উপহার

26

ফারাবী হেঁটে চলছে। পেছনে ফিরছে না। তীব্র অপমান সে গায়ে মেখে হেঁটে চলছে। পরাজিত কোন সৈনিকের মতো। অনেক কিছুই তার কল্পনায় চলে আসছে চোখের সামনে। কিন্তু কিছুই সে দাঁড় করাতে পারছে না। মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে কেন সে এতোটা অপমানিত হলো আজ। কি তার অপরাধ? প্রথম দেখায় যাকে কোনকিছু না ভেবে ভালোবেসেছিলো সে আজ তার চরম শত্রু! তিনটি বছরের প্রেমের সম্পর্ককে সে ছুঁড়ে দিয়েছে সবার সামনে।
অথচ আজ তার জন্মদিন! আজ এতোটা না হলেও পারতো।
বিশ জানুয়ারি। ফারাবী ঘুম থেকে উঠলো বরাবরের মতোই। মোবাইলের স্ক্রিনে অনেকগুলো মেসেজ আর কল! স্ক্রিনে তাকাতেই চোখ কপালে উঠে গেল ফারাবীর। আজ তার সব শেষ, রক্ষা নেই কোনমতেই! কল ব্যাক করলো ফারাবী।
এতোক্ষণ কল রিসিভ না করে কি করছিলে? আজকের দিনে কি নতুন করে ঝগড়া চাও তুমি?
গরগর করে কর্কশ কন্ঠে কথাগুলো ওপ্রান্ত থেকে বলল সিলভিয়া। সিলভিয়ার কন্ঠ কিন্তু মোটেও কর্কশ নয়। কিন্তু রাগ করে কথা বললে মনে হয় নষ্ট মাইক্রোফোনে কেউ হাতাহাতি করছে! কল রিসিভ করতে দেরি হলেই প্রায়শই ঝগড়া বেঁধে যায়। আজও ঝগড়া হবে। নিশ্চয়ই হবে। তুমুল ঝগড়া।
ও আল্লাহ! এখন তো ইগনোর করাও শুরু করে দিছো। কোন উত্তরই দিচ্ছো না! কি ব্যাপার ফারাবী?
হতচকিত হয়ে কল্পনা থেকে ফিরে আসলো ফারাবী।
সরি, সিলভিয়া। আসলে রাতে কথা বেশি হয়ে গিয়েছিলো, তাই ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে। মোবাইলের সাউন্ড মিউট করা ছিলো। সরি!
আমার সাথে কথা বললে তো তোমার কথা বেশি হয়ে যায়! যাক, আজকে মাফ করে দিলাম তোমার জন্মদিন বলে! তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি বের হচ্ছি।
আচ্ছা, এক্ষুনি বের হচ্ছি মনি। অনেক ভালোবাসি পাগলী!
হয়েছে, ন্যাকামি করতে হবে না। দ্রæত চলে আসলেই হলো।
মেয়েটা আজ ভালো হয়ে গেছে। জন্মদিন আমাকে বাঁচিয়ে দিলি! এসব ভাবতে ভাবতে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফারাবী। আজ তিন-তিনটি বছর এ মেয়েটির সাথে কাটিয়ে দিয়েছে ফারাবী। অনেকটা গোপনীয় সংসারের মতো। সে প্রথম দেখা, প্রেম। সবকিছুতে সাপোর্ট দিয়ে এসেছিল তার। স্মৃতিগুলো গুছিয়ে ও মনে করতে পারছে না ফারাবী। আনন্দের দিনও বলা যায়। সিলভিয়া বলেছে আজ তার জন্য স্পেশাল একটা গিফট আছে! মেয়েটা এরকমই। প্রতিবারই স্পেশাল বলে ভিন্ন কিছু দিয়ে বসে। গতবারে এক ডজন রঙিন কলম আর নীল একটা ডায়েরি। এর আগে পাঁচটি বই! এবার নিশ্চয়ই পাওয়ার ব্যাংক হবে। সিলভিয়া বলেছিল ফারাবীর একটা পাওয়ার ব্যাংক দরকার। হয়তো সেটাই। যাই হোক, রেডি হয়ে রওনা দিলো সে। ফারাবীর অনেক বন্ধুই আছে। সিলভিয়ারও। সবাইকে এক করেছে সিলভিয়া। সবার সাথে সলিভিয়ার যোগাযোগ হয়। আজকের জন্মদিনটা সে তার মতো করে পালন করবে এটা একবছর আগে থেকে বলা। ফারাবী মনে মনে স্থির করলো, সিলভিয়ার কাছ থেকে জমানো টাকাগুলো চাইবে আজ, তার একটি বাইক দরকার। যেটা দিয়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়াবে দু’জনে। সিলভিয়া প্রথমদিকে লুকিয়ে ডিপিএস করে প্রতিমাসে টাকা জমাতো। কিন্তু একদিন ফারাবী জেনে যায়। তখন হেসেই সিলভিয়া বলেছিল— কাজে লাগবে তাই জমাচ্ছি। আজ ফারাবী সেগুলো চাইবে। পরে না হয় শোধ করে দিবে আস্তে আস্তে। হুট করেই সিলভিয়া বলে বসলো-
ফারাবী দেখো, তোমার সাথে আর সম্পর্ক রাখা যাচ্ছে না। আমি চাইনি কথাটা তোমাকে মোবাইলে বলতে। তাই জন্মদিনে উপহার দিবো বলে এখানে নিয়ে এসেছি! কি যা তা বলছো, সিলভিয়া? আজকের দিনে অন্তত এভাবে বলিও না। মজা নিও না। দেখো, এরকম মজা তুমি আগে কখনো করোনি। সুতরাং আমি সইতে পারবো না কিন্তু।
ফারাবীর কন্ঠ কাঁপছে। যেনো কেউ আঁকড়ে ধরে আছে গলা। জোর করে গলা চেপে ধরেছে। মনে হচ্ছে যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি মোটেও মশকরা করছি না। যা সত্যি তাই বললাম। আমি চাই না আর তর্ক হোক। তুমি চলে যাও আমার সামনে থেকে!
সিলভিয়া!
প্লিজ! সিনক্রিয়েট করতে বাধ্য করিও না।
সবাই চমকে গেলো। যেন মনে হলো সবাই যেটা পরিকল্পনা করছে তার ব্যতিক্রম ঘটলো। সোজা পথ ধরে হেঁটে চলছে ফারাবী! একরাশ ঘৃণা এসে জমলো বুকের মাঝে, নিজের প্রতি। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে তার! দ্বিতীয়বার আর সাহস হলো না সিলভিয়ার দিকে তাকানোর। বন্ধুদেরকেও অদৃশ্য দেখাচ্ছে তার! সোজা হাঁটতে লাগলো। অনুরোধটুকুও করতে দিলে না মেয়েটা! এর আগে এমনটা হয়নি। তাদের সম্পর্কে বিচ্ছেদের কথা কখনোই আসেনি। সূর্য ঠিক মাথার উপর। মনে হলো কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছে এ মুহুর্তে। চারদিকে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে ফারাবী। প্রায় বিশ কদম মতো সামনে এগিয়ে এসেছে সে। তারপর রাস্তা পার হয়ে নিজের বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিবে। না, আজ ফারাবী বাসায় যাবে না। আজ সে বাইরে থাকবে। ব্রিজের মাঝে। কিচ্ছু ভেবে কূল পাচ্ছে না সে। এ মুহুর্তে তার গায়ের ছায়াকেও আপন করে নিতে পারছে না। রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে উঠতে যাবে ঠিক ঐ মুহুর্তে দ্রুতবেগে ছুটে আসা গাড়ির একটা ক্র্যাচ করে শব্দ হলো। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো ফারাবীর মাথা! ছিটকে পড়লো সিলভিয়ার সামনে। সিলভিয়ার চিৎকারে ভারী হয়ে উঠলো আকাশ! কিছুই বলতে পারছে না সে। কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। প্রথমে চিৎকার করলেও এখন একদম চুপ! তার হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে আসলো বাইকের চাবি! বাইকটি সাজিয়ে রাখা আছে ফুটপাতের পাশেই। আরেকটুখানি এগুলেই ফারাবী নিজেই সেটা খেয়াল করতো! তার জন্মদিনের উপহার!