একটি লিমেরিকের জন্ম কথা

34

১৪৫৮ সাল। তৎকালীন ত্রিপুরার মহারাজা ধর্ম মাণিক্য খনন করেন এক বিশাল দিঘী। নাম ‘ধর্মসাগর’। আয়তন তেইশ দশমিক এক আট একর। এক চক্কর দিয়েছি। আশ পাশটাও ঘুরেছি। এখন একটু ক্লান্তি-ক্লান্তি লাগছে। ক্লান্তি কি ঘুম আনে ? মনেহয়, আনে।
কাঠ বাদাম গাছের ছায়ায়, শান বাঁধানো বেঞ্চিতে, হেলান দিয়ে বসেছি। ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছে। ঝির ঝিরে বাতাস সেই ঘুমকে আরো উস্কে দিচ্ছে। ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে চোখের পাতা। দূরের কোথাও থেকে বাঁশিরসুর ভেসে আসছে। তা ধীরে ধীরে কাছে আসছে। চোখের পাতা খুললাম। বাঁশির সুর শোনা যাচ্ছে না। বন্ধ করলাম চোখ। আবার বাঁশির সুর। বুঝতে পারছি স্বপ্ন। আমি সেই স্বপ্নকে আরো আপন করে নিলাম।
বংশীবাদককে পেয়ে গেছি। তিনি আর কেউ নন, আমাদের জাতীয় কবি ‘কাজী নজরুল ইসলাম’। তিনি বাঁশি হাতে আমার পাশে বসেছেন। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি।
দুই
আমাদের কথোপকথন শুরু হয়েছে। শুরু করেছেন কবি।
কবি হেসে বললেন – কী দেখ ?
-বাবরি দোলানো মহান পুরুষ।
-শামসুর রাহমান ?
-হ্যাঁ।
-আর ?
-প্রেমিক ও সৈনিক।
-সূত্র কী ?
আপনার কবিতার লাইন। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’।
আর কিছু ?
মানব দরদী সাম্যের কবি। ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান’। আপনি সারা পৃথিবীর পীড়িত বঞ্চিত লাঞ্চিত মানুষের কবি। আপনি বলেছেন- ‘প্রার্থনা করো, যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।’
কবি হাসলেন। বললেন-তোমাকে একটি আবৃত্তি করতে বললে, কোনটি করবে ?
-আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
-তুমি তো ইতিহাসে চলে গেলে! কিছু জানো নাকি ?
– ধূমকেতুতে আপনার ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। রাজদ্রোহের অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আপনি আটক আছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করে পাঠিয়েছেন জেলে। উৎসর্গপত্রে লেখা আছে, “শ্রীমান কাজী নজরুল ইসলাম, স্নেহভাজনেষু”, তারিখ ১০ ফাগ্লূন, ১৩২৯। আপনি সেই গীতিনাট্য হাতে পেয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা, ক্লেশ ভুলে গিয়ে মহানন্দে রচনা করলেন, আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
– বাহ্! চমৎকার বললে। তো গীতি নাট্যটির কোন গান জানো ?
‘জানি না’ – তা বলতে হলো না। কবি নিজ থেকে গেয়ে উঠলেন-
আমরা বাস্তুছাড়ার দল
ভবের পদ্ম পত্রে জল
আমরা করছি টলমল
মোদের আসা যাওয়া শূন্য চাওয়া
নেইকো ফলাফল
আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে কবির দিকে তাকিয়ে আছি।
তিন
কবি হেসে প্রসঙ্গ পাল্টালেন। সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন – তুমি না কি লিমেরিক লিখ ?
আমি মাথা নিচু করে আছি। তিনি মাথায় হাত রেখেছেন ?
মনে পড়ল বাবার শোনানো কথা। তিনি বলতেন – বড় পথ ছোট পথকেও বড় করিয়া দেয়।
নিজেকে খানিক বড় বড় মনে হচ্ছে।
কবি উৎসাহ দিয়ে বললেন – একটি নতুন লিমেরিক শোনাও। আমিশুনি।
ভাবছি। সেই ভাবনায় ঘুরে ফিরে আসছেন কবি। কবির কাছের বা প্রিয় কিছু মানুষ। নার্গিস, প্রমীলা। শচীন দেব বর্মণ। কবির সৃষ্টি।
কবিকে নিয়ে একটি লিমেরিক ধরা দিয়েছে। যার নাম হতে পারে ‘কুমিল্লায় নজরুল’।
আমি কবির অনুমতি না নিয়েই বলতে থাকলাম
তুমি পাঁচবার এসেছিলে কুমিল্লায়
গোমতির এপাড় ওপাড় বেঁধেছ হৃদয়ের সুতায়
আছি কান্দির পাড়, ধর্মসাগর
অদূরে শচীন কত্তার ঘর
তোমার ‘প্রলয়উল্লাস’ বাজে হৃদয় বীণায়।
তন্দ্রাটুটে গেছে। কিছুটা ঘোরে আছি। মাথায় ঘুরছে সেই লিমেরিক। কাঁধের ব্যাগ থেকে লেখার খাতা বের করে লিখতে শুরু করেছি।