একজন নূরলদীন ও তাঁর সারাজীবন

125

মোহাম্মদ আবদুস সালাম

সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক হিসেবে পরিচিত। ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতা, শিশু সাহিত্য ও নাটক নিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। দুহাতে লিখে গেছেন অসাধারণ সব লেখা। সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন, প্রচুর গানও লিখেছেন। তবে তাঁর কাব্যনাটক সাহিত্যমোদীদের কাছে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তেমনি একটি কাব্যনাটক হলো ‘ নূরলদীনের সারাজীবন ‘(১৯৮২)। নতুন আঙ্গিকে লেখা এই নাটকে তিনি রংপুর অঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহের ছবিটি বেশ আন্তরিকতার সাথে তুলে ধরেছেন। রংপুরের বেশির ভাগ মানুষ তখন কৃষি কাজ করে জীবন নির্বাহ করতেন। পরিশ্রমের ফসল ঘরে এনে, ডাল ভাত খেয়ে মনের সুখে ভাওয়াইয়া গান গেয়ে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেন। সেরকম একজন নিবেদিতপ্রাণ কৃষক ছিলেন নূরুউদ্দীন মোহাম্মদ বাকের জং। ইংরেজ শাসন উৎখাত করতে গিয়ে তিনি ১৭৬০ থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত বহুবার ইংরেজ সৈনিকদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলার উত্তরবঙ্গে তখন চরমভাবে দেখা দিয়েছে দারিদ্র্য । কৃষকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। অপরদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মানুষের অধিকার খর্ব করে অবৈধ উপায়ে টাকা উপার্জনের পথকে সুগম করেছিল। তাদের ব্যবসা তখন বেশ রমরমা। রাজস্ব ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা ইজারাদারি প্রথা চালু করেন। এই প্রথা চালু হলে চরম দুর্ভোগে পড়েন উত্তরবঙ্গের অসহায় কৃষক। এর মধ্যে ইজারাদারি লাভ করেন রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের অত্যাচারী জমিদার দেবী সিংহ। তিনি কৃষকদের স্বার্থ না দেখে ব্রিটিশদের তোষামোদ করে কৃষকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করেন। তখন নূরলদীনের নেতৃত্বে এক কৃষক স্বার্থ রক্ষা আন্দোলন শুরু হয়। জমিদার দেবী সিংহ এবং কৃষক স্বার্থবিরোধী এই ইজারাপ্রথার বিরুদ্ধে নূরলদীন যুদ্ধ ঘোষণা করলে, রংপুরসহ পুরো উত্তরবঙ্গে বিদ্রোহের সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজদের সাথে রংপুরে তখন একাধিকবার সম্মুখ যুদ্ধে কৃষকবাহিনীর অনেক কৃষক হতাহত হন। পরে পুনরায় ১৭৮২ থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ ১৭৮৩ সালে নূরলদীনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয়। বিশিষ্ট গবেষক, সাংবাদিক আরিফুল হকের এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, যুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষে ১৭৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের বিদ্রোহী প্রজারা লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে জড়ো হতে থাকেন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এই যুদ্ধে বিদ্রোহী প্রজাদের রণকৌশলের কাছে অত্যাচারী জমিদাররা কোণঠাসা হতে বাধ্য হন। ইংরেজ – সমর্থিত জমিদাররা প্রাণভয়ে আত্মগোপন করেন। তখন নূরলদীন খুব সাহসিকতার সাথে বিদ্রোহী কৃষকবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন বিশ্বস্থ লালমনি ও দয়াশীল নামক দুজন সহযোদ্ধা। সেরকম একটি দল পাটগ্রামের মোগলহাটে পৌঁছায়। তখন ইংরেজরা নূরলদীনের এই বাহিনীর তথ্য সংগ্রহের জন্য ইংরেজদের দুজন সৈনিককে কৃষকদের পোশাক পরিয়ে নূরলদীনের বাহিনীর সাথে মিশিয়ে দেন। ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল গোপনে নূরলদীন বাহিনীর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে রাখা।
রংপুর জেলার ইতিহাস পাঠ করে জানা যায়, এক পর্যায়ে নূরলদীন তাঁর দুই সহযোগী লালমনি ও দয়াশীলসহ পুরো বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যুদ্ধ অনেকক্ষণ চলে। এই যুদ্ধে ইংরেজরা অনেকটা ধরাশায়ী। তখন দলে লুকিয়ে থাকা ইংরেজ সৈন্য পেছন দিক থেকে এসে নূরলদীনকে অতর্কিত আক্রমণ করে। নূরলদীন কিছু বুঝে উঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। লালমনিসহ অন্যরা নূরলদীনকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিতে পারলেও যুদ্ধে দয়াশীল নিহত হন। ইংরেজরা নূরলদীনকে হত্যার উদ্দেশ্যে খুঁজতে থাকেন। চরমভাবে আহত নূরলদীনকে সহযোদ্ধারা তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকায় নিয়ে কিছুদিন সেবা শুশ্রূষা করলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেননি। ১৭৮৩ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি নূরলদীন তাঁর ফুলচৌকির নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেখানে তাঁকে দাফন করা হয়। মিঠাপুকুরের ফুলচৌকি গ্রামে মসজিদের প্রধান ফটকের পাশে নূরলদীনের সমাধি সেই অঞ্চলের ইতিহাসকে গৌরবময় করে তোলার অনন্য স্মারক হিসেবে চিরদিন অমøান হয়ে থাকবে।
এই ইতিহাসকে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাটকে স্থান দিয়েছেন শৈল্পিক ব্যঞ্জনায়। যা পাঠককে এখনো ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে উৎসাহিত করে, অনুপ্রেরণা যোগায়। লেখক সাহসী কৃষক নূরলদীনকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, একজন নূরলদীন ২০২১ সালেও উজ্জ্বল হয়ে আছেন ইতিহাসের আলোকবিন্দু হয়ে।
নাট্যকার খুব গৌরবের সাথে যখন নাটকের প্রস্তাবনা অংশে বলে উঠেন-
‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায় ;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায় ;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায় ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।’
তখন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের দুঃসহ জীবন যাপনের চিত্রটি পাঠকের সামনে মূর্ত হয়ে উঠে। দীর্ঘ নয়মাস পূর্ববাংলা যেরকম মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল, ঠিক সেরকম ছিল ১৭৮২-৮৩ সালের রংপুর অঞ্চল। নূরলদীনের ডাকে সাড়া দিয়ে সেই সময় রংপুরের সাহসী মানুষ প্রতিবাদ করেছিল বলে অধিকার আদায়ের পথ কিছুটা হলেও সুগম হয়েছিল।
ঐতিহাসিক চরিত্রকে কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয় সৈয়দ শামসুল হক তা ভালোভাবে জানেন। নূরলদীনের চরিত্রটি তাই তাঁর পছন্দ। নূরলদীনের কণ্ঠে চমৎকার সংলাপ তুলে দিয়ে তাঁকে রংপুরের সাহসী কৃষক নেতা হিসেবে পাঠকের সামনে নিয়ে এসেছেন। নূরলদীন যখন এক পর্যায়ে বলেন –
‘সহ্য না হয় যদি, সহ্য না করেন।
যে লাঠি পড়িয়া আছে তুলিয়া ধরেন।
তুলিয়া ধরেন তবে, হাতোতে’ ধরেন।
হাতোতে ধরিয়া লাঠি, একজোট হন।
একজোট হন সবে, একজোট হন।’
তখন মনে হয়, লেখক ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নূরলদীনের সাহস আর ক্ষোভকে অসামান্য নৈপুণ্যে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন।
লেখকের অসামান্য শিল্পভাবনায় নূরলদীন সংগ্রামী চেতনার মূর্ত প্রতীক হয়ে পাঠক হৃদয়ে ধরা দিয়েছে। ইতিহাসের নায়ক হিসেবে শ্রমজীবী মানুষের, কৃষকস্বার্থ রক্ষার প্রাণপুরুষ হয়ে নূরলদীন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের নেতায় পরিণত হয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হক চেয়েছেন ‘মাটির নায়কদের নিয়ে নাটকের মাধ্যমে কিছু করা’। “নূরলদীনের সারাজীবন” লিখে কবির সেই প্রত্যাশা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পেরেছেন। এই কাব্যনাটকটি লিখে তিনি আশা করেছেন, ‘এই মাটিতে জন্ম নেয়া যেসব গণনায়কদের আমরা ভুলে গিয়েছিলাম তাঁদের আবার সম্মুখে দেখব এবং জানব যে আমাদের গণ- আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের ও বড় মহিমার’। যার সূত্রপাত অনেক আগের, অনেক ত্যাগের।
কবি তাই দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠেন –
‘আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, ‘জাগো,বাহে, কোনঠে সবায়?’
এই আর্তি কখনো ভুলে যাওয়ার মত নয়।
আলোর মিছিলে দাঁড়িয়ে মশাল হাতে নূরলদীনের সেই ডাক এখনো আমাদের কানে বেজে উঠে।
নাটকে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করলেও সাধারণ পাঠককে বিভ্রান্ত হতে হয় না। বরং ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবাই?’ সংলাপটি গণমানুষের বিশেষ শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। যেখানে মুক্তির আকাক্সক্ষায় সাধারণ মানুষের মনের ভেতরে থাকা ছবিটি চমৎকারভাবে উন্মোচিত হয়েছে। কাব্যনাটক কেন লিখেছেন, তা বলতে গিয়ে সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, ‘আমাদের মাটির নাট্যবুদ্ধিতে কাব্য এবং সংগীতেই হচ্ছে নাটকের স্বাভাবিক আশ্রয়।’ সেই বোধ থেকেই লেখক কাব্যনাটক লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
বাঙালির দুঃসময়ে নূরলদীনের মতো সাহসী যোদ্ধারা ছিলেন বলেই বাঙালি তাদের অধিকার আদায়সহ স্বাধীন হতে পেরেছিলেন। বাঙালিরা দীর্ঘদিন সংগ্রামের ফসল ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাট্যে বর্ণিত, দীর্ঘ পথে পাড়ি দেয়া নূরলদীনের মতো সাহসী, ত্যাগী ও আত্মপ্রত্যয়ী নেতাদের নাম বর্তমান প্রজন্মের কাছে সম্মানের সাথে উচ্চারিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।