উদ্যোগ আছে অগ্রগতি নেই পর্যটনে

27

মনিরুল ইসলাম মুন্না

চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও দেশের প্রধান পর্যটন এলাকা হিসেবেও পরিচিত। পাহাড়, টিলা, লেক, সমুদ্র আর বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছগাছালি সমৃদ্ধ এ অঞ্চল পর্যটকদের বরাবরই হাতছানি দেয়। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সম্পদে পরিপূর্ণ অঞ্চল দেশে আর কোথাও নেই। আর এ অঞ্চলের পর্যটন নিয়ে উদ্যোগ থাকলেও অগ্রগতি নেই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খরচ বেশি হলেও সে মানের সেবা নেই। যার কারণে পর্যটন শিল্পে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারছে না।
তবে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, পৃথিবীর যে কোন পর্যটককে আকৃষ্ট করার মত সকল পর্যটন উপাদান বাংলাদেশে বিদ্যমান। অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন কাজ করছে।
জানা যায়, বাংলাদেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বিদেশি পর্যটক খুব একটা দেখা না গেলেও অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। ট্যুর অপারেটরসহ নানা সংস্থার হিসেবে স্বাভাবিক সময়ে বছরে ৭০/৮০ লাখ পর্যটক দেশের মধ্যেই ভ্রমণ করে বা বেড়াতে যায় তাদের পছন্দের জায়গাগুলোতে, যার শীর্ষে আছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত।
ইয়াছিন আরাফাত নামে এক পর্যটকের সাথে কথা বলে প্রতিবেদক। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, আশেপাশের দেশ যেমন- ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল ও থাইল্যান্ডের তুলনায় বাংলাদেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো পর্যটকবান্ধব হলেও এখানে খরচ অনেক বেশি। যেটা আমার কাছে মনে হয়। একই খরচ দিয়ে বাইরের অনেক দেশে ভালোভাবে থাকা যায়। এমনি হয়তো এখন এখানে ভালো রিসোর্ট-হোটেল আছে কিন্তু অন্য দেশের তুলনায় এগুলোতে খরচ বেশি।
বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে এ শিল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছে। করোনা মহামারির সংকট কাটিয়ে অর্থনীতি পুনর্জীবিত ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যে ৫টি সেক্টরকে গুরুত্ব আরোপ করেছেন তার মধ্যে পর্যটন উল্লেখযোগ্য।পর্যটনকেন্দ্রগুলোও পর্যটকদের সকল সুযোগ সুবিধা দিতে প্রস্তুত আছে।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশের পর্যটন নীতিমালার আলোকে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় এই খাতের সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল হয়েছে।
সচেতন মহলের মতে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ বাস্তবায়নে অন্যতম ভ‚মিকা রাখবে পর্যটনশিল্প। টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যটন, সমবায় পর্যটন, গ্রামীণ পর্যটন, সুনীল পর্যটন, কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম ও ভার্চুয়াল ট্যুরিজম উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখবে। যার শুরু হতে পারে বৃহত্তম চট্টগ্রাম থেকে।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাকেন্দ্রিক জনপ্রিয় প্রাকৃতিক স্থান, সমুদ্র সৈকত, ঝরনা, পাহাড়, ইকোপার্ক, নদী, সুফি সাধকদের মাজার, বৌদ্ধবিহার, মন্দির, প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনা পর্যটকদের ভ্রমণ তালিকার কেন্দ্রে থাকে। চট্টগ্রাম জেলার সদর ছাড়া ১৫টি উপজেলায় নানামুখী পর্যটন রয়েছে। এর মধ্যে দ্বীপ উপজেলা উড়িরচর, স›দ্বীপ চট্টগ্রামের বৈচিত্র্যময় পর্যটনের অন্যতম অনুষঙ্গ।
চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরেই রয়েছে ওয়ার সিমেট্রি, সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি), পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, বাংলাদেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, ফয়স’ লেক, ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, হালিশহর খেঁজুরতলা বিচ, বায়েজিদ বোস্তামির মাজার ও ওখানকার শতবর্ষী কাছিম দর্শন, বার আউলিয়াদের বিভিন্ন মাজার, দেড়শ বছরের পুরনো আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার, লালদীঘি মসজিদ, আসকার দীঘি, আগ্রাবাদ ঢেবা, পাহাড়তলি জোড় ঢেবা, চারুকলা ইনস্টিটিউট, শতবর্ষের পুরনো চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, বলুয়ার দীঘি, জিয়া জাদুঘর, নেভাল একাডেমি পর্যটন স্পট, বাটারফ্লাই পার্ক, অভয়মিত্র ঘাট, শাহ আমানত সেতু, কর্ণফুলী নদী, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মিঠাপানির কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন নদী হালদা, পরীর পাহাড়, কোর্ট বিল্ডিং, ডিসি অফিস, বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের আবক্ষ মূর্তি, চট্টেশ্বরী মন্দির, বৌদ্ধবিহার, ডিসি হিল, ম্যানোলা পাহাড়, দেব পাহাড়, দেশের প্রধান সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র- ফিশারি ঘাট, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত শতবর্ষী রেলওয়ে সেতু, সমুদ্র ভ্রমণ, রাণী রাসমনি ঘাট, পাহাড়বেষ্টিত বায়েজিদ লিংক রোড, জাম্বুরি মাঠ, রেলওয়ে যাদুঘর, বিপ্লবী বীরকন্যা প্রীতিলতার স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা, বাটালি পাহাড়, পোর্ট ভিউ, বায়েজিদ ইকোপার্ক, জাতিসংঘ পার্ক, বিপ্লব উদ্যান, টাইগার পাস, চিড়িয়াখানা, একাধিক শিশুপার্ক, মিনি বাংলাদেশ, পর্তুগিজ দুর্গ, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বিভিন্ন শতবর্ষী স্থাপনাসহ বৈচিত্র্যময় সব পর্যটন স্থাপনা। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম শহরের সমুদ্র ও নদীতীরবর্তী স্থানগুলো দিয়ে নির্মিত মেরিন ড্রাইভ সড়ক পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। এসব ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক ঘুরে-বেড়ানোর মত জায়গা।
ঈর্যটকরা জানিয়েছেন, দেশের পর্যটন শিল্পে একটু ভাল হলেই স্পটভিত্তিক ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে সবকিছুর দাম বাড়িয়ে তোলে বলেই পর্যটকদের খরচ প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় সেবা বা বিনোদনের কোন সুযোগ পাওয়া যায় না বলেই বিদেশিরা সাধারণত এখানে আসতে আগ্রহী হয় না।
কিন্তু বাংলাদেশে পর্যটন একটি বিশেষ মৌসুম আর সুনির্দিষ্ট কিছু ইভেন্টভিত্তিক হওয়াকেই অতিরিক্ত দামের প্রধান কারণ বলে অনেকে মনে করেন।
কক্সবাজারের হোটেল ব্যবসায়ী আবুল কালাম পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের এখানে একটা মৌসুমে অনেক বেশি টুরিস্ট আসে। আর অন্য মৌসুমে থাকেই না। সে কারণে পিক সিজনে ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ করে। এখানে যদি সারা বছর বিভিন্ন ট্যুরিজম থাকতো তাহলে এমন হতো না। পশ্চিমা বিশ্বে শীতের সময় টুরিস্টরা অন্য দিকে যায়। আমাদের এদিকে শীতে বেড়াতে যায় বেশি। একইভাবে গ্রীষ্ম বা বর্ষা মৌসুমেও পর্যটক টানার ব্যবস্থা করা যেতো তাহলে অসামঞ্জস্যতা দেখা যেতো না। অর্থাৎ সারা বছরের টাকা এক শীত মৌসুম বা কয়েকটি উৎসবের সময় তুলে নেয়ার মতো ব্যবসায়িক নীতিই দেশের পর্যটনকে ব্যয় বহুল করে ফেলেছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যটনের ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে আছে। এখানে সমতলের পাশাপাশি পাহাড়, সমুদ্র, লেক ও ঝর্ণা রয়েছে। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে খুবই সম্ভাবনাময়।
তিনি আরও বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তা জোরদারে ট্যুরিস্ট পুলিশ সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। পর্যটন খাতে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি সরকার নানাভাবে সহযোগিতা প্রদান করছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় কক্সবাজার বিমান বন্দর সম্প্রসারণের কাজ এগিয়ে চলছে। পাশাপাশি ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার যাতায়াতে রেললাইন স্থাপন করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণের জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত পর্যটকদের সব রকমের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, পর্যটকদের সুবিধার জন্য সব ধরনের কাজ করছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। পাশাপাশি আমাদের পক্ষ থেকেও পর্যটকদের স্বল্প খরচে ভ্রমণ, নিরাপদ আবাসন, যাত্রাপথে নিরাপত্তা প্রদানসহ সকল উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। সরকার ও ব্যক্তি পর্যায়ে নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে।
কক্সবাজারের সাবরাং এ ট্যুরিজম পার্ক তৈরির জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ এ লক্ষ্যে কাজ করছে।
গতকাল ছিল বিশ্ব পর্যটন দিবস। ১৯৮০ সাল থেকে সব দেশে এটি উদযাপন করা হচ্ছে। এবারে বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘Rethinking Tourism’ অর্থাৎ, পর্যটনে নতুন ভাবনা।