ঋণখেলাপি ও ব্যাংকের যোগসাজশের বাধা হয়ে দাঁড়াল আদালত

25

নিজস্ব প্রতিবেদক

উত্তরা ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন সিগমা শিপ ব্রেকার্স লিমিটেডের সাত মালিক। তাদের বিরুদ্ধে ২৬ বছর ধরে মামলা পরিচালনা করছে ব্যাংকটি। এ মামলায় খেলাপিদের বিরুদ্ধে আদালত আটকাদেশ দিলে ব্যাংক ও খেলাপিদের সমঝোতার নামে চলে যোগসাজশের আয়োজন। এমনকি প্রায় ৯০ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে ৫ বছরের কিস্তিতে মূল ঋণ শোধের সুবিধা দিয়ে মঞ্জুরিপত্র দিয়েছে ব্যাংক।
ব্যাংকের এমন কাÐ আইনি প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেওয়ার আয়োজন মন্তব্য করে ওই মঞ্জুরীপত্র বাতিলপূর্বক খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনগত পদক্ষেপ জোরদার করার জন্য উত্তরা ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান। আদালতটির বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম পূর্বদেশকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায় ১৯৯৭ সালের বন্ধকী মামলা নং-৫৪/৯৭ এর ডিক্রি মোতাবেক ৩৭ কোটি ৬৬ লাখ ৩৯ হাজার ৫০৭ দশমিক ৯২ টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করার জন্য ডিক্রিদার উত্তরা ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখা অর্থজারি মামলা (৭৭৭/২০০৩) দায়ের করে। ২০০২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এ মামলা দায়ের হয়। ঋণের বিপরীতে বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে বিক্রয়ের মাধ্যমে ডিক্রিকৃত টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হয়ে ডিক্রিদার ব্যাংক অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ এর ৩৪ ধারা মোতাবেক দায়িকগণের বিরুদ্ধে দেওয়ানি আটকাদেশ প্রদানের আবেদন করে। দেওয়ানি আটকাদেশ প্রদানের পর দায়িকগণ ডিক্রিদার ব্যাংকের সাথে সমঝোতার উদ্যোগ নেয়। গত ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর ডিক্রিদার ব্যাংক বিআরপিডি সার্কুলার-১ মোতাবেক ৮৯ কোটি ৬৪ লাখ ৭২ হাজার ৪৭৭ দশমিক ২৩ টাকা সুদ মওকুফ দিয়ে ২৯ কোটি ৩৪ লাখ ৮১ হাজার ১০২ টাকা আদায়যোগ্য দায় পুনর্নির্ধারণ করে মঞ্জুরীপত্র প্রদান করে। মঞ্জুরীপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঋণের বিপরীতে দায়িকের মূল্যবান সম্পত্তি ব্যাংকের নিকট বন্ধক আছে। সর্বশেষ গত বছর ডিক্রিদার ব্যাংকের মূল্যায়ন অনুযায়ী বন্ধকী সম্পত্তির বাজার মূল্য ৪৩.৩৬ কোটি টাকা।
এদিকে দায়িককে প্রায় ৯০ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে ৫ বছরে মূল ঋণ পরিশোধের যে মঞ্জুরীপত্র দিয়েছে তা বিআরপিডি সার্কুলার-১, (তাং- ০৬/০২/২০১৯) এর নির্দেশনার পরিপন্থী বলে মনে করছেন আদালত। এমনকি ওই সার্কুলারে অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের জন্য আইনি প্রক্রিয়া জোরদার করার নির্দেশনা থাকলেও ডিক্রিদার ব্যাংক দায়িককে সুদ মওকুফপূর্বক ৫ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়ে আইনি প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেওয়ার আয়োজন করেছে বলে মন্তব্য আদালতের।
আদালত আরও বলেছেন, ‘অর্থঋণ আদালত আইনের ৪৯ ধারা মোতাবেক ডিক্রিদার ব্যাংক দায়িককে সর্বোচ্চ ৩ বছরে ডিক্রিকৃত টাকা পরিশোধে সম্মতি দিতে পারে। তাই উপরোক্ত মঞ্জুরীপত্র অর্থঋণ আদালত আইনের ৪৯ ধারার পরিপন্থী। ইতোপূর্বে দায়িক কর্তৃক দায়েরকৃত-৫০১৩/২০১৩ নং রিট মামলায় ডিক্রিদার জোরালো আইনগত পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে ৫০১৩/২০১৩নং রিট মামলাটি নিষ্পত্তি হতে ৮ বছর সময় লেগেছে। নালিশি ঋণ হিসাবটি অবলোপনকৃত হিসাব হলেও অবলোপনের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উত্তম চর্চা পরিপালন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। কেননা ঋণের বিপরীতে মূল্যবান সম্পত্তি জামানত আছে। জামানত থেকে ঋণ আদায়ের আইনি প্রক্রিয়া জোরদার না করে ডিক্রিদার ব্যাংক প্রকারান্তরে ঋণখেলাপি দায়িককে সহযোগিতা করেছে। মূল ঋণগ্রহীতা মৃত্যুবরণ করেননি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্যকোনো অনিবার্য কারণবশতঃ ঋণ আদায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়নি। দায়িকের মর্টগেজকৃত সম্পত্তির মূল্য ডিক্রিদার ব্যাংকের মূল্যায়ন অনুযায়ী ৮ গুণ বৃদ্ধি পেলেও ডিক্রিদার ব্যাংকের দাবি ৩৭ কোটি ৬৬ লাখ ৩৯ হাজার ৫০৭ দশমিক ৯২ টাকা থেকে ২১ বছরে ২৯ কোটি ৩৪ লাখ ৮১ হাজার ১০২ টাকায় নেমে আসা ন্যায়সংগত নয়। এক্ষেত্রে ডিক্রিদার ব্যাংক ট্রাস্টি অব পাবলিক মানি হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আইনগত খরচ আদায় সাপেক্ষে সোলেনামা করার বিধান থাকলেও ডিক্রিদার ব্যাংক দায়িকের কাছ থেকে কোনো আইনগত খরচ আদায় করেনি। দীর্ঘ ২৬ বছর মামলা পরিচালনার পর ডিক্রিদার ব্যাংক দায়িকের কাছ থেকে মাত্র ৪ লাখ টাকা আইনগত খরচ নির্ধারণ করেছে। এক্ষেত্রেও ডিক্রিদার ব্যাংক দায়িককে অনুচিত ছাড় দিয়েছে যা গ্রহণযোগ্য নয়।