‘উসওয়াতুন হাসানাই’-‘সর্বোত্তম মহান আদর্শ’ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

31

এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মানবতার মুক্তির দূত সাইয়্যেদুল মুরসালিন খাতামুননাবিয়ীন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহ ছোবাহানাহু তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন-তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনীর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। তাঁর প্রতিটি কথা, কাজ, অনুমোদন, নির্দেশনা,আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণের বার্তাবাহী। তিনি গোটা মানব জাতির শিক্ষক। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-সর্বগুণে গুণান্বিত একজন শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ। যিনি সমগ্র মানব জাতির জন্য শ্রেষ্ঠতম পথিকৃৎ, যিনি স্র্রষ্টা ও পালনকর্তা আল্লাহপাকের প্রিয়তম রসুল,পেয়ারা হাবীব, বিশ্ব সভ্যতায় যাঁর অবদান সর্বাধিক। যিনি সমগ্র বিশ^ মানবের কল্যানের জন্য প্রেরিত। যাঁর আগমনের অপেক্ষা করেছেন লক্ষাধিক আম্বিয়ায়ে কেরাম যুগযুগ ধরে। যিনি সাইয়্যেদুল মুরসালীন, খাতেমুন নবিয়্যীন, যাঁর দিদার লাভ না হলে ব্যাকুল হতেন ফেরেশতাদের দলপতি হযরত জিব্রাঈল (আঃ),যাঁর দরবারে জিব্রাঈলকে ২৩ বছরে ২৪ হাজার বার হাজির হতে হয়েছে, যিনি আল্লাহপাকের দিদার লাভ করেছেন শবে মে’রাজে। যিনি সর্বপ্রথম মহাশূণ্য পরিভ্রমন করেছেন,সারা বিশ্বেে আজ দুই শত কোটি মানুষ যাঁর অনুসারী। যাঁর আদর্শ মহান,অতুলনীয়,অদ্বিতীয়,চিরস্বরনীয়,চির অনুকরনীয়,চির সংরক্ষিত,চির প্রশংসিত,তিনিই তো সেই অনন্য অসাধারণ “বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম”।
কামলিওয়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন যেমনী বিনয়ী, তেমনি মিষ্টভাষী, অতিরাগের মুহুর্তেও তিনি কোনদিন কাউকে কটুকথা বলেননি। তার মধুময় ব্যবহারে শত্রæও মুগ্ধ হয়ে যেতো। অসতর্ক মুহুর্তেও তার মুখ থেকে কোনদিন মিথ্যা কথা বের হয়নি। সত্যবাদিকতার জন্যই আরববাসীরা তাকে “আল-আমিন” “আস সাদিক” উপাধিতে ভুষিত করেছিল। অভাবগ্রস্থকে তিনি কখনো হতাশ করেননি। নিজে না খেয়েও তিনি গরীব মুসাফির ও ক্ষুধার্তের ক্ষুধা নিবৃত্তি করেন। শত্রæ-মিত্র, স্বজন-পরজন সকলের জন্য তার করুনা সমভাবে বর্ধিত হতো। বিপদের মুহুর্তেও তিনি কোন দিন অসৎ পন্থা অবলম্বন করেননি বা মিথ্যার আশ্রয় নেননি। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন দৃঢ় মনোবল ও অসীম ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি ছিলেন ক্ষমার মূর্ত প্রতীক। তিনি আমাদের জন্য অনুকরনীয় অনুসরনীয় একমাত্র ‘উসওয়াতুন হাসানাই’-‘সর্বোত্তম মহান আদর্শ’। তিনি ছিলেন মানবতার মুক্তির দূত। তাহার আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আসতে পারে ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি।
যাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন ঃ আমি কোনো কস্তরী, কোনো আম্বর এবং কোনো সুগন্ধি বস্তু হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের চেয়ে অধিকতর খুশবুদার পাইনি। যদিও কারও সঙ্গে পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোসাফাহা (করমর্দন) করতেন তবে সমস্ত দিন ঐ ব্যক্তির হাতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মোসাফাহার খুশবু লেগেই থাকতো। আর যদি কখনও কোনো শিশুর মাতায় তিনি হাত বুলিয়ে দিতেন তবে খুশবুর কারণে ঐ শিশু হাজারো শিশুর মাঝে অত্যন্ত সহজে পরিচিত হতো। হায়াতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হযরত আনাসের (রাঃ) গৃহে বিশ্রাম করছিলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মোবারক ঘর্মাক্ত হয়ে উঠল। হযরত আনাসের মাতা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওসাল্লামের দেহ মোবারকের ঘাম একটি শিশিরে পুরে নিচ্ছিলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহ আলায়হে ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন ঃ তুমি কি করছো ? তিনি জবাব দিলেন ঃ হুজুর আমরা এগুলোকে আমাদের সুগন্ধির সঙ্গে মিশ্রিত করবো। কেননা আপনার এই ঘাম সর্বোত্তম সুগন্ধি। ইমাম বোখারী (রঃ) হযরত যাবের (রাঃ) এর সুত্রে “তারীখে কবীর” গ্রন্থে উল্লেখ করেন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি কোনো দলের সঙ্গে কোথাও গমন করতেন, যদি কেউ তাঁর অনুসন্ধান করতো তবে সে শুধু খুশবুর কারনেই তাঁর সন্ধান লাভ করতো। তাই তিনি সেই অপূর্ব বিশ্ময়কর ফুল–“বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম”।
বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ প্রদত্ত ওয়াহির আলোকে মানব সমাজকে ইসলামের দাওআত দেন। ইসলামের আলোকে আলোকিত হয়ে সাহাবিগণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শে ঔদ্বুদ্ধ হয়ে সাহাবিগণ ইসলামের আলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেন।
মহানবী (সা.)-সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তাঁর পবিত্র জন্মও হয়েছে অলৌকিক পন্থায়। তাঁর জন্মে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি,যাঁর স্মরণ সব জাতি,সব যুগে করেছে। কিন্তু কবে এই মহামানব জন্মগ্রহণ করেছেন তা নিয়ে সব আলোচনা রবিউল আউয়াল মাস ঘিরেই হয়ে থাকে। পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল। ইসলামের ইতিহাসে দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যমÐিত। বিশেষত দুটি কারণে ১২ রবিউল আউয়াল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। প্রথমত, সব ইতিহাসবিদের ঐকমত্য বর্ণনা মতে এই দিনেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা:)-লক্ষ-কোটি ভক্ত-অনুরক্তকে এতিম বানিয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত,প্রসিদ্ধ অভিমত অনুযায়ী এই ১২ রবিউল আউয়ালই মহানবী (সা.)-জন্মগ্রহণ করেছেন।
রবিউল আউয়াল। হিজরি (আরবি) বছরের তৃতীয় মাস। এ মাসটি যেসব কারণে বিখ্যাত তা হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেলাদাত (জন্ম),নবুয়ত, হিজরত এবং ওফাত। সবই সংঘটিত হয়েছিল রবিউল আউয়াল মাসে। এ মাস মুসলিমদের কাছে বিশেষ মর্যাদার মাস। যুগে যুগে যেসব মহামানব দুনিয়াতে আবির্ভূত হয়ে অকাতরে নিজের জীবন ও ধন উৎসর্গ করে মানব জাতিকে ইহলৌকিক কল্যাণ ও পরলৌকিক মুক্তির পথ দেখিয়ে পৃথিবীকে ধন্য করেছেন, বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি মানবজাতিকে সত্য পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য ইসলামের আদর্শ ও সত্যবাণী প্রচার করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী এবং রাসূল। তিনি মানুষের আলোর দিশারী।
মেসকাত শরীফে তিরমিযি শরীফের সূত্র থেকে হযরত আব্বাস (রাঃ) এর বিরবণ সংকলিত হয়েছে যে আখেরী জামানার শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন ঃ আমি মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবদুল্লাহর পুত্র, আবদুল মোত্তালেবের পৌত্র। আল্লাহপাক সমগ্র সৃষ্টি জগতের মাঝে আমাকে সর্বোত্তম হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ মানব রুপে সৃষ্টি করেছেন, মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন, আরব এবং আজম। আমাকে উত্তম ভাগ অর্থাৎ আরবের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। আর আরবের মধ্যে কয়েকটি গোত্র রয়েছে। আমাকে উত্তম গোত্র অর্থাৎ কোরাইশ গোত্রে সৃষ্টি করেছেন। আর কোরাইশদের মধ্যেও কয়েকটি বংশ সৃষ্টি করেছেন। আমাকে সর্বোত্তম বংশ বনি হাশেম বংশে সৃষ্টি করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে উত্তম আর বংশের দিকেও আমি সর্বোত্তম সুবহানাল্লাহ।
হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে বিশ্বনবী হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি একবার আমার প্রতি দরুদ পাঠ করে আল্লাহপাক তার প্রতি দশটি রহমত নাজেল করেন এবং তার দশটি গুনাহ ক্ষমা করেন এবং তার দশটি মরতবা বুলন্দ করেন।
হযরত এবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেন যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন ঃ কিয়ামতের দিন সেব্যক্তি আমার সর্বাধিক নৈকট্য লাভ করবে সে যত বেশী পরিমানে আমার প্রতি দরুদ প্রেরণ করবে। হক্কানী ওলামায়ে কেরাম হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন যে দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র নাম শ্রবনের পর প্রথমবার দরুদ পাঠ করা ওয়াজেব। তৎপর সেই মজলিশে যতবার তাঁর মহান নাম শ্রবন করবে ততবার দরুদ পাঠ করা মোস্তাহাব।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের মানুষ। ক্ষমা, উদারতা, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, সততা, সত্যবাদিতা, দয়া, দানে, কাজে কর্মে,আচার-আচরণে, মানবতা ও মহত্তে¡ তিনি ছিলেন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ। আমাদের সকলেরই মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ মেনে চলা উচিত।
বর্তমান সময়ের ঘুণে ধরা অশান্ত, অন্যায়-অবিচার ও অত্যাচারে জর্জরিত পচনশীল সমাজে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর আদর্শ অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। একজন মানুষের জন্য জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি পুরো জীবনের রয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর জীবন থেকে শিক্ষার সবকিছু। এ কারণে রাসুলের আদর্শের কথা, তার শিক্ষার আলোচনা সারা বছরই হয়। তবে রবিউল আউয়াল মাসের প্রতি মুসলিম জাতির ভিন্ন একটি আবেগ ও ভালোবাসা রয়েছে।
আল্লাহর বিশেষ রহমত মহানবীর দুনিয়ায় আগমন। নবী করিম (সা.)-এর আবির্ভাবে মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্ব পরিণত হয় এক বেহেশতি পরিবেশে। তাই তো আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন হে নবী (সা.)! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি বিশ্বজগতের জন্য শান্তি ও রহমতস্বরূপ।
পৃথিবীতে যারাই মহান ও মহৎ গুণের অধিকারী হয়েছেন তাদের সবাই রাসূল (সা.)-এর গুণে গুণান্বিত হয়ে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান হয়েছেন। পরশপাথরের ঘর্ষণে লোহা যেমন স্বর্ণে পরিণত হয় তেমনই রাসূল (সা.)-কে অনুসরণ করার মাধ্যমে মুর্দা দিলগুলো জিন্দা হয়ে যায়,কাফির মোমিন হয়ে যায়।
আসুন আমরা সবাই আখেরীও বিশ্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর বেশী বেশী দরুদ শরীফ পাঠ করি সকলেই পড়ি—আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহতায়ালার পেয়ারা হাবীরের মহব্বতের ফয়েজ আমাদের সকলের হৃদয়ে আসুক। আমীন।

লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড