উপকূলের দিকে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’

25

তুষার দেব

পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত নিম্নচাপটি উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে প্রথমে গভীর নিম্নচাপ এবং পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’- এ পরিণত হয়েছে। গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ছ’টায় ঘূর্ণিঝড়টি পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় আবহাওয়া পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। সমুদ্রবন্দরসমূহ এবং উপকূল জুড়ে চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত জারি করা হয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়টি পশ্চিমবঙ্গ হয়ে দেশের উপকূলে আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে। তবে যে শক্তি নিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে, ততটা শক্তিতে আঘাত হানতে পারবে না বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। এরইমধ্যে সিত্রাংয়ের একটি অংশ ভেঙে গেছে। যার ফলে তার শক্তিও অনেকটা কমে যাবে বলে মনে করছেন তারা। প্রসঙ্গত, সিত্রাং থাইল্যান্ডের দেয়া নাম। ভিয়েতনামের ভাষায় যার অর্থ ‘পাতা’।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাউসার পারভীন গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় এ তথ্য জানিয়ে পূর্বদেশকে বলেন, গভীর সমুদ্রে সৃষ্ট নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’- এ রূপ নিলেও এটির একাংশ ভেঙে গেছে। ফলে ঘূর্ণিঝড়টি ক্রমাগতভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে পারছে না। এ কারণে যে গতি ও শক্তি নিয়ে সিত্রাং উপক‚লে আছড়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল, সে শক্তি অনেকটাই কমে যাবে। সিত্রাংয়ের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে এখন পর্যন্ত এটা বলা যায় যে, ঘূর্ণিঝড়টি আগামীকাল মঙ্গলবার দেশের নোয়াখালী, হাতিয়া ও সন্দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এর প্রভাব পড়বে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ ১৯ জেলায়। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসসহ মধ্যভাগে ঝড়-বৃষ্টি হবে।
অপরদিকে প্রতিবেশি দেশ ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, গভীর নিম্নচাপটি মধ্য বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ এ পরিণত হওয়ার পর তা ক্রমশঃ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক বরাবর অগ্রসর হতে থাকবে। আগামীকাল মঙ্গলবার সকালে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ উপক‚ল অতিক্রম করতে পারে। ঘূর্ণিঝড়টি সাগর থেকে স্থলভাগে প্রবেশের সময় বাতাসের গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় একশ’ কিলোমিটারের বেশি। এর প্রভাবে আজ সোমবার থেকেই দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হবে। আজ উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টির সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। আর হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে কলকাতা, হাওড়া ও হুগলিসহ দক্ষিণবঙ্গের বাকি জেলাগুলোতে। বৃষ্টির সঙ্গে বইবে ঝড়ো হাওয়া। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় একশ’ কিলোমিটার।
অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে গতকাল রবিবার রাত আটটায় আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক স্বাক্ষরিত আবহাওয়ার ছয় নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ছয়টায় ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে সাতশ’ ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার উপক‚ল থেকে সাতশ’ ১০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে সাতশ’ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ছয়শ’ ৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপক‚লীয় এলাকায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার বেগে দমকা বা ঝড়ো বাতাস বয়ে যেতে পারে। সেইসাথে ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহ এবং কক্সবাজার উপক‚লকে তিন নম্বর স্থানীয় স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত নামিয়ে তার পরিবর্তে চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ, অমাবস্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপক‚লীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ থেকে সাত ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ¡াসে প্লাবিত হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার প্রস্তুতি সচিবালয়ে ঃ বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড়টির বর্তমান গতিপথ অপরিবর্তিত থাকলে এটি ভারতের ভুবনেশ্বর ও পশ্চিমবঙ্গ উপক‚লে আঘাত হানবে। তবে গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশ উপক‚লেও আঘাত হানতে পারে ঝড়টি। সচিবালয়ে গতকাল রবিবার অনুষ্ঠিত ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতিবিষয়ক জরুরি সভায় এ কথা জানান দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।
দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের এখন যে গতিপথ সেটি পরিবর্তন না হলে ভারতের ভুবনেশ্বর ও পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানবে। আর গতিপথ পরিবর্তন হলে এটি উপকূলের ১৯ জেলার সাতশ’ ৩০ কিলোমিটার এলাকায় আঘাত করবে। ঝড়ের গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ৯০ থেকে একশ’ ১০ কিলোমিটার। প্রতিমন্ত্রী বলেন, গত তিন বছরে যেসব ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তার মধ্যে এটির কভারেজ এলাকা সবচেয়ে বেশি। এটি মোকাবিলায় আমাদের সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আজ সোমবার রাত থেকে আগামীকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যে এটির আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যারি এ্যান’ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় দুইশ’ ৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ছয় মিটার অর্থাৎ ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয় এবং এতে এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এদের বেশিরভাগই নিহত হয় চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের মহেশখালী এবং নোয়াখালীর হাতিয়ায় নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। এর মধ্যে শুধু সন্দ্বীপে প্রাণহানি ঘটে ২৩ হাজার মানুষের। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে কর্ণফুলী নদীর তীরে কংক্রিটের বাঁধ থাকলেও এটি জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের একশ’ টন ওজনের একটি ক্রেন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে স্থানচ্যুত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন ছোট-বড় জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য জলযান নিখোঁজ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক যানও ছিল। ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যারি এন’ ক্যাটাগরি-৪ ঘূর্ণিঝড়ের সমতুল্য। স্থলভাগে ধ্বংসলীলা চালানোর পর ধীরে ধীরে শক্তি হারিয়ে পরদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেই ঘূর্ণিঝড়ের দুঃসহ স্মৃতি উপক‚লের মানুষ আজও ভোলেনি। এখন পর্যন্ত সেটিই চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড়।