একটি সংগ্রামী জনপদের হাই পাওয়ার চশমার মেধাবী যুবকের গল্প

52

 

বাংলাদেশ জুড়ে কেবলই টলমলে পানি। ছোটবড় অসংখ্য নদী। সেইসব নদীর ক‚লে বুকের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে বিহব্বল; অনিশ্চিত মানুষ।
এই পথে হেঁটে গেছেন মাওলানা মনিরুজ্জামান
এই পথে হেঁটে গেছেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্র-যাত্রামোহন সেন,
এই পথে হেঁটে গেছেন ভাষা সৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম
সেই পথে হেঁটে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা শ্রেষ্ঠ শহিদ মুরিদুল আলম … আমাদের একটা সুখ সাম্যের বাংলাদেশ কায়েম না হওয়া পর্যন্ত … অবিরাম চলতে থাকি, হাঁটতে থাকি।
হাই পাওয়ার্ড চশমার মেধাবী যুবকের গল্প সতীর্থ অভীক ওসমান দক্ষিণ চট্টগ্রাম জনপদের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বরমা বরকলের ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা, মুদিন্নাপুকুর, আবদুল্লার মার মসজিদ, চাঁদখালীর বুক- শঙ্খ পাড়ের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানী মাওলানা ইসলামাবাদী, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র- যাত্রামোহন সেন, ভাষাসৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমকে তার কবিতার ছন্দে এভাবে তুলে এনেছেন। সে চাঁদখালী আর শঙ্খের আঁসুর শোককে শক্তিতে পরিণত করার আহব্বান জানিয়ে একটি গর্বিত জনপদের কথা তুলে এনেছেন।
চট্টগ্রাম শহরের ৪৯ ঘাটফরহাদবেগে আসার আগে যেখানে আমাদের শৈশব কেটেছে সেখানে আমাদের লুকোচুরি খেলা, যেখানে আমাদের ঘেটে ফুল দিয়ে বেলুন ফুটানো, যেখানে আম কুড়ানোর ধুম, ভরা শঙ্খের জোয়ারে সাঁতারকাটা, টেনিস বল দিয়ে ম্যাচ খেলা- সেই ফেলে আসা শৈশবকে এখন ভুলতে পারি নাই। ভুলব কেমন করে?
আমাদের রাজনীতির হাতেখড়ি দক্ষিণ চট্টগ্রাম জনপদের বরমা বরকল এবং পটিয়া থানা কেন্দ্রিক। আমি আমার খালাতো ভাই ওসমান চৌধুরী (বর্তমানে অভীক ওসমান) ইব্রাহীম চৌধুরী, ইলিয়াছুর রহমান চৌধুরী, আবু মুসা চৌধুরী (প্রয়াত), যেদিন বরকল প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হই সেদিন আমরা এই কজন সবার নজর কেড়েছিলাম। সাবই এক সাইজ, দেখতে সুন্দর, হাফ-ফ্যান্ট, সাদা হাফ শার্ট, পায়ে বাটা জুতো মোজা। আমরা শিশু ক্লাস ও ওয়ান ক্লাস। বাড়িতে আমার খালু অর্থাৎ অভীক ওসমানের পিতা ফোরক আহম্মদ মাস্টারের কাছে পড়েছিলাম। সেই কারণে সবাইকে ক্লাস টু শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছিল। বয়স বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সবার। এর কুফল হিসেবে পেশাজীবনে ভোগান্তি সবাইকে কম বেশি পোহাতে হয়েছে। আমাদের স্কুলে যাওয়া এক সাথে, স্কুল থেকে ফেরত এক সাথে। যে যার ঘরে প্রাত্যহিক খাওয়া-দাওয়া করলেও খেলাধুলা করতে হতো নিজেদের মধ্যে। আমরা চৌধুরী পরিবার। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অনেকাংশে বিলুপ্ত হলেও আমাদের পরিবারের গার্ডিয়ানদের শাসন বারণ সবকিছু সামন্ত মানসিকতায় আবর্তিত ছিল।
আমার স্পষ্ট মনে কাছে, আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক আওয়ামী লীগ নেতা তখন গ্রেফতার হন। জেলা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিলো নেত্রী আমেনা বেগমকে। তিনি পূর্ব বাংলার এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে সভা সমাবেশ করেন নাই। সে রকম একটি সভার আয়োজন করা হয়েছিলো বরমা স্কুলের মাঠে। বেলা তিনটায় সভা শুরু হওয়ার নির্দিষ্ট সময়ে আমি ওসমানকে নিয়ে বেলা দুইটার দিকে সভাস্থলে পৌঁছে দেখলাম, সভার জন্য মাইক বাঁধা হচ্ছে, কোনো মঞ্চ তৈরি করার ব্যবস্থা ছিল না। একটি টেবিল এবং কয়েকটি চেয়ার। আর মাঠে কিছু শুকনা খড় বিছানো হয়েছে। এখানে বসবে শ্রোতা। এম এ আজিজ আমেনা বেগমকে নিয়ে সভাস্থলে পৌঁছালেন ঠিক তিনটার সময়। আগে থেকেই উপস্থিত জেলা আওয়ামী লীগের নেতা বরমার সন্তান এ.কে.এম আবদুুল মন্নান, কমার্স কলেজের ছাত্রনেতা আবুল বাসার, নাসির চৌধুরী (আবুল বাসার যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন)। নেতারা সবাই বসে আছেন কোনো, শ্রোতা নেই। এক পর্যায়ে আমি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলতে লাগলাম- আমাদের নেতা শেখ মুজিবসহ অনেক নেতা জেলে। নেতাদের মুক্তির দাবিতে কিছুক্ষণের মধ্যে সভা শুরু হবে। আপনারা ইতঃস্ততভাবে হাঁটাহাঁটি না করে সভাস্থলে বসে পড়ুন। আমাদের নেতা এম.এ. আজিজ ও আমেনা বেগম গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন। এ পর্যন্তই আমার বক্তব্য। এর বাইরে কিছু বলার যোগ্যতা আমার ছিল না।
আমার খালু ফোরক মাস্টার ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করলে আমাদের সকলের পরিবার অভিবাবক শূন্যতা উপলব্ধি করেছিলো। ওসমান তার ছোট ভাই এমরানকে নিয়ে চলে আসে শহরে। তার বেদনার আর্তি এভাবেই প্রতিভাত হয়। (আমি যাচ্ছি, পেছনে রইলো আমার গেরুয়া যুবতী নদী, কিশোর শ্যামল গ্রাম। অইতো আমার নদী শঙ্খ। আমার ভালোবাসা দেখে সখী বলতো ও, আমার সতীন। শঙ্খরে, আমি যাচ্ছি, তোর কথা আমার মনে পড়বে রে। সেই একবার বর্ষার ঢলে ভেসে আসা বাঁশের বাঁশি বানাব বলে সাঁতার দিয়েছিলাম, সে কী দুরন্ত সাঁতার। তবুও বাঁশের নাগাল পাইনি, আমার বাঁশি বানানোও হয়নি। তোর ঘাসফুল দিয়ে গড়তাম ফুলের পিরামিড। তোর কেয়া বাগান, কী বন্য সুখ-সুবাস সারা গায় তোর গেরুয়া জলে কালো নৌকা নিয়ে আমরা চলে যেতাম বড় শঙ্খের মোহনায় এরপর কিশোর দাঁড়ায় অঘ্রানের বিস্তীর্ণ মাঠের সামনে।
‘সখী তুই অপেক্ষা করিস। আমি ফের তোর জন্য ফিরে আসব। তোর কাছে গচ্ছিত রেখে গেলাম আমার শঙ্খ নদী, সবুজ গ্রাম, অঘ্রানের রূপসি মাঠ, শীতের কান্না, এই বুড়ো বট, তোর কাছে গচ্ছিত রইল আমার কৈশোরের বিশ্বাস, ভালোবাসা, তুই অপেক্ষা করিস।’) ওসমান ভর্তি হয় কাজেম আলী স্কুলে। আমাদের ছোটবেলার বন্ধুর জুটি এভাবেই ভাঙতে শুরু হয়। ওসমানের পর মুসা চলে গেল কুমিল্লা পুলিশ লাইন স্কুলে। আমি ছিলাম এদের মধ্যে সবচেয়ে ডানপিটে। ক্লাসে দুষ্টুমি-খেলাধুলায় আমি বেশি সময় কাটাতাম। ইলিয়াস, ইব্রাহিম ক্লাসের ভালো ছাত্রের মধ্যে মেধা তালিকায় থাকত। ওসমান কাজেম আলী স্কুলে মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। বলতে গেলে ইব্রাহিম, ইলিয়াছ, ওসমান স্কুলে ভালো রেজাল্ট করে সবার প্রিয়ভাজন হয়েছিলেন। আমি ছিলাম রাজনীতি আর সামাজিকতা নিয়ে। তাতে আমারও কিছু জনপ্রিয়তা ছিল। ওসমান কাজেম আলী স্কুলে অধ্যয়নকালে দেশকৃষ্টি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। সেই সময় কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানায় প্রচুর রাজনৈতিক সচেতন ছাত্র ছিল। আমাদের অগ্রজ প্রতিম আ. জ. ম. ছাদেক, শফি খান, আহম্মদ শফি, মোহাম্মদ ইসমাইল, এজহারুল হক টিপু, জাকারিয়া সবাই ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। আমি-ইলিয়াছ-ইব্রাহিম গ্রামে অবস্থান করেও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। ওসমান গ্রামে আসতো কিছুদিন পর পর। সবাই একত্রিত হলে বিশ্ব পুকুরের ডাব চুরি, শীতকালে খেজুর গাছের রস চুরি করে পান করতাম ভরা জোৎস্নায়।
সত্তর সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আমাদের এলাকায় আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন ডা. এ. বি. এম. ফয়েজুর রহমান। আর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন এম. এ. আজিজ, জহুর আহম্মেদ চৌধুরী ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী (দেশ স্বাধীন হলে তিনিই বাংলাদেশের প্রথম প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী)। আমার এলাকার নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন মুরিদুল আলম (মুক্তিযুদ্ধে শহিদ)। প্রতিরাতে আমরা নির্বাচনী মিছিল বের করতাম একেক একেক পাড়ায় গিয়ে। মাহাফুজুর রহমান টুন্টু ছিলেন সব আয়োজনের উদ্যোক্তা। টুন্টু আওয়াজ তুলত জয় বাংলা, আমরা সমস্বরে সাড়া দিতাম, জয় বাংলা (টুন্টু মুক্তিযুদ্ধে শহিদ)। আমরা আমাদের এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতাম না। আমাদের পাশের নির্বাচনী এলাকা আনোয়ারা, বাঁশখালীতে মনোনয়ন পেয়েছিলেন জাতীয় পরিষদে জনাব আতাউর রহমান খান কায়সার আর প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন পেয়েছিলেন জনাব আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। আতাউর রহমান কায়সার একটা চমৎকার পোস্টার করেছিলেন, পোস্টারে সেøাগান ছিলÑ
এ-তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,
দাড়ি মুখে সারি গান লা শারিক আল্লাহ।
প্রাদেশিক পরিষদে চট্টগ্রামের একটি আসন ছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সবাই বিজয়ী হয়েছিল। আর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বৃহত্তর চট্টগ্রামের সব আসনেই বিজয়ী হয়েছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের দিন আমরা যারা ভোটার হইনি, আমরাই আগে গিয়ে লাইন ধরেছিলাম যেন আমাদের মুরব্বিদের ভোট দিতে কষ্ট হয়। আমাদের জানা ছিল, যারা বয়স্ক তারা সবাই মুসলিম লীগের প্রার্থীকে ভোট দেবে, সে কারণেই এ কৌশল। বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম শহরে আসলে আমরা কয়েকটি সাম্পান রিজার্ভ ভাড়া করে সন্ধ্যায় সাম্পানে চড়তাম। সেই সাম্পান শহরের নতুন চাক্তাইয়ে পৌঁছতো পরদিন সকাল ৮ টায়।
রাতে সাম্পানে হৈ-হুল্লোড় করেছি, আনন্দ করেছি। এরকম করে আমরা শহরের বড় বড় জনসভায় আসতাম। তখন নদীপথ ছাড়া কোনো পথ ছিল না। খুব কষ্ট হতো কিন্তু রাজনীতির নেশার কাছে কষ্টকে কষ্ট মনে হতো না। সভা শেষ হলে ঐ সাম্পানে আবার ফিরে যেতাম। একাত্তরের ১৩ ফেব্রæয়ারি ঘোষণা করা হয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ৩ মার্চ ঢাকায় শুরু হবে। এটা ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে আসছিল যে, শেখ মুজিব ৬ দফার ব্যাপারে কোনো আপোস করবেন না। ১ মার্চ বেলা ১ টায় রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। ১ মার্চ বিকেলে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর চারজন প্রধান নেতার মধ্যে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ.স.ম আব্দুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন। ৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভা ছিল। খোলা জিপে শেখ মুজিব এলেন। শাহজাহান সিরাজ আগের তৈরি করা ইশতেহারটি পাঠ করলেন। এটাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রথম আনুষ্ঠানিক দলিল। শেখ মুজিবের ভাষণ ছিল সংক্ষিপ্ত। তিনি অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে বললেন। আরো বললেন, অনেক কথা বলার ছিল, তবে ৭ তারিখেই আমি বললো।
৭ মার্চের রেসকোর্সের স্মরণকালের জনসভায় শেখ মুজিব এলেন বেলা তিনটায়। তার ১৯ মিনিটের ভাষণটি ছিল নানা দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তবে ঘরে ঘরে দুর্গ দুর্গ গড়ে তোলার আহব্বান জানান এবং যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। জনসভায় তিনি কী বলেছেন, তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তিনি কী বলেননি। ইয়াহিয়া ঢাকায় এলেন ১৫ মার্চ। ২২ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়াÑমুজিব সংলাপ চলতে থাকে। ২৪ মার্চ ৬ টায় আওয়ামী লীগের আলোচক দল ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের সাথে আবার বৈঠক করেন। ঐ বৈঠকে সর্বশেষ যে সংশোধনী প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তা হলো, দেশের নাম হবে কনফেডারেশন অব পাকিস্তান। ইয়াহিয়া ২৪ মার্চ টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলীকে ডেকে অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দেন। ইয়াহিয়ার বক্তব্য ছিল, দেশকে অখÐ রাখার জন্য কয়েক হাজার মানুষ মারতে হলেও এটা খুব একটা মূল্য নয়। ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ সন্ধ্যার ৭টায় গোপনে ঢাকা ছেড়ে যান। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যরাতে সামরিক অভিযান শুরু হয়। রাত ৯ টার পর থেকে সামরিক হামলার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে আসছিল। তবে এটা কত যে ভয়ানক হতে পারে তা নেতারা আঁচ করতে পারেননি। শেখ মুজিব তার সহযোগী আওয়ামী লীগ নেতা ও ছাত্রনেতাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলেন। শেখ মুজিব শেষ কথা বলেন সিরাজুল আলম খান, আ. স. ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজের সঙ্গে রাত ১১টার দিকে।
শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়েছেন, এটা নিশ্চিত ২৫ মার্চ। ২৬ মার্চ ঢাকার পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ হেড কোয়ার্টার আক্রমণ হওয়ার সংবাদে বরমা বরকলের মত দুর্গম এলাকার সাধারণ মানুষ ভীত হয়ে পড়ে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে সকলে। কিন্তু আমরা যারা রাজনৈতিক কর্মী ছিলাম, আমরা ৭ মার্চের ভাষণ থেকে আঁচ করতে পেরেছিলাম একটা মারাত্মক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সে কারণেই আমরা ৮ মার্চ থেকে বরকল স্কুলের মাঠে গাছের ডাল দিয়ে ডামি রাইফেল বানিয়ে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করি। ট্রেনিং-এ এলাকার ছাত্র-যুবকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ডাক্তার গোলাম মাওলাকে সার্বিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
চট্টগ্রাম শহরে ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনী চট্টগাম শহরে পাকসেনাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করছে এবং সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানিদের অস্ত্র খালাস করার প্রক্রিয়া জনগণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে ঈশান আলী মিস্ত্রির হাটে পাকিস্তানিদের গোলাবর্ষণে অনেক শ্রমিক নিহত হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে উত্তাল অবস্থা বিরাজ করছিল। আমরা তখন গ্রামে অঘ্রানের উন্মুক্ত বিল-পাথারী আলপথ ধরে শাহাজাহান ইসলামাবাদীসহ যাচ্ছিলাম, সাথে রেডিও ছিল। আকস্মিক এম. এ. হান্নানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি। এটি বেতার থেকে বার বার প্রচারও করা হয়। পরবর্তীতে এ বেতার কেন্দ্রটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নাম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্প্রস্তুতির একটি ঐতিহাসিক ভ‚মিকা পালন করেছিল। আরো পরে বেতার কেন্দ্রটি কলকাতায় স্থাপন করা হয়। যুদ্ধকালীন ৯ মাস মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ী করার সাহস জোগায় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি করে।
“অকস্মাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। অকস্মাৎ বঙ্গোপসাগরে সুনামীর মতো
ঢেউ ওঠে গেল টান টান করে দাঁড়িয়ে গেল সমগ্র বাংলাদেশ।
নিখিল বাংলাদেশ।

শহর থেকে সকল তরুণ-যুবারা শঙ্খ পাড়ের গ্রামে জড়ো হলো।
বরকল স্কুল মাঠে প্যারেড শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ রাইফেল এসে গেল হাতে।
শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। বরমা বরকলকে কেন্দ্র করে
দক্ষিণÑপূর্ব জনপদ ধরে টেকনাফ মায়ানমার পর্যন্ত অজানা এক সেক্টর
যে সেক্টরের নম্বর এখনও চিহ্নিত হয়নি,
যে সেক্টরের কথা এখনও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি।
পটিয়া, আনোয়ারা, চাঁদপুর গোডাউন, বসরত নগরে সম্মুখ সমর
অনেক অনেক সাকসেসফুল অপারেশন।
(হাই পাওয়ার চশমার মেধাবী যুবকের গল্প।)
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সুযোগ্য সন্তান শাহাজাহান ইসলামাবাদী গোপনে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে লেগে গেলেন। সাথে নিলেন বিমান বাহিনী থেকে ছুটে আসা হাবিবুর রহমান, হাবিলদার আবু, গোলাম মওলাকে। সার্জেন্ট মাহি আলম নামে একজন সৈনিক আমাদের বাড়ির পাশে ইউনাইটেড ব্যাংকের কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা আবু তাহের চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে খবর নিয়ে শাহজাহান সার্জেন্ট আলমকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজ পুরোদমে শুরু করেন। আনোয়ারা, বোয়ালখালী, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, চকরিয়া হয়ে সুদূর টেকনাফ পর্যন্ত এলাকাকে তারা একটি সেক্টর বা অঞ্চল হিসেবে তৈরি করেছিলেন। অস্ত্র জোগাড়ের জন্য শাহজাহান সাহেব, পরবর্তীকালের সার্জেন্ট মাহি আলম আগরতলা গিয়েছিলেন। সেখানে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে যতটুকু সম্ভব অস্ত্র জোগাড় করেছিলেন। শাহজাহান ইসলামাবাদীর সাথে ছিলেন স্থানীয়দের মধ্যে ফেরদৌস খান, আবুল বশর, ছবুর খান, আহাম্মদুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম দিলীপ, হাবিলদার আবু, গোলাম মাওলা, গাউছ মোহাম্মদ, আবু তৈয়ব চৌধুরী, আলমগীর আলম, আবুল খায়ের, আবুল কাসেম, মোজাহেরুল ইসলাম, রফিকুল আলম, ইলিয়াছুর রহমান চৌধুরী, ইব্রাহিম চৌধুরী, ওসমান চৌধুরী, কালাম চৌধুরী, নুরুজ্জমান চৌধুরী, সোলায়মান খান, নওশা মিয়া, আবুল কাসেম বক্কর, মাহমুদুর রহমান, আবুল মঞ্জুর, দেলোয়ার হোসেন, সৈয়দ আলমগীর, আবুল মঞ্জুর শেবন্দী, সৈয়দ আলমগীর, নুরুল হুদা, আনোয়ারার কমান্ডার ইদ্রিস, কমান্ডার লতিফ, বাঁশখালীর সুলতানুল কবির চৌধুরী, ডা. ইউসুফ, মোক্তার আহম্মদ, পটিয়ার নাসির চৌধুরী, আলমাস, আসলাম, রফিক, আহম্মদ নবী, মাহফুজুর রহমান, জিরির বাদশ মিয়া, রুহুল আমিন, আবু তাহের, এমদাদ, মহসিন খান, সেলিম চৌধুরী, অজিত দাস, বোয়ালখালীর ক্যাপ্টেন করিম-সহ অনেকেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। শাহজাহান ইসলামাবাদী দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করলেও ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে যারা দেশে প্রবেশ করেছেন তারা অনেকেই ছাত্রলীগ কর্মী ও নেতা ছিলেন। তারা সকলেই এস.এম ইউসুফের মাধ্যমে যুদ্ধে ট্রেনিং নিয়েছিলেন বিধায় এস.এম ইউসুফের পরামর্শেই যেখানে যার সেখানে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার দরকার সেখানেই অংশ নিয়েছিলেন। আমরা বয়সে কিশোর ছিলাম বলে ওসমান, ইলিয়াস ও আমাকে দায়িত্ব দেয়া হতো অপারেশনপূর্ব রেকি করে আসার জন্য। স্মরণে আসছে রাওলীবাগের বরমা ইউনিয়নের একজন রাজাকারের বাড়ি রেকি করে আসি। পরবর্তীতে এখানে অপারেশন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় কেন্দ্রীয় কমান্ডের সাথে দায়িত্বে ছিলেন আতাউর রহমান খান কায়সার এম.এন.এ, আবু সালেহ এম.এন.এ, আকতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এমপিএ এবং মুরিদুল আলম (যুদ্ধে শহিদ)।
দক্ষিণ চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য অপারেশনের মধ্যে বশরত নগর মাদ্রাসা, জিরি মাদ্রাসা, রাজাকার আব্দুল হাকিমের ঘর, পটিয়া থানা, আনোয়ারা থানা ও ইন্দ্রপোল অপারেশন ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি অপারেশনেই কয়েকজন করে মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছেন। বশরত নগর মাদ্রাসা অপারেশনে সবুর খান গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান। দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ছিল মুক্ত অঞ্চল। কিন্তু মাঝে মাঝে পাকিস্তানি আর্মি ঝটিকা আক্রমণ করত। এই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের চৌধুরী বাড়ির তিনটি পাড়ার প্রতিটি ঘরের সদস্যদের ভ‚মিকা ছিল গৌরবের। বশরত নগর অপারেশনে সবুর খান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলে তার সাথে আরো কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলেন। সেই আহতদের রিক্শায় করে নিয়ে আসা হয়েছিল আমাদের দক্ষিণ বাড়িতে, অর্থাৎ ছোট মিয়ার মায়ের ঘরে। চিকিৎসার জন্য ডা. গোলাম মাওলা-সহ আরো কয়েকজন ডাক্তার প্রাণপণ আহতদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন যা ছিল সেই সময়ে একটি মস্তবড় ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। শুধু তা নয়, শাহজাহান ইসলামাবাদীর স্ত্রী সে সময় সন্তানসম্ভবা ছিল। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে বর্ষার কাদামাটি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে হানাদার বাহিনী প্রতিদিন ঝটিকা আক্রমণ চালাত। এলাকার মানুষ সাংঘাতিকভাবে ভীত থাকত। সেই কারণে শাহজাহানের স্ত্রীকে সন্তান প্রসবের জন্য আশ্রয় দিতে চাচ্ছিল না কেউ। যে কারণে একটি সাম্পান ভাড়া করে একজন ধাত্রীকে সাথে দিয়ে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়। ছোট মিয়ার মা অর্থাৎ আমাদের চাচি শাহাজাহানের স্ত্রীকে সাম্পান থেকে নামিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান আর্মি আমাকে মেরে ফেলুক, কিন্তু এই মেয়েটির সন্তান আমার ঘরে প্রসব করাব। যতদিন সে সুস্থ না হয় সে আমার কাছে থাকবে। এই মহিলার স্বামী ছিল বার্মায়। তিনি ছেলেপুলে নিয়ে কষ্টে সংসার চালাতেন। সেই অক্ষমতাকে উপেক্ষা করে শাহজাহানের স্ত্রীর সেবা করেছিলেন। যে সন্তান সেদিন ভ‚মিষ্ঠ হয়েছিলো শাহজাহান ইসলামাবাদী সেই সন্তানের নাম রেখেছিল গাজী। আমাদের ঘরে একটা নৌকা ছিল। আর্মি আসার খবর পেলে আমি আর ওসমান নৌকাতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভরাট চরে নিয়ে যেতাম। আমরা দিনের বেলায় চরের ক্ষেতের খামারে গিয়ে সময় কাটাতাম। আর রাত হলে মুক্তিযুদ্ধের কাজে লেগে যেতাম। একটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২৫ মার্চের কালো রাত্রির পর এপ্রিলের ১ম সপ্তাহে আমি এবং ওসমান ভারতে চলে যাওয়ার জন্য শহরে এসেছিলাম। ওসমানের পরনে একটি থান কাপড়ের লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। একই ধরনের আমারও, গায়ে পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, মাথায় টুপি। আমরা কালারপুলে সাম্পানে উঠব চাক্তাই আসার জন্য, অনেক লোক তখন অপেক্ষায় ছিল। সবাই আত্মীয়স্বজনের খোঁজে শহরে যাবার চেষ্টায়। সেখানে একজন হিন্দু ভদ্রলোক ছিল। সাম্পানের যাত্রীরা তাকে সাম্পানে উঠতে দিচ্ছিল না। সবাই বলল, তুমি হিন্দু মানুষ তুমি উঠলে তোমার কারণে আমাদেরও মৃত্যু হবে। একথা শুনে হিন্দু ভদ্রলোক কালারপুল ব্রিজের উপর কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমাদের সাম্পান কর্তফুলী নদীতে ঢুকতেই দেখলাম, সারি সারি লাশ। লাশের কারণে সমস্ত এলাকা দুর্গন্ধ হয়ে গেছে। সাম্পানে কেউ কেউ বমি করছিল। আমি আর ওসমান চাক্তাই ঘাট দিয়ে উপরে উঠতেই পাকিস্তান আর্মি আমাদের নাম জিজ্ঞেস করল এবং কলমা জানি কিনা জিজ্ঞেস করল? আমরা বললাম আমরা সাচ্চা মুসলমান। আমরা দুজনে বিড় বিড় করে কলমা পড়ে ফেললাম। ওসমানের সাদা লুঙ্গিতে জয় বাংলা লেখা ছিল কলমের কালি দিয়ে। আর্মির লোক জিজ্ঞেস করল, ইয়া ক্যাহা লেখা হে? আমি চটপট উত্তর দিলাম পাকিস্তান জিন্দাবাদ লেখা হ্যাঁ। হাম পাকিস্তান কা মোহাব্বত কারে। আর্মির লোকজন খুশি হয়ে আমাদের ছেড়ে দিল। ওসমান কে আর কি বলব! শুধু বলেছিলাম, আসার সময় লুঙ্গিটা পাল্টিয়ে আসতে পারলি না ভাই। সে বলল, বাড়িতে কাউকে না বলে পালিয়ে আসছি, লুঙ্গি পাল্টাবার সুযোগ কোথায়? আমরা একরাত মিয়াখান নগরে আমাদের গ্রামের বাড়ির কাজের ছেলের দোকানে মাচার উপর রাত কাটিয়েছিলাম। শুভপুর বাস স্টেশনে এসেও মিরসরাই এর করেরহাট দিয়ে রামগড় বর্ডার পার হওয়ার চিন্তা থাকলেও পথখরচের অভাবে গাড়ি থেকে নেমে যেতে বাধ্য হই। বাধ্য হয়ে আবার গ্রামের পথে যাত্রা শুরু করি। অকৃত্রিম দেশপ্রেম ছাড়া আত্মসর্বস্ব চিন্তা কি মানুষের মাঝে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেরণা ও অসাধারণ বীরত্ব জাগাতে পারে? মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন তারা কেউ ডাক্তার, কেউ প্রকৌশলী, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ্য শিক্ষক, কেউ দেহাতি মজুর, কৃষাণ সকলেই একসঙ্গে যেকোনো পরিবেশে এক সাথে বসে খাদ্যগ্রহণ করেছেন। কতই না দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছেন তারা। আবার একসঙ্গে যুদ্ধযাত্রার পরিকল্পনা করেছেন। একে অন্যের দুঃখের যন্ত্রণার সাথী হয়েছেন। এমন ঘটনাও ঘটেছে, যার বয়স কম ছিল বা নবীন কিশোর-রিক্রুট হতে না পারে ডাক্তারকে ঘুষ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সৈনিক হতে চেয়েছে। মৃত্যুকে বরণ করার জন্য ঘুষ দেওয়ার নজির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে মূর্ত করেছে। এমনও কথা শোনা গেছে, নব পরিণীতা স্ত্রী তার স্বামীকে বলেছেন, দেশ স্বাধীন না করে ফিরে না আসার জন্য। পিতা সন্তানকে যুদ্ধে যেতে অনুপ্রাণিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পাঠিয়েছেন। এরা কেউ বনেদী পরিবারের নন। এরা বুদ্ধিজীবীদের মতো হিসাবি নন। এরা মাতৃমুক্তিপন উজ্জীবিত গ্রামবাংলার দামাল সন্তান। সেই বারুদগন্ধী দিনে বিকৃত মানসিকতার কিছু বুদ্ধিজীবী যাই করুন না কেন, আমাদের আপামর দেশবাসী কিন্তু বিকৃত চিন্তাকে ধারণ করেননি। তারা যেকোনো মূল্যে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে আনার জন্য নিজের দেশপ্রেমকে উজ্জ্বল করেছিলেন। নতুন সৃষ্টি এবং দেশ গড়তে তারা কঠিন ব্রত নিয়েছিলেন। যুদ্ধোত্তর পোড়া মাটিতে শস্যের বীজ বুনেছিলেন। যারা শ্রম বিক্রি করেন, যারা কিছু তৈরি বা উৎপাদন করেন তারাই সমাজ ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ কারিগর। তারা বুঝতে পেরেছিলেন কিন্তু যারা তাদের নিয়ামক তারা সঠিক হাল ধরতে পারেননি।
১৯৭৪ সালে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের সময় আমি এবং ওসমান চট্টগ্রাম কলেজের ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত। সে সময় আমরা বিবর্তন নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলে তার মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতাম। চট্টগ্রাম কলেজে বিবর্তন হাজার বছরের বাংলা গান এবং একটি নাটক মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নিলে ওসমানকেই নাটক রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওসমান আমাদের ঘাটফরহাদবেগের বাসায় বসে নাটক লিখলেন তিরোহিত সুন্দর আমার। ’৭৬ সালের ২ জুলাই চট্টগ্রাম মুসলিম ইনিস্টিটিউট হলে জাঁকজমকপূর্ণভাবে নাটক এবং হাজার বছরের বাংলা গান পরিবেশন করা হয়। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক জগতে আমরা আলোচিত হয়ে পড়ি।
উত্তাল টালমাটাল ঢেউয়ের উপর একটি নৌকার মতো তখন দুলছে বাংলাদেশ। সে কোনদিকে যাবে? ঠান্ডা পৃথিবী তখন স্পষ্ট ভাগ হয়ে আছে। পুঁজিবাদ আর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে। সমস্ত ভূখন্ডে চলছে এই দড়ি টানাটানি। কে কাকে কোন্ শিবিরে টানবেন। ছোট এই বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ-নৌকার মাঝি হতবিহব্বল শেখ মুজিব, নানা দোদুল্যমানতার শেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পালে লাগাবেন সমাজতন্ত্রের হাওয়া। কিন্তু তার সমাজতন্ত্রের হাওয়ার রক্তাক্ত দেহ নদীতে ছুড়ে ফেলে নৌকাকে পুঁজিবাদি স্রোতে টেনে নিতে উদ্যত হয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক। দৃশ্যপটের মাঝে আবিভূত হয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ। নৌকা সমাজতন্ত্রের দিকে যাবে নাকি পুঁজিবাদের দিকে যাবে তা নিয়ে মাথা ব্যাথা ছিল না তার। তিনি চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীর ছোটো একটি দ্বীপের শৃঙ্খলা আর একটি পদ। দৃশ্যপট থেকে সরে গেছেন তিনি। আবির্ভাব হলেন স্বপ্নরাজ কর্নেলের। হাল ঘুরিয়ে তিনি নিতে চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্রের দিকে। ধোঁয়াচ্ছন্ন কোনো সমাজতন্ত্র নয়, কায়েম করতে চেয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। ফলে এই কর্নেলকে মোকাবিলা করার জন্য এবার দেশের বাইরের-ভিতরের যাবতীয় সব শক্তি একত্রিত হয়েছিলেন। যারা চিরতরে সমাজতন্ত্রের নাম বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল সেই সব শক্তি তখন বিপরীতমুখী স্রোতের অনিশ্চিত সাঁতারু জেনারেল জিয়ার ওপর। যার কোনো বিশেষ স্রোতের উপর পক্ষপাতিত্ব নেই। যিনি যখন ফলাফল অস্পষ্ট তখন খানিকটা নিরাপদ দূরত্ব থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আজ্ঞা পালন করলেও চূড়ান্ত করে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন বাঙালির দিকে। কারণ তিনি টের পেয়েছিলেন ভবিষ্যৎ এদিকেই। তেমনি দীর্ঘকাল নিরন্তর তাহেরের দিকে দরজা খুলে রাখলেও শেষ মুহূর্তে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সে দরজায় তাকে তখন ঘিরে রেখেছে আরও পরাক্রমশালী নানা শক্তি এবং তিনি টের পেয়েছিলেন ভবিষ্যৎ সেদিকে। জিয়া তখন একক শক্তি নয়, একটি সম্মিলিত শক্তির প্রতিভ‚। কারাগারে যখন তাহেরের বিচার চলছে তখন তিনি সেরে নিয়েছিলেন সব বোঝাপড়া। জিয়া ইতিহাসকে হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার পরিসমাপ্তির জন্য তৈরি ছিলেন না।
সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে আমরা স্থান পেয়েছি। কিন্তু যে বিরাট প্রত্যাশা নিয়ে এদেশের মানুষ অপরিমেয় ত্যাগ স্বীকার করেছে, সে প্রত্যাশা আজও অপূর্ণ থেকে গেছে। সামরিক স্বৈরশাসনের কারণে অপরাজনীতি ও অপশাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের বেপরোয়া লুণ্ঠন হয়েছে। এজন্য হতাশ হবার কোনো কারণ নেই। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রায় ১৮ কোটি মানুষ নিয়ে আমাদের দেশটাকে গণতান্ত্রিক ধারায় উন্নয়নের একটি নতুন মডেল দাঁড় করাতে হবে। সেই উন্নয়নের পদক্ষেপে সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে সে উন্নয়ন টিকে থাকবে না। পৃথিবীর বহু দেশ উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছাবার পর তাতে ধস নেমেছে। বহু সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অতীতের বিশাল বিশাল সাম্রাজ্য দুনিয়ায় সুদীর্ঘকাল দাপটের সাথে রাজত্ব করবার পর বিলীন হয়ে গেছে। আজকের পৃথিবী তার ব্যতিক্রম হবে না।
সতীর্থ অভীক ওসমান সংগ্রামী জনপদের সন্তান হিসেবে সকল গৌরবের অংশীদার হবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা-রাজনীতিবিদ, লেখক ও পিআরও, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন