একটি অগ্নিকাণ্ড এবং আমাদের দায়িত্ববোধ

15

মিয়া জামশেদ উদ্দীন

আমাদের পাশের গ্রাম পেশকারপাড়া। পেশকারপাড়ার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন নুরুল আমিন সাহেব। ওনার একটি ভালো গুণ ছিল, দেখা মাত্রই সালাম দিতেন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে। অর্র্থাৎ অদুর থেকে সালাম দিয়ে চমকিয়ে দিতেন; যদিওবা সমাজে ছোটরা বড়দের সালাম দেয়ার রেওয়াজ রয়েছে। একই সাথে তিনি ভাইসাব, মিয়া সাহেব বলে সম্বোধনসহ কুশলাদি বিনিময় করতেন। অবশ্য চাকরির শেষদিকে পেশকার থেকে অনারেবল ম্যাজিস্ট্রেট পদোন্নতি পান। বিংশ শতকের প্রথম দিকে, ৯০-৯২ বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অবশ্য তাঁর পরিবারের সদস্য সংখ্যা নেহাত কম না, অনেকটা দীর্ঘ বলা যায়। ৫ ছেলে ৬ মেয়ে। তারা সকলে প্রবাসী। সঙ্গে মেয়েদের স্বামী, ছেলেদের বৌ ও তাদের সন্তানসহ শ’ খানেক সদস্য আমেরিকা অবস্থান করছে। একটি পরিবারের প্রবাসের দীর্ঘ তালিকা বা আমেরিকা থাকার ঘটনা বিরল। গ্রামটিতে আমার বড়বোন আনোয়ারা বেগম স্ব-পরিবারে বসবাস করে আসছেন। সঙ্গত কারণে গ্রামটির খোঁজখবর একটি বেশী রাখতে হয়।
সাম্প্রতিক গ্রামটিতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা ব্যথিত করে। ১০ জানুয়ারি গভীর রাতে ভয়াবহ এক অগ্নিকাÐ সংঘটিত হয়। যদিওবা কোনোপ্রকার প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি; নিমিষে ১০০ হাত লম্বা একটি কাঁচা বসতঘরসহ ২টি মুদির দোকান ও একটি চায়ের দোকান আগুনে ভস্মিভূত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি অনেকটা সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসার উপক্রম। খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটির ৬ ভাই একসঙ্গে, এক ঘরে বসবাস করতেন। তাঁরা সকলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি মেঝভাই ইলিয়াছ ও সেজভাই জয়নালের ২টি মুদির দোকান, ছোট ভাই কামালের একটি চায়ের দোকান আগুনে পুড়ে যায়।
অবশ্য বড়ভাই ইব্রাহিম একসময়ে আমাদের বর্গা কৃষক ছিলেন। শুধু এজন্য নয়, মানবিক কারণে দেখতে ছুটে যাওয়া Ñ যেন একটা বিরানভূমি পোড়াভিটা ধূ-ধূ মাঠের মতো পড়ে আছে। তারা একটি সুঁই পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকা ছেড়ে যায়। তবে শঙ্কার কথা হলো, পরিবারটি এতবড় ক্ষতি পুষিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে কি-না? তবুও আশার হাল ছেড়ে দেয়া অমূলক Ñ হয়তো সকলের আন্তরিক ও সহযোগিতায় পরিবারটি আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
তবে এখনো পর্যন্ত পরিবারটি দানশীল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে তেমন একটা সাহায্য সহযোগিতা পায়নি। অথচ ওই পাড়ার সম্মুখে অবস্থিত উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয়। স্বয়ং নির্বাহী কর্মকতা আগুনের দাও-দাও লেলিহান বাসভবন থেকে দেখতে পেয়েছেন; যেখানে স্বচক্ষে ঘটনাটি দেখার বিরল সৌভাগ্য হয়, সেখানে দ্বিতীয় কোন পক্ষ থেকে আবেদন-নিবেদনের প্রয়োজনীয়তা পড়ে না। স্ব-প্রনোদিত হয়ে প্রশাসন সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে; সাথে অগ্নিকাÐ সংঘটিত হওয়ার সূত্রপাত বা ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপনের গাফেলতি খতিয়ে দেখার বিলম্বতার কারণ কি-বা থাকতে পারে; তবে এসব ক্ষেত্রে প্রশাসনের তড়িৎ উদ্যোগ জনেমনে প্রংশসিত হতো। অথচ সেই ক্ষেত্রে প্রশাসন কতটুকু স্বদায়িত্ব পালন করছে, সেটিও দেখার বিষয়।
কিন্তু সেদিনের ফায়ার সার্ভিসের বিলম্বতা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। যথাসময়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে না পৌছায় পরিবারটির অপূরণিয় ক্ষতির সম্মুখিন হয়। রীতিমত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছাঁইভস্ম হয় বাড়িঘর দোকানপাট। অথচ আধা কি.মি. অদুরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স-এর সীতাকুÐের স্টেশনটি অবস্থিত। অথচ সংঘটিতস্থলের সন্নিকটে মহাসড়কের ইউটার্নও রয়েছে। অনায়াসে ২-৩ মিনিটের মধ্যে সংঘটিত স্থলে পৌছা যেত। অবশ্য প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ফায়ার সার্ভিস বাড়বকুÐ হয়ে দক্ষিণ দিক থেকে আসতে দেখেছে তারা। এতে করে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বিলম্ব হয়ে যায়। ফলে আধ ঘণ্টার মধ্যে যা হবার তা হলো; এর মধ্যে গ্রামের ওই সরু রাস্তায় ফায়ারের গাড়ি আটকা পড়ে। এতে করে অগ্নিনির্বাপনের ওই গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌছতে পারেনি। পরে ফায়ারের মাঝারি আকারের দ্বিতীয় গাড়িটিও ঘটনাস্থলে যেতে পারেনি; ওই অবস্থায় ফায়ার ম্যানরা ছুটে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা চালায়। অন্তত আগুনের লেলিহান চতুর্দিকে ছড়িয়ে না পড়ে ফায়ার সার্ভিসের জওয়ানরা প্রাণপণ চেষ্টা চালায়।
এমনিতে গ্রামটি ঘনবসতি, সঙ্গে এলোপাতাড়ি বসতঘর নির্মাণ করায় গিনজিস অবস্থা সৃষ্টি হয়। একটু বিষ্টিতে এলাকাটিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ডেনেজ ব্যবস্থা নেই বললে চলে। রাস্তাঘাটের বেহালদশা।
তবে ফায়ার সার্ভিসের এ গাফেলতির কোনভাবেই মেনে যায় না; এর চাইতে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ফায়ারের জওয়ানদের ঝাপিয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত আছে। ওই সকল ক্ষতিগ্রস্ত ফায়ার ম্যানদের পরিবারকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্র্তৃক যথেষ্ট অর্থ-সহায়তা ও সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়।
এমনতা অবস্থায় রাস্তার ওপর বিদ্যুৎ খুঁটিসহ দোকানপাট নির্মাণ করায় রাস্তাটি সরু হয়ে যায়। অবশ্য রাস্তাঘাটের এই বেহালদশার এজন্য একমাত্র প্রশাসনই দায়ী। আর একথা বলতে মোটেই দ্বিধা নেই; প্রসঙ্গ বলতে পারেন এভাবে প্রশাসনকে ঢালাওভাবে দায়ী করা কী ঠিক হচ্ছে? অবশ্য ওই প্রশ্নবানে বলতে হয়, প্রশাসনের অতি স্ব-নিকটে অবস্থিত এ জনপদ; পাড়াটির ওই রাস্তা নাগ বরাবর সোজা রয়েছে এবং দু’ পাশে পর্যাপ্তপরিমাণ জায়গাও রয়েছে। তাহলে রাস্তাটি সরু বা বাক থাকার কি-বা কারণ থাকতে পারে? যারফলে রাস্তাজুড়ে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে প্রশাসন বরাবরই নিরব ছিল; দেখেও না দেখার ভান করেÑঅনেকটা সরকারকা মাল দরিয়ামে ঢাল অবস্থা। বিষয়টি তৎক্ষণাৎ নজরে নিলে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। অথচ যথা সময়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগটি নেয়া হয়নি।
তবে দৃষ্টান্ত হতে পারতো মডেল হিসেবে পেশকারপাড়া ও দোয়াজীপাড়া গ্রাম। বর্তমানে ওই দু’ পাড়ার অধিবাসীরা চরম দুর্বিষহ অবস্থায় নিমজ্জিত। রীতিমত দুইশ’ বছরের পুরনো পুকুরের ওপর দিয়ে বর্ষণের পানি প্রভাহিত হচ্ছে। এলাকাবাসীরা আরো অভিযোগ করে, কতিপয় ব্যক্তি জোরপূর্বক ইউনিয়নটির (মুরাদপুর) অন্তত ১৪টি কালভার্টের সন্মুখে স্থাপনা ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসে। যারফলে এলাকাজুড়ে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যমান এ অবস্থা সম্পর্কে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও নির্বিকার। এমন কি তাদের কাছে অবহিত অভিযোগেও কোন লাভ হচ্ছে না; একই সাথে খাল, পুকুর ও জলাশয় সমানে ভরাট হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সীতাকুÐে অর্ধশতাধিক পুকুর ভরাট হয়। শুধু সদর পৌর এলাকায় অন্তত ৭টি পুকুর ভরাট হয়। সেটি ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত আছে। তবে এখনো সময় আছে, এসকল ভরাটকৃত পুকুর বা জলাশয় পুনরুদ্ধার করে জনহিতকর স্থাপনা গড়ে তোলতে পারে। বিশেষ করে দাতব্যলয়, শিশুপার্ক, স্কুলের খেলার মাঠ করা যেতে পারে। এটি হলে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে নতুন বার্তা-দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। সঙ্গে অর্থদÐসহ জেল শাস্তির ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ইদানিং আরেকটি পুকুর ভরাট ঘটনা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। সীতাকুÐ পৌরসদর বড়বাজার এলাকায় একটি ভরাট কাজে সচেতন ব্যক্তিরা বাদপ্রতিবাদ করে সাময়িক দুর্বৃত্তায়ন ভরাট কাজ বন্ধ রাখে। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনও সরজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসে। কিন্তু ঘটনাটি যা হলো হিতে বিপরীত হয়। দেখাযায়, দিনের বেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন পরিদর্শন করে, আর রাতের আধারে দুর্বৃত্তরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ওই এক রাতেই পুকুরটির ভরাট না হওয়া অবশিষ্ট চিহ্নটুকুও মুছে দেয়। একযোগে রাতভর ২০-৩০টি ড্রাম ট্রাক মাটি ভরাট কাজে নিয়োজিত হয়। অথচ প্রশাসন বরাবরই নির্লিপ্ত ছিল। অবশ্য ওই ভরাটকৃত পুকুরটির একপাড়ে একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার কার্যালয় রয়েছে। ওই সংস্থাটি দীর্ঘ বছর ধরে এজনপদে পরিবেশ আন্দোলন করে আসছে। তাদের লিগ্যাল এডভাইজার ছিলেন এড. সৈয়দ রিজওয়না হাসান। একটুতে একটু হলেই সংস্থাটির শত শত কর্মী মাঠে নেমে হৈচৈ শুরু করে। অথচ তাদের মাথার ওপর একের পর এক এসব পরিবেশ বিবর্জিত কাজ হচ্ছে, তারাও কেন নিরব-চুপচাপ! তাহলে সংস্থাটি কি এসবে জড়িয়ে পড়লো?
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও জবর দখল চলছে। খোদ উপজেলা প্রশাসনের সন্মুখে সড়ক ও জনপদের জায়গা দখল করে একাধিক বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তোলে। এ অবস্থা বিদ্যমান থাকায় দুর্বৃত্তরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বাড়বকুÐ বিদ্যুৎ অফিসের পাশঘেঁষে এ দৃশ্য বিদ্যমান। রীতিমত বিদ্যুৎ অফিসের ‘টুটি’ চেপে ধরেছে দুর্বৃত্তরা। বিদ্যুতের মতো স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানকেও কোণঠাসা করে ফেলে! জাতিয় গ্রিডের সম্প্রসারণ লেনকে বাকিয়ে স্থাপনা গড়ে তোলে। ওই নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি অনেকটা মহাসড়কের ওপর এসেগেছে। এতেও প্রশাসন নিশ্চুপ। অনেকটা দেখেও না দেখার ভান করছে। তাহলে আইন-শৃঙ্খলা কোথাই গিয়ে দাঁড়িয়েছে? জনগণেরও কি-বা দোষ; বাস্তবিক প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়; প্রশাসন তথা, বিদ্যুৎ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, সড়ক ও জনপদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা বিভাগ, শ্রম মন্ত্রণালয়, বাণিজ্যমন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রণালয়সহ শিল্পমন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র নেয় নক্সা কি এমন বিদ্যমান ছিল? যদি প্রতিষ্ঠানটির নক্সা পরিবর্তন করে চুপিসারে স্থাপনা গড়ে তোলতে চেষ্টা করে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদন বা ছাড়পত্র কেন বাতিল করা হবে না? প্রশাসন কোন স্বার্থে বা লোভের বসবতী হয়ে আশু প্রদক্ষেপ নেবে না?
অর্থনীতিন লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন থেকে আট লেনে উন্নীত করার মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২৯সালে মধ্যে ২৩২ কিলোমিটার মহাসড়কের কাজ শেষ করার হবে। আট লেনের পাশাপাশি ওভারপাস ও বাক অংশ সোজা করার পরিকল্পনাও নেয়া হয়। আর এজন্য ব্যয় ধরা হয় আনুমানিক ৭৩ হাজার ১৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে (২০২৩ইং) এ মহাসড়কের নকশা ও সমীক্ষার কাজ শুরু হবে।

লেখক : কবি, কলামিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক