উৎস ও ক্রেতা-বিক্রেতার সন্ধান মিলবে তো?

29

শহীদুল ইসলাম বাবর, সাতকানিয়া

মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে ইয়াবার ট্যাবলেট। দেশে প্রবেশের পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক, পেকুয়া-চট্টগ্রাম সড়ক ছাড়াও নৌ পথ ব্যবহার করে সারা দেশে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে মাদক কারবারীরা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইয়াবা পাচার রোধে সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও নৌ-পথে কোস্ট গার্ডের তৎপরতা বাড়ালেও কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না ইয়াবা পাচারকারীদের। মাঝে মধ্যে ইয়াবার ছোট-বড় চালান আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে জব্দ হলেও পাচারের তুলনায় জব্দ হওয়া ইয়াবার সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য বলে মনে করে প্রশাসন। এনিয়ে বেশ ভাবাচ্ছে প্রশাসনকে।
ইয়াবার এই চরম বিস্তারের সময়েই নতুন করে আলোচনায় যুক্ত হয়েছে ‘ক্রিস্টাল মেথ’ বা আইস (ক্ষতিকর মাদক) পাচারের একাধিক ঘটনা উদঘাটনের সংবাদ। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়ার তেমহুনী এলাকায় ২ কেজি আইস নিয়ে এক রোহিঙ্গাসহ ২ জনকে আটক করে সাতকানিয়া থানা পুলিশ। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দিয়ে নানা কৌশলে ইয়াবার পাচারের ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু হঠাৎ করে ইয়াবার চাইতে শতগুণ ক্ষতিকারক মাদক ‘আইস’ উদ্ধারের ঘটনায় প্রশাসনে চলছে তোলপাড়। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তার সাথে আলাপ করে এমন তথ্য মিলেছে।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক দুইটাার সময় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কেরানীহাটের অদূরে আঁধার মার দরগা নামক স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালিয়ে একটি মিনি ট্রাকের ড্যাসবোর্ডের ভেতর থেকে ২ কেজি ক্রিস্টাল মেথ বা আইস উদ্ধার করে সাতকানিয়া থানা পুলিশ। ২ কেজি আইসের মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এসময় গ্রেপ্তার হওয়া দুই জনের মধ্যে একজন ওই গাড়ির চালক ফয়সাল আহমদ প্রকাশ ফজল (২৯), অন্যজন হেলপার জাহিদ আলম (২০)। এর মধ্যে ফজল কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া কচ্ছপিয়া এলাকার গুরা মিয়ার ছেলে। হেলপার জাহিদ আলম (২০) উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আনজুর হোসেনের ছেলে বলে জানা গেছে।
একজন গাড়ির চালক অন্যজন হেলপার। ধৃত চালক-হেলপারের অর্থায়নে ১০ কোটি টাকার মতো বিশাল অংকের মাদক আইস ক্রয়-বিক্রয় করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয় বলেই পুলিশের ধারণা। তাহলে কারা এই আইস নামের ভয়ানক মাদকের মূল কারবারি? কারা এটি দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে? আর এসব মাদকের ক্রেতারাই বা কারা?- এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা কাজ শুরু করেছেন। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতাও।
সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকারিয়া রহমান জিকু বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া অংশে পৃথক তল্লাশি চৌকি বসিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন অংকের ইয়াবা উদ্ধার করা করা ছিল নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু হঠাৎ করে ২ কেজি আইস উদ্ধারের ঘটনায় নতুন উচ্চতায় পৌঁছল সাতকানিয়া থানা পুলিশ। চট্টগ্রাম বিভাগে ১০ কোটি টাকা সমপরিমাণের আইস উদ্ধারের এই ঘটনাও প্রথম। এর আগে গত ১১ জুলাই নগরীর লালখান বাজার এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪৩০ গ্রাম আইসসহ কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা এলাকার বাসিন্দা নুরুল আবছার (৫২) কে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম ভয়ানক মাদক আইস উদ্ধার হয় গত ২৪ ফেব্রæয়ারি। এই দিন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের শফিউল আলম (৩৪) এবং কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার মো. ইয়াছিন রানা (৫০) কে ১৪০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ বা আইসসহ গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। আফ্রিকা অথবা এশিয়ার কোনো দেশ থেকে ইয়াবার চেয়ে শতগুণ বেশি ক্ষতিকারক মাদক ‘আইস’ দেশে ঢুকেছে বলে ধারণা প্রকাশ করেছিলেন র‌্যাব কর্মকর্তা মেজর মুশফিকুর রহমান।
বিশেষত গত বৃহস্পতিবারে ২ কেজি আইস উদ্ধারের ঘটনায় চলছে প্রশাসনে তোলপাড়। একসাথে ২ কেজি (১০ কোটি) আইসের ব্যবসা করা শুধুমাত্র-চালক হেলপারের দ্বারা অসম্ভব ব্যাপার। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, কারা এই উচ্চ মূল্যের ‘আইস’ দেশে আনছে? আনছেই বা কোন পথে? কারা এই আইস বাণিজ্যের মূল হোতা?
এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করছে জানিয়ে সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুুলিশ সুপার জাকারিয়া রহমান জিকু বলেন, ইয়াবায় এমফিটামিন থাকে পাঁচ ভাগ, আর ক্রিস্টাল আইসে পুরোটাই এমফিটামিন। ইয়াবা শরীরে প্রবেশের পর যতটুকু হরমোনজনিত উত্তেজনা তৈরি করে তার চেয়ে ৫০-৬০ গুণ বেশি উত্তেজনা তৈরিতে সক্ষম ক্রিস্টাল মেথ। এর ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে তিনগুণেরও বেশি। তৈরি করে আত্মহত্যার প্রবণতাও। এই ক্ষতিকর মাদক প্রতিরোধ করতে না পারলে যুব সমাজ ধ্বংস হতে বেশি সময় লাগবে না মন্তব্য করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমরা আইসের উৎস ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সন্ধানে কাজ করছি। কারা এই মাদকে অর্থায়ন করছে সেই প্রশ্নের উত্তরও আশা করি আমরা শীঘ্রই পেয়ে যাব।
এদিকে চট্টগ্রামের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ আইসসহ গ্রেপ্তারকৃত ২ আসামি ফয়সাল আহমদ ফজল ও জাহিদ আলমকে আদালতে সোপর্দ করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় পুলিশ। পরে শুনানি শেষ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সানজিদা জাহান দুই আসামিকে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বলে জানিয়েছেন সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আনোয়ার হোসেন। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে উদ্ধারকৃত আইসের উৎস ও কারা এর সাথে জড়িত তাদের সনাক্ত করা সম্ভব হবে।