমেন্ট, আপনার প্যাশেন্ট এর জন্যও একই ট্রিটমেন্ট। সবাইকে আমরা একইভাবে ট্রিটমেন্ট দিই এবং সবার জন্য একই নিয়ম। সুতরাং আপনাদের বের হতে হবে।’ এর মধ্যে আমি প্যাশেন্ট এর ব্লাড প্রেশার মাপা শুরু করে দিয়েছি।তখন তিনি আমাকে তুই তুকারি শুরু করলেন। আমি আর সহ্য করতে না পেরে কান্না করতে করতে সিএ, ইনডোর মেডিকেল অফিসার এর রুমে ভাইয়া আপুদের ঘটনা জানাই। তারপর সেই ছেলে আমার পিছন পিছন এসে কোমর থেকে ছুরি দেখিয়ে বললো, ‘তোর সাহস কতো ? লাশ ফেলে দেবো।… বাইরে বের হ একবার।… করে ফেলবো। আমার পা ধরে তোকে মাফ চাওয়া লাগবো… আরো অকথ্য ভাষায় গালাগালি। তারপর সিএ ভাইয়ের গায়ে হাত তোলার উপক্রম করে।এই হলো একজন ডিউটি ডাক্তারের নিরাপত্তার অবস্থা। আমরাও রোজা রাখি। আমাদেরও ক্লান্তি হয়, ক্ষুধা লাগে। কিন্তু প্যাশেন্ট এর প্রতি এসবের কোন আঁচ পড়তে দিই না। এতো ঘটনার মধ্যেও প্যাশেন্ট এর কাগজপত্র শক্ত করে আমার হাতে ধরা ছিল। তার ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়েছে। কোথায় আমাদের নিরাপত্তা? রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে আমরা কতকাল জিম্মি থাকবো (জনৈকা নারী ইন্টার্নী, ডাক্তার প্রতিদিন, ডট কম, ৯-৫-১৯ )?’
খ] উপজেলা পর্যায়ে নারী চিকিৎসকগণ মানহানিকর পরিস্থিতি এবং নির্যাতনের শিকার হন : ‘নবীন ডাক্তারদের একটা বড় অংশ নারী। তাদের পদায়ন হয়ে থাকে ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে। আমরা তাদের কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্ভিগ্ন। কারণ গত কয়েক বছর ধরে পুরুষ ডাক্তারদের সংগে সংগে নারী ডাক্তাররাও রোগীর স্বজন কিংবা এলাকার মাস্তানদের হাতে নিগৃহীত হয়ে আসছেন। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তারা পুলিশ প্রশাসন, চিকিৎসক সংগঠন বা মিডিয়ার পক্ষ থেকে কোন সহযোগীতা পান না। উল্টো ভিকটিমকেই আইনী ব্যবস্থা না গ্রহন করতে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। দেশের অধিকাংশ উপজেলা হাসপাতাল নারীদের কাজ করার অনুপযুক্ত। থাকা-খাওয়ার অবস্থা শোচনীয়। বসার ভাল ব্যবস্থা নেই। টয়লেটগুলো ব্যবহারের অযোগ্য। নারী ডাক্তাররা এগুলি মেনেও নিয়েছেন। তারা শুধু নিরাপত্তাটুকু চান। চাকুরী করতে গিয়ে তাদের যেন অন্ততঃ শারীরিকভাবে লাঞ্জিত হতে না হয়, ধর্ষিত হতে না হয়, প্রাণ দিতে হতে না হয় (যুগান্তর,২১-১২-১৯)।’
গ] নারী চিকিৎসকরা ইভটিজিং এর শিকার হওয়া এবং ইভটিজারদের শাস্তি না হওয়া : ইন্টার্ন নারী চিকিৎসকরা অনেক সময় রোগীর আত্মীয় স্বজনদের বা কখনও কখনও রোগীদের দ্বারা ঈভটিজিং এর শিকার হন। জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের জনৈকা মহিলা ইন্টার্নী চিকিৎসক রোগীর স্বজন কর্তৃক ইভটিজিং দ্বারা অপমানিতা হওয়ায় ও তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ হিসাবে সতীর্থরা ঈভটিজারকে কানে ধরে উঠবস করানোয় তদন্ত কমিটি করা হয় উক্ত চারজন ইন্টার্নী চিকিৎসকের বিচার করার জন্য। কিন্তু ইভটিজারের অপরাধের বিরুদ্ধে কোন তদন্ত কমিটি হয়নি যেহেতু ইভটিজারের বাড়ী তৎকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায়। পরবর্তীতে উক্ত মহিলা ইন্টার্নী চিকিৎসকসহ সতীর্থ ইন্টার্নী চিকিৎসক চারজনের ছয়মাসের জন্য বহিষ্কার আদেশ হলো। কিন্তু ঈভটিজারের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আদেশ হলো না। এর ফলে অপরাধীরা বুঝে নিলো যে, মহিলা চিকিৎসকদের ইভটিজিং করলে কোন শাস্তি পেতে হয় না। এতে অপরাধীরা অপরাধ সংগঠনের জন্য আরো উৎসাহিত হলো।এমনিভাবে ইন্টার্নী চিকিৎসকগণ অনেক সময় রোগীর আত্মীয় স্বজনদের বা কখনও কখনও রোগীদের দ্বারা ইভটিজিং এর শিকার হন যা উপরোল্লিখিত ঘটনায় দেখা যাচ্ছে।
ঘ] হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার ত্রুটিজনিত কারনসমূহ : ১) হাসপাতালে আইন শৃংখলা বাহিনীর সার্বক্ষণিক পাহারা না থাকা, ২) তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে যে কোন প্রকার বিশৃংখলা রোধ করার জন্য সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীর ব্যবস্থা না থাকা, ৩) চিকিৎসক শারীরিকভাবে আক্রান্ত হলে রক্ষা করার কেউ থাকে না বিধায় রোগী, রোগীর স্বজন বা যে কেহ কর্তৃক চিকিৎসককে শারীরিকভাবে হেনস্তা করার সুযোগ পাওয়া, (৪) নারী চিকিৎসকদের চেম্বারে বা হাসপাতালে বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যথাযোগ্য শাস্তি না হওয়াঃ একটি ঘটনায় গ্লাস ভেংগে সেই কাঁচের টুকরা দিয়ে হাত কেটে দেয়া হয়েছে নারী চিকিৎসকের।অপর এক ঘটনায় ধর্ষণে বাধা দেয়ায় খুন হয়েছেন নারী চিকিৎসক।নারী চিকিৎসকরা তাদের কর্মস্থলে বা কর্মস্থলে আসা যাওয়ার পথে যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছে। ফরিদপুরের কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে রোগী মারা যাওয়ায় কর্তব্যরত ইন্টার্নী চিকিৎসক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে রোগীর স্বজনদের দ্বারা লাঞ্ছিত হলে কোন বিচার পাওয়া যায় না।, (৫) নারী চিকিৎসককে নির্মমভাবে মারধর করা ঃ ‘ঢাকার বারডেম হাসপাতালে কোন এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কোন এক এএসপি পুলিশের ইন্ধনে ৬০-৭০ জন মানুষ মিলে ডাক্তারদের বেধড়ক মারধর করে। পালিয়ে টয়লেটে আশ্রয় নেয়া এক নারী চিকিৎসক তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। অনেকগুলো মানুষ মিলে টয়লেটের দরজা ভেংগে তাঁকে বের করে এনে দারুন উন্মাদনায় সবাই মিলে মারধর করে। রাস্তায় ছিনতাইকারী বা চোর ধরা পড়লে যেভাবে অনেক মানুষ মিলে মারধর করে কিছুটা হয়তো তেমনই। এবার সেই নারী চিকিৎসকের জায়গায় কল্পনা করুন সেখানে আপনারই বোন, আপনারই বন্ধু বা আপনারই প্রিয় কোন মানুষের কথা। কোন এক রাতের বেলা ধ্বংসের উন্মাদনায় মত্ত ৬০-৭০ জন মানুষ ধেয়ে আসছে তার দিকে। কোন পথ না পেয়ে অবশেষে টয়লেটের ভিতরে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো সে। কিন্তু মেয়েটির আশা অপূর্ণ রেখেই ভেংগে গেল টয়লেটের দরজা। কিছু লোমশ হাত ধেয়ে আসলো মেয়েটির দিকে। এর প্রতিবাদে যখন বারডেমের চিকিৎসকগণ কর্মবিরতি পালন করলেন তখন সংবাদ মাধ্যমে রোগীদের কষ্টটাই শুধু দেখানো হলো, কিন্তু নিরীহ নির্দোষ মেয়েটির উপর নিমর্ম অত্যাচারের কোন প্রতিবাদ হলো না বা প্রতিবাদ প্রকাশিত হলো না। যার কারণে দর্শক শ্রোতা প্রকৃত সত্য না জেনে চিকিৎসকদের একতরফা দোষারোপ করতে থাকে। (চলবে )
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্ম যৌনরোগে স্নাতকোত্তর
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম