উন্নয়নের ছোঁয়া লাগুক সবপ্রাণে

41

অমল বড়ুয়া

পরিবর্তনশীলতাই জগতের নিয়ম। পরিবর্তনের সাথে অভিযোজনের মাধ্যমে প্রাণিক‚ল নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। আর এই পরিবর্তনের আছে দুটি ধারা। একটি হচ্ছে ভালোর দিকে পরিবর্তন আর অপরটি হচ্ছে মন্দ বা খারাপের দিকে পরিবর্তন। দ্বিতীয় পরিবর্তনে সমাজ, দেশ ও সভ্যতার বিকাশ ব্যাহত হয়। তাই সবার আকাঙ্খার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ভালোর দিকে পরিবর্তন। আর এই ভালোর দিকে পরিবর্তনই হল উন্নয়ন। সুতরাং উন্নয়ন হল কোন অগ্রগতি যা কোন অগ্রসরমান অবস্থা বা কোন কিছুর বৃদ্ধি অথবা ব্যাপকতার ফল স্বরূপ প্রাপ্ত হয়েছে। উন্নয়ন হচ্ছে এক অবস্থা বা স্তর থেকে উন্নত এবং কাক্সিক্ষত অবস্থা বা স্তরে উত্তরণ। উন্নয়ন অর্থ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে দেশ তথা জাতিকে আধুনিকায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ দেশের সঞ্চয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, উৎপাদন বৃদ্ধি, জাতীয় আয় বৃদ্ধি এসব নিশ্চিত করা। ভালোর দিকের এই পরিবর্তনের সুফল পায় সাধারণ মানুষ আর এতে পরিবর্তিত হয় তাদের ভাগ্যও। দুরিভূত হয় দারিদ্রতা, খোলে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। কারণ উন্নয়ন হল কোন রাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিকের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য এবং চাহিদা অনুসারে তাদের কর্মে নিয়োজিত করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের উৎপাদনকে লক্ষ্য করে মানবসম্পদ উন্নয়ন ক্ষমতা। বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ তাদের দেশীয় উন্নয়নের জন্য তাদের নিজ দেশের নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করেন এবং সে উদ্দেশ্যে তারা নানাবিধ নীতিমালা আরোপ করেন ও প্রকল্প প্রণয়ন করেন। সত্তরের দশকে উন্নয়ন সম্পর্কে কিছুটা নতুন ধারণা পাওয়া যায়। জনগণের প্রকৃত কল্যাণ সামনে রেখে প্রবৃদ্ধি পুনর্বন্টনের দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাখ্যা দেয়া হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা সত্তরের দশকের উন্নয়নে বলা হলেও মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের কথা বলা হয়নি। জাতীয় আয় যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠির মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয় তবে তাকেই প্রকৃত উন্নয়ন বলা যাবে। তাই উন্নয়ন হল ইতিবাচক উন্নত পরিবর্তনের স্থায়িত্ব। যা জনসাধারণের জীবনে শুধু অথনৈতিক ক্ষেত্রেই না, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রেও একটি টেকসই, দীর্ঘমেয়াদী ও সুদ‚র প্রভাব বিস্তার করে। উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠিকে বিবেচনায় আনতে হবে। এই বৃহত্তর জনগণের মধ্যে যারা অর্থনৈতিকভাবে নিম্ন অবস্থানে আছে, তাদেরকে লক্ষ্য করে পরিকল্পনা করতে হবে। সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের জন্য কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা করলে তাদের মধ্যে যারা একটু ভাল অবস্থায় আছে তারাই লাভবান হয়। সুতরাং পরিকল্পনা করতে হবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অর্থনীতির সবচেয়ে নিম্নস্তরে অবস্থানকারী জনগণের জন্য। টেকসই উন্নয়নের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। আর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন শব্দটির উম্মেষ ঘটেছে একুশ-শতকে। মূলত বৈষম্যের অপনোদনের নিমিত্তে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন শব্দটাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্তর্ভূক্তি শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে সকলের সহযোগে, সকলের সমন্বয়ে। অর্থাৎ ‘কাউকে বাদ না দিয়ে’ বা ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’। সকলকে সঙ্গে নিয়ে ভালোর দিকে পরিবর্তনই হচ্ছে অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-২০৩০ গৃহিত হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, টেকসই পরিবেশ এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এই তিন নীতির পাশাপাশি ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’ এবং সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনকে প্রথমে সেবা দেওয়ায় এসডিজিকে বৈশ্বিক আকাক্সক্ষার সুসংহত এবং সমন্বিত কার্যক্রমে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ রূপকল্প-২০২১-২০৪১ বাস্তবায়নে কাজ করছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের। মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে দুই হাজার পাঁচশত ছুয়ান্ন ডলার। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) বলেছে, ‘২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫টি বড় অর্থনীতির দেশের মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত হবে। সেই সময় বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৪তম। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে ৪১তম বৃহৎ শক্তি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। ১৫ বছর বাংলাদেশ গড়ে ৭ শতাংশের বেশি হারে জিডিপি অর্জন করবে। উন্নয়নের নানান সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। দেশের এই ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের সুফল জনগণ যাতে পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। বিবিএস’র হিসাব-২০১৬ মতে, ২০১০ সালে ৫ শতাংশ গরীব মানুষের আয় ০.৭৮ শতাংশ থেকে কমে ০.২৩ শতাংশ হয়েছে, ৫শতাংশ ধনীর আয় ২৪.৬১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৭.৮৯ শতাংশ হয়েছে। শীর্ষ ১০ শতাংশ মানুষের আয় ৩৫.৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৮.১৬ শতাংশ হয়েছে। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মানুষের আয় কমলেও ১০ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে। ওয়েলথএক্সের ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মতে, বাংলাদেশ ধনীদের দ্রæত সম্পদ বৃদ্ধিতে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে। দেশে আয় বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। তথ্য বলছে, আয় ও সম্পদের বৈষম্য হ্রাস করা না গেলে এসডিজির প্রথম লক্ষ্য দারিদ্র্য দুরিকরণ সম্ভব না। এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে নিয়মিত বিনিয়োগের অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে হবে ৯২৮.৪৮ বিলিয়ন ডলার যার জন্য বছরে গড়ে ৬৬.৩২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত অর্থের দরকার। বিসিএস খানা জরিপ-২০১৬ অনুসারে দেশে দারিদ্র্যের হার ২৪.৩ শতাংশ আর অতি-দরিদ্রের হার ১২.৯ শতাংশ। ২০১৮ সালে এই হার কমে হয় ২২ শতাংশ। দেশের উন্নয়নের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে নগরায়ন। আর নগরায়নের ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে শহরবাসীর সংখ্যা। এই ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নগরবাসীর বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। শহরকেন্দ্রিকতা কমিয়ে গ্রামীণ অবকাঠামো গড়ে তোলে আধুনিক সেবা সুবিধা গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কর্মক্ষম করতে মূলধন, ঋণসহায়তা ও বীমার মতো কর্মসূচিভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আগামী পাঁচ বছরে প্রায় এককোটি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী শ্রমবাজারে অর্ন্তভূক্ত হবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে এই বিশাল শ্রমশক্তিকে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান নিয়োজিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করার পাশাপাশি নারী-পুরুষের বৈষম্যও কমানো জরুরী। শ্রমক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বেতন সমতা, পুষ্টিক্ষেত্রে সমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ সর্বক্ষেত্রে সমতা আনতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবেলায় টেকসই পরিকল্পনা নিতে হবে। যদিও এই জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক বিষয় তবে এর ক্ষতিকর প্রভাব সবার আগে আমরাই ভোগ করব। এই বাস্তবতা বিবেচনায় উপকূলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জানমাল রক্ষায় টেকসই কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। লবনাক্ততা ও বন্যা-সহনীয় ধান উৎপাদনে সহায়তা, উপকূলীয় বনায়ন, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজনের মাধ্যমে জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রাখা যায় এরূপ কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের অগ্রগতিতে একমাত্র বাধা দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে উন্নয়নের সুফল জনসাধারণের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এই দুর্নীতির অপনোদন সম্ভব হলে উন্নয়নের সুফল সরাসরি ভোগ করতে পারবে দেশের জনগণ আর বাংলাদেশের আগামী ৫ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের বেশি অর্জন করা সম্ভব হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট