ঋণখেলাপি আর ব্যাংকের যোগসাজশে চলছে হরিলুট

37

ওয়াসিম আহমেদ

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে দিব্যি দিনাতিপাত করছেন তারা। খেলাপির হাজার হাজার কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার দৃষ্টান্তের দেখা না মিললেও পাচার করে দেশ থেকে পালানোর ঘটনা অহরহ। এসবের নেপথ্যে কারণ কি? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অর্থঋণ আদালতের বেশ কয়েকটা ঘটনা পর্যালোচনা করে মিলেছে ঋণখেলাপি ও ব্যাংকের যোগসাজশের তথ্য। এক্ষেত্রে চক্রটি মর্টগেজ ওভারভ্যালুয়েশন ও মূল ঋণ আদায় না করে সুদ মওকুফ কৌশল ব্যবহার করে। এদেরকে হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল আখ্যা দিয়ে কঠিন শাস্তির আওতায় আনায়ন ও প্রক্রিয়াগত ব্যাপক পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন ব্যাংক বিশেষজ্ঞরা।
নগরীর আলভি এন্টারপ্রাইজ, শিরিন করপোরেশন এবং সিজদা মোটরসের মালিক সুলতানা শিরিন আকতার এবং মো. মোস্তাফিজুর রহমান ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের ঋণখেলাপি। তাদের বিরুদ্ধে সময়মত মামলা না করে উল্টো সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে ব্যাংক। তাই বাদী ওয়ান ব্যাংককে শোকজ করেছেন আদালত। গতকাল বিকালে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান এ শোকজ করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অর্থঋণ আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. রেজাউল করিম। এ খেলাপি দম্পতিকে কেন দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে না তা পাসপোর্টসহ স্বশরীরে আগামী ৮ মার্চ উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একইসাথে মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিশেষ পুলিশ সুপারকে (ইমিগ্রেশন) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মামলার নথি পর্যালোচনা করে জানা যায়, উল্লেখিত তিন প্রতিষ্ঠানের নামে বাদী ব্যাংকের কাছ থেকে আমদানি ব্যবসা পরিচালনার জন্য ঋণ নেয়া হয়। কিন্তু মঞ্জুরীপত্রের শর্ত মোতাবেক বিবাদীগণ ঋণ পরিশোধ না করায় বর্তমানে তাদের কাছে পাওনা ৬০ কোটি ৭৮ লাখ ৩২ হাজার ৯০৪ টাকা ৩৩ পয়সা। বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রচার করলেও কোনো দরপত্র না পাওয়ায় বাদী ব্যাংক ঋণের টাকা আদায় করতে পারেনি। বিবাদীগণ সফলতার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করলেও ব্যাংকের ঋণ ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ পরিশোধ করছেন না। এর মধ্যে গত ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর বিবাদীগণের আবেদনক্রমে পুনঃতপশীলকৃত ৪২ কোটি ১৬ লাখ টাকা ঋণ মাসিক কিস্তিতে ৭ বছরের মধ্যে পরিশোধের জন্য তাদের মঞ্জুরীপত্র দেওয়া হয়। বিবাদীগণ মঞ্জুরীপত্র গ্রহণ করে চার্জ দলিলাদিও সম্পাদন করেন। বাদীর দাখিলকৃত হিসাব বিবরণী অনুযায়ী বিবাদীগণ বিগত ৩ বছরে মাত্র ২ লাখ ২২ হাজার ৯৩ দশমিক ৭০ টাকা পরিশোধ করেছেন। এ ঘটনায় আদালতের পর্যালোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাদী ব্যাংক বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালত আইনের ৪৬ ধারা মোতাবেক যথাসময়ে এই মামলা দায়ের করেনি। মামলা দায়ের যোগ্য হওয়ার ন্যূনতম ২ বছর পর এই মামলা দায়ের করা হয়েছে যা অর্থঋণ আদালত আইনের সুস্পষ্ট লংঘন এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে বাদী ব্যাংকের চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় বলে মন্তব্য করেছেন আদালত। এ ঘটনায় যে সব কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এবং আদালতকে অবহিত করার জন্য ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত ।
শুধু ওয়ান ব্যাংক নয় গত বছরের ২৯ আগস্ট নগরীর শীর্ষ ঋণখেলাপি ইমাম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে খেলাপি হওয়া ঋণের টাকা আদায়ে পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রাইম ব্যাংককে শোকজ করেছিলেন একই আদালত। আরেকটি পৃথক ঘটনায়ও বাদী ব্যাংকের অবহেলার চিত্র উঠে এসেছে। ৩৩ বছরের পুরনো ১ কোটি টাকা ঋণ আদায়ে ২১২ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে জনতা ব্যাংক লিমিটেড। সুদ মওকুফের এ মহোৎসবে দেশে ঋণখেলাপি সংস্কৃতি উৎসাহিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আদালত। সুদ মওকুফের এ সিদ্ধান্ত প্রচলিত ব্যাংকিং নীতিমালার আওতায় স্বচ্ছতার সাথে নেওয়া হয়েছে কিনা তা তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক, চট্টগ্রাম কার্যালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থঋণ আদালত। গত ৫ ফেব্রæয়ারি আদালতটির বিচারক মুজাহিদুর রহমান এ নির্দেশ দেন।
প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রাখবে, তার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আর কোনো কোম্পানি বা কারখানা ঋণ পাবে তার মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পরিমাণ। কিন্তু বন্ধকী সম্পত্তির বাজারমূল্য বহুগুণ বাড়িয়ে ঋণ প্রদান করছে ব্যাংকগুলো। যেটিকে মর্টগেজ ওভারভ্যালুয়েশন বলছেন অর্থনীতিবিদরা। এতে ব্যাংকের একটি চক্র মোটা অংকের ঘুষ বাণিজ্য করে থাকেন। পরিকল্পিতভাবে খেলাপি হওয়ার পর নানা ব্যাংকিং সুবিধা নিয়ে দেশ ছাড়ছেন খেলাপিরা।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনোমিক রিচার্স এর চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. ছৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ পূর্বদেশকে বলেন, ‘এগুলো হলো হোয়াইট কলার ক্রাইম। যারা জড়িত তারা হলো ক্রিমিনাল। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো ওই শ্রেণির মানুষে ভরে গেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ আমার জানা নেই। যদি এর পেছনের কারণ খুঁজতে যান তাহলে বলতে পারি। সুপরিকল্পিতভাবে দেশের ব্যাংক সেক্টর হরিলুট করার জন্য ব্যাংকিং অ্যাক্ট সংশোধন করা হয়েছে। যেখানে ১৩ জন পরিচালকের বদলে চারজন করা হয়েছে। এমনকি একই পরিবারের চারজন হলেও কোনো সমস্যা নেই। টাকা পাচারে এ সময়ে বেশিরভাগ খেলাপি আর ব্যাংকের পরিচালকরা জড়িত থাকার প্রমাণ মিলছে। কিন্তু তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। তাদের বিদেশ চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সমস্যাটি জাতীয়, ক্রাইসিসটি রাষ্ট্রের, তাই উদ্যোগটাও ওই পর্যায় থেকে আসতে হবে। অন্যথায় কিছুই হবে না। ৪শ কোটি টাকা ম্যানেজ করতে পারলেই একটি ব্যাংক হবে, মানুষের হাজার কোটি টাকা নিয়ে ব্যাংকে হরিলুট চলবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যাংক পরিচালককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে না প্রক্রিয়া ঠিক করা হচ্ছে, না অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এগুলো মূলত একেকটি সেক্টর লুট করার সিস্টেম। শেয়ার বাজার লুট হয়েছে, এখন ব্যাংক চলছে। সঠিক উদ্যোগ না হলে সামনে আরও অনেক সেক্টরে লুটের ফাঁদ পেতে রাখবে লুটেরারা।’