উদ্যোমী তরুণেরা পাল্টে দিতে পারে নিজ নিজ গ্রামের চেহারা

123

‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য’ দুই হাতে দুই বিপরীতধর্মী বিষয় (দ্রোহ আর প্রেম) নিয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যাঁদের জয় ধ্বনি করার আহবান জানিয়েছেন তাঁরা কারা? তাঁরা আর কেউ নন – তাঁরা তরুণ। আমাদের অহংকার -গৌরবের সর্বোচ্চ শিখরে যাঁদের অবস্থান। এই তরুণেরাই গড়তে পারে, ভাঙতে পারে সমাজের যতো অচলায়তন। সমাজের জন্য হিতকর কাজগুলো তাঁরা যেমন করতে পারে, একইভাবে পারে সমাজের অনিয়ম, অবিচার আর অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে।
অনেকে বলতে পারেন তরুণেরা আবার কী কাজ করবেন? তাঁরা নিজেরাই তো অবক্ষয়ের শেষ ধাপে পৌঁছে ভবলীলা সাঙ্গ করার অপেক্ষায় আছে। এদের কেউ মাদকাসক্ত, কেউ ভবঘুরে, কেউ কালোবাজারি আর কেউ অবৈধ জিনিসপত্র পাচারে জড়িত, কেউ রাজনীতির নামে অপরাজনীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।
তরুণদের নিয়ে সচেতন মানুষের করা নেতিবাচক মন্তব্যগুলো মোটেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আমাদের তরুণ প্রজন্ম এখন যে পথে চলছে তাতে অভিভাবকতো বটেই পাশাপাশি যেকোনো দেশপ্রেমিক মানুষ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন না। কোনো নির্দয়, ন্যুনতম মানবতাবোধসম্পন্ন মানুষ চাইবেন না তাঁর প্রিয়জন ধ্বংসের চূড়ান্ত পথে এগিয়ে যাক। কারণ এরাই পরিবার, সমাজ সর্বোপরি দেশের প্রাণপ্রবাহ। রেললাইন থেকে গাড়ি ছিটকে পড়লে ট্রেনের যাত্রীদের যেমন প্রাণহানির প্রবল সম্ভাবনা থেকে যায়। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে যেমন প্রাণিকূল ছটপট করতে থাকে তেমনি দেশের অক্সিজেনতুল্য তরুণ সমাজ বিপথগামী হলে দেশের যে বারোটা বাজতে পারে তা কারো অজানার কথা নয়। তবে গুটিকয়েক তরুণের অপকর্মের জন্য পুরো তরুণসমাজ দায়ি হতে পারে না। হওয়ারও কথা নয়। এখনো আমাদের দেশে শুভবোধসম্পন্ন তরুণের আধিক্যই বেশি। তা যদি না হতো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধ থেকে শুরু করে সব উন্নয়নের যতগুলো নিয়ামক সবগুলো স্হবির হয়ে পড়ত। আশার কথা, আমাদের তরুণেরা আমাদের বুক নিয়ত স্ফীত, বুককে প্রতিদিন উজ্জ্বল করে চলেছে। যেমনটি করেছে সুদূর অতীতে।
‘এখন যৌবন যার/ মিছিলে যাবার / তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ সত্যই তাই। আমাদের তরুণ সমাজ যে কোনো আন্দোলনে বিলোড়নে, দৈব দুর্বিপাকে এগিয়ে আসতে মোটেই পিছ হয়নি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান – সবশেষে স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং স্বাধীনতা-উত্তর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এদেশের তরুণ সমাজ রেখেছে অগ্রণী ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর মিছিলে এদের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ ভাগেরও বেশি। এমন পরিক্ষিত তরুণ সমাজই তো পারে সমাজকে বদলে দিতে। সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে। এ তরুণ সমাজ যদি তাঁদের পারিপার্শ্বিকতা পর্যবেক্ষণ করে কোনো সমাজ বা গ্রামের উন্নয়নে ব্রতী হয় তাহলে তারা নিঃসন্দেহে সফল হবেন তা নিশ্চিত করে বলা যায়। সবকিছু সরকার করবে, ইউনিয়ন পরিষদ করবে, চেয়ারম্যান-মেম্বাররা করবে এ জাতীয় মানসিকতা কারো হওয়া উচিত নয়। সরকার বা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কে কী কাজ করছে তার জন্য অপেক্ষা না করে আমাদের কাজ আমাদের করার জন্যে আগেভাগে এগিয়ে আসা দরকার।
সমাজের, দেশের, রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের কোনো না কোনো দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের মনে রাখা উচিত নিজেদের সমস্যা আগে নিজেদের সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। তার আগে চিহ্নিত করতে হবে কোন এলাকার কোন সমস্যা? সমস্যাগুলো যত সুস্পষ্ট করা যাবে সমাধানের পথও হবে তত সহজ। এক এক এলাকার এক এক সমস্যা, কোথাও পানীয় জলের, কোথাও স্যানিটেশনের, কোথাও পুকুরে বা দিঘিতে নামার ভালো ঘাট নেই। আর কোথাও শিক্ষার আলো যতটা পৌঁছানোর কথা ততটা পৌঁছে নাই। উপর্যুক্ত সমস্যাগুলো কোনো কোনোটা এককভাবে, কোনোটা সমষ্টিগত সমাধানের পথ খুঁজতে হয়। সবচেয়ে বড়োকথা দশজনের সমস্যাগুলো, দশজনের জন্য হিতকর কাজগুলো এককভাবে সমাধানের পথ না খুঁজে সমষ্টিগত খোঁজাই উত্তম। এতে আনন্দ বেশি। কথায় বলে সবে মিলে করি কাজ/ হারি জিতি নাহি লাজ। আসলেই তাই। সমষ্টিগত কাজের মধ্যে সাফল্যের পাশাপাশি না পারার বেদনাও থাকতে পারে,তবে এতে লজ্জার লেশমাত্র নেই। কাজটি করতে না পারলেও মনে শান্তি থাকবে। কারণ তাতে সবার সম্মিলিত প্রয়াস ছিল, আন্তরিকতা ছিল।
বাংলাদেশে আটষট্টি হাজার গ্রাম, সব গ্রামেই রয়েছে কোনো না কোনো সমস্যা। যেমন দক্ষিণ চট্টগ্রামের হাসিমপুর ইউনিয়নের সিকদারপাড়া গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে গ্রামটির দূরত্ব মাত্র সাড়ে তিনকিলোমিটার। গ্রামটির যোগাযোগ ও আর্থসামাজিক অবস্থা অনেক আগে থেকেই ভালো ছিল। গ্রামে সম্ভান্ত আর অবস্থাপন্ন লোকের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। এরপরও গ্রামের ছিল অনেক সমস্যা। একদল তরুণ-যুবকের মাত্র দশ বছরের নিরন্তর শ্রম আর আন্তরিকতায় গ্রামটি হয়ে ওঠে একটি মডেল। তাঁরা পরিকল্পিত কর্মসূচির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেন অনেকগুলো উদ্যোগ। উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে গৃহহীনদের গৃহনির্মাণ, বিনামূল্যে চোখের ছানি অপারেশন ও লেন্স সংযোজন, খতনা ক্যাম্প, শীতবস্ত্র ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, মসজিদ নির্মাণে সহায়তা, ঈদগাহ ও কবরস্হানের মাঠ নির্মাণ, পুকুরের ঘাট ও ড্রেন নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ ও চারা বিতরণ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা ক্যাম্পসহ অনেকগুলো কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাঁরা পুরো গ্রামটিকে দিয়েছে নতুন রূপ।
সিকদারপাড়া আজ চন্দনাইশের অন্য দশটি গ্রামের কাছে আদর্শ। গ্রামটিকে এ আদর্শরূপে পরিণত করার পেছনে রয়েছে সিকদারপাড়া ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এবং তার নেপথ্য কারিগরদের নিরলস ভূমিকা। এই কার্যক্রমের সাথে সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ বিভিন্নভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন চন্দনাইশের মাননীয় সাংসদ আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র জনাব চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, চন্দনাইশ উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আবদুল জব্বার চৌধুরী, বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক জনাব ডা. শাহাদাত হোসেন প্রমুখ।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার পটভূমি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায়, ১৯০৮ সালে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে আসা কয়েকজন তরুণ গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা দেখে কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করেন। সমাজের জন্য, নিজেদের গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করার ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় সিকদারপাড়া ওয়েলফার ট্রাস্টের। সেই যে শুরু সামাজিক দায়বোধ থেকে ট্রাস্টের যাত্রা দীর্ঘ এক দশক পর দেখা যায় তাঁদের অর্জনের ভান্ডারে সঞ্চিত হয়েছে বেশকিছু উজ্জ্বল পালক। যা তাঁদের অনুপ্রাণিত করবে ভালো কাজের, ভালো উদ্যোগের সহযোগি হতে।
আমরা জানি, মানুষ মানুষের জন্য। আর তাই উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, লক্ষ্য যদি নিবিড় হয় তাহলে যেকোনো মহৎ কাজে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। আসুন আমরাও পাল্টে দিই আমাদের গ্রামকে। শুরু করুন বৃক্ষরোপণের মতো ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তার বীজ বপনের মধ্য দিয়ে কিংবা বাল্যবিবাহের হাত থেকে একটি সুন্দর পৃথিবীকে বাঁচিয়ে কিংবা কন্যাদায়গ্রস্হ একজন পিতাকে শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিকভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে। আমাদের মনে রাখতে হবে হাজার লোকের মেজবান আয়োজনের চেয়ে একটি বিবাহযোগ্য মেয়েকে সুপাত্রস্থ করার মতো দ্বিতীয় কোনো ভালো কাজ এই ইহজগতে হতে পারে না।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক