উদ্যোগের অভাবে অধরা ২২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি

20

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সব দেশে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার থাকলেও পুরো বাজার কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। এর ফলে অধরাই থেকে যাচ্ছে আরও অন্তত ২২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি উপযুক্ত উদ্যোগের অভাবেই বিশাল রপ্তানি বাজারের সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) গ্র্যাজুয়েশনে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর পর বাংলাদেশকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ফেলে দিতে পারে। তবে গবেষণায় আশার আলো দেখাচ্ছে, উদার বাজার ব্যবস্থা ব্যবহারের সুযোগ পেলে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে বাংলাদেশ বার্ষিক ২২ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে।
ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান এবং চীন অতিরিক্ত পরিমাণের সম্ভাব্য বাজারের মধ্যে রয়েছে, যা দেশের বর্তমান রপ্তানি আয়ের অর্ধেকেরও বেশি। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সাথে এফটিএ করার চিন্তা করতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া প্রতিটি দেশ তার বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিচ্ছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে বাংলাদেশ এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না। এছাড়া একক পণ্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং মান সনদ নিশ্চিত করার অপর্যাপ্ত ব্যবস্থার কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতামূলক অগ্রগতি হারাচ্ছে বাংলাদেশ। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন শুল্কমুক্ত সুবিধার ক্ষতির পরে বাংলাদেশকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ফেলতে পারে বলেও তারা জানান। খবর বাংলানিউজের
তারা আরও জানান, দেশের প্রধান রপ্তানি গন্তব্যে অপ্রকাশিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হওয়ার দুটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমটি হলো- দেশের রপ্তানি ঝুড়ির বৈচিত্র্যহীনতা এবং দ্বিতীয়টি- পণ্যের মান বজায় রাখতে না পারা। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহের ঘাটতিও দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, তৈরি পোশাক খাত ছাড়া অন্য খাতগুলো প্রয়োজনীয় মনোযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক, পাটজাত দ্রব্য, কৃষি পণ্য, গৃহস্থালি বস্ত্র, হিমায়িত মাছ এবং আরও অনেক কিছু রপ্তানির সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
ইকোনমিক রিলেশনস ডিভিশন (ইআরডি) একটি গবেষণায় দেখেছে, শীর্ষ দশটি রপ্তানি গন্তব্যে ১৮ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রপ্তানি সম্ভাবনা থাকলেও এসব দেশে এখনও রপ্তানি করা হয়নি।
অন্যদিকে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (আরএপিআইডি) -এর আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু চীন থেকে রপ্তানি আয় সম্ভাবনা রয়েছে কমপক্ষে ৪ বিলিয়ন ডলার।
‘মহামারির ছায়ায় : প্রভাব এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ শিরোনামের ইআরডি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ মাত্র ছয়টি রপ্তানি খাত- আরএমজি, চামড়া, ওষুধ, প্লাস্টিক, পাদুকা এবং চিংড়ির আরও ১৮ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব খাতের বর্তমান রপ্তানি আয় ৩১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। যদিও শীর্ষ দশটি রপ্তানি গন্তব্যের সম্ভাবনা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, কিছু বাজারে অর্ধেক সুযোগ অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
ইআরডি সমীক্ষায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক বাজার ধীরে ধীরে ছোট হচ্ছে। এমনকি তার প্রভাবশালী পোশাক খাতের ক্ষেত্রেও। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন বাজারে চীন ও ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী বাংলাদেশের বাজার দখল করছে। অথচ মার্কিন বাজারে বর্তমান ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের পাশাপাশি অতিরিক্ত ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।
এছাড়া জার্মানিতে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাজ্যে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, স্পেনে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, ফ্রান্সে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, পোল্যান্ডে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, ইতালিতে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, নেদারল্যান্ডসে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, কানাডায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার এবং জাপানে ৮০০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বিদ্যমান শীর্ষ ছয়টি রপ্তানি আইটেমের মধ্যে পোশাক পণ্য ১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া পাদুকা, প্লাস্টিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়া এবং চিংড়ি সেক্টরগুলি এখনও রপ্তানি সম্ভাবনা ১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার কাজে লাগাতে পারেনি। মহামারি-আক্রান্ত সময়ের পরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পথে বাংলাদেশ। যার ফলে রপ্তানি আর্থিক বছর ২০২১ সালে রপ্তানি ৩৮ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা প্রবৃদ্ধির হার রেকর্ড করেছে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মতে, শুধু পোশাক খাতই রপ্তানি আয়ে প্রায় ৮১ শতাংশ অবদান রেখেছে। যদিও বাংলাদেশ বিশ্বের ২০০টিরও বেশি দেশে মোট ৩১ ধরনের পণ্য রপ্তানি করে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর আমরা অনেক কিছুই পাবো না। এজন্য এখন থেকেই আমাদের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের গিভ অ্যান্ড টেকের দিকে যেতে হবে। আমাদের কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রধান বাধা হচ্ছে নিরাপত্তা। আমাদের গড় ডিউটি হচ্ছে ২৭ শতাংশ। এটা কমিয়ে ১০ থেকে ১২ শতাংশে আনতে হবে। আমাদের পণ্য বহুমুখী নয়, মান সনদ কেউ গ্রহণ করে না। তবে মূল বিষয় হচ্ছে ট্যারিফ ইস্যু। কারণ আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হবে। পাশাপাশি উৎপানশীলতা বাড়ানো ও ব্যয় কমাতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে চেষ্টা করতে হবে। এজন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমাদের রপ্তানি বহুমুখীকরণের কোনো বিকল্প নেই। আর রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে যে বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার সেটা হলো, আমরা যে পণ্যে ভালো করছি সেগুলোর বহুমুখী করে রপ্তানির ঝুড়ি বৃদ্ধি করতে হবে।
পোশাক রপ্তানিকারকরা দাবি করেছেন, বাজারে কিছু রপ্তানি বাধার কারণে বাজারে রপ্তানি বাড়ছে না। আরএমজি খাতে বর্তমান ক্রেতাদের এবং বিদ্যমান বাজারের জন্য মানবসৃষ্ট ফাইবার ভিত্তিক পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আরও ২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
তারা আরও বলেন, তারা পণ্যগুলির বৈচিত্র্য আনতে একটি উদ্ভাবন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারের সাথে কাজ করছে। ২০২১ অর্থবছর থেকে মানবসৃষ্ট ফাইবার শিল্পে বিনিয়োগ আনার জন্য সরকার কর মুক্তির সুবিধাও দিয়েছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর সদস্য ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) সরকার এবং চামড়া, প্লাস্টিক এবং হালকা প্রকৌশল খাতের উদ্যোক্তাদের সাথে রপ্তানি ঝুড়িতে বৈচিত্র্য আনতে এবং রপ্তানি বাজারে তাদের প্রতিযোগিতা বাড়ানোর জন্য কাজ করছে।
এদিকে আরএপিআইডি’র চেয়ারম্যান ড এমএ রাজ্জাকের নেতৃত্বে তিনজন গবেষকের একটি দল সম্প্রতি পরিচালিত গবেষণায় দেখিয়েছে যে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি কমপক্ষে ৪ বিলিয়ন ডলার হওয়া উচিত। এটি আরও দেখিয়েছে যে বাংলাদেশ চীনের বাজারে তার রপ্তানি সম্ভাবনার ৩০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে না।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে যখন বাংলাদেশের বেশিরভাগ পণ্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়েছিল, তখন অন্যান্য দেশকে ১৬ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়েছিল। কিন্তু এমএফএন -এর অধীনে, চীন ধীরে ধীরে সেই দেশগুলির জন্য শুল্ক হ্রাস করেছে ২০১৮ সালে প্রায় ৬ শতাংশ, যার অর্থ চীনের বাজারে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার মার্জিন হ্রাস পেয়েছে, যা কঠোর প্রতিযোগিতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।