‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’

18

মুশফিক হোসাইন

পবিত্র রমজান মাস এলেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এটা যেন বাংলাদেশের অলিখিতরীতি। অথচ সারা বিশ^জুড়ে জাতীয় উৎসব, বড়দিন, পূজা পার্বণে ও ঈদের সময় মুসলিম, খৃস্টান, ইহুদি হিন্দুসহ সকল জাতি সাধারণ মানুষের সুবিধার কথা বিবেচনা করে মূল্যহ্রাস করে থাকে। ব্যতিক্রম শুধু আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়ার লাগাম চেপে ধরার কেউ নেই। না ক্যাব, না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী না প্রশাসন। কবি শামসুর রাহমান ত্রিকালদর্শী কবি তাই তিনি এই স্বদেশ (মৃত্যুর) ছেড়ে যাওয়ার আগেই লিখে গেছেন;
‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’
উদাহরণ দেয়া থাক, রোজাদারগণ যার যার সামর্থ্য মতো ভালো মন্দ খেতে চান। আমিষের জন্য তারা বাছাই করে গরুর মাংস। পূর্বে গরুর মাংসের দাম ছিল ক্ষেত্র বিশেষে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। রমজানের পূর্বে একলাফে ৮৫০ থেকে ৯০০টাকায়। অথচ সরকার ও দেশিয় খামার মালিকরা বলছেন দেশে গরু, মহিষ, ছাগল-ভেড়ার কোন অভাই নেই। চাহিদার চেয়ে উৎপাদনে উদ্বৃত্ত। তারপরও মিয়ানমার থেকে প্রতিনিয়ত আমদানি ও চোরাই পথে আসছে গরু মহিষ। মজার ব্যাপার হলো তারপরও গো-মাংসের দাম আকাশচুম্ভি। দেশের সর্বোচ্চ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআই বলছে, ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি করা হলে মাংসের দাম ৪০০ টাকায় নেমে আসবে। বুঝতে পারি না দেশের মানুষকে সস্তায় মাংস খাওয়ানোর জন্য কেন ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি করা হয় না ? বাধা কোথায় ভারত থেকে গরু / মহিষের মাংস আমদানি তো হচ্ছে ? তাহলে দেশের আপামর মানুষের সুবিধার্থে কেন ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি করা হচ্ছে না ? একই ব্যাপার ব্রয়লার মুরগীর ক্ষেত্রে। যে ব্রয়লার মুরগীর দাম ছিল ১২৫ থেকে ১৩০টাকা। হঠাৎ করে রমজানে তা গিয়ে পৌঁছলো ২৫০ থেকে ২৯০ টাকা। নি¤œ আয়ের মানুষের মাংস জাতীয় প্রোটিনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস ছিল ব্রয়লার মোরগ। হঠাৎ করে তার দাম বেড়ে ৩০০ এর কাছাকাছি। সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলেছে হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি কর্পোরেট হাউস। ভোক্ত অধিকার সংস্থাসহ দেশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন আইন শৃঙ্খলাবাহিনী তাদের হাতের পুতুল।
এক তথ্যে জানা যায় যে ৫টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ব্রয়লাদের দাম বাড়িয়ে ৫২ দিনে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।
সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমের চাপে ব্রয়লারের দাম কর্পোরেট হাউসগুলো সর্বশেষ ২৫০টাকা নির্ধারণ করেছে। ক্যাব বলেছে দাম কমালে আমদানির অনুমতি দেয়া হবে ? কার স্বার্থে তা হলে গরু, ছাগল ও মোরগ আমদানির অনুমতি দেয়া হচ্ছে না ? বোধগম্য নয়। গরু মাংস নয়, ভোগ্যপণ্যসহ সকল প্রকার পণ্যের দাম এখন বৃদ্ধি এটা শুধু এ বছর নয়। প্রতি বছরের চিত্র। স্বাধীনতার আগেও ছিল এখনও আছে। রমজানে সকল ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি যেন আমাদের ঐতিহ্য। সামাজিক মাধ্যমে একজন লিখেছেন, রমজানে মহান আল্লাহপাক শয়তানকে বন্দী করে রাখেন। শয়তান বন্দী হওয়ার আগে রমজানের চাঁদ উঠার আগেই তার সকল দায়িত্ব এদেশের ব্যবসায়ীদের কাঁধে ভর করে দেয়। তা না হলে পবিত্র রমজান মাসে কেন নেককার ব্যবসায়ীদের মাঝে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেওয়ার মানসিকতা কেন ভর করে।
আমাদের সরকার জনবান্ধব সরকাল। তবে এ সরকার নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ী গোষ্ঠি। সে জন্যই দেশের শীর্ষ ঋণ খেলাপী ও পুঁজি বাজার ধস নামানো দরবেশ সাহেব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্য উপদেষ্টা হতে পারে।
আমার বোধগম্য হয় না ভোক্তাদের অধিকার ও স্বার্থ দেখার একমাত্র সংগঠন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) দেশের পণ্য বাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কোন কার্যকর ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। পণ্যের বেসামাল দামে অসহায় মধ্যবিত্ত সমাজ। তার চেয়ে বেশি অসহায় নি¤œ বিত্ত। তাদের সুখ দুঃখ দেখার কেউ যেন নেই স্বাধীন বাংলাদেশে। এতে করে কষ্ট বেড়েছে সাধারণ মানুষের। ধার দেনা করে তাদের সংসার চালাতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ক্রেতাসমাজকে জিম্মি করে অতি মুনাফার পাহাড় গড়ছে। ব্যবসায়িদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গার ক্ষমতা নেই, ব্যবসায়ী নির্ভর এই সরকারের। মুনাফাখোরিদের বিরুদ্ধে তাই কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
সাধারণ মানুষ ও ভুক্তভোগীরা মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে ফরিয়াদ করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সরকার ও জনগণ জানে ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে কাদের কারসাজি। যতদিন না এই মূল্য হোতাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে ততদিন এই দেশ কল্যাণকর করা হতে পারে না। যদিও আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে রুপান্তরিত হতে আর দেরি নেই। তারপরও এ অবস্থাতে দেশ কল্যাণকর দেশ হতে পারে না।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)