উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ব্যবসায়ীরা

35

তুষার দেব

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তৎপর সংঘবদ্ধ পণ্য লোপাটকারী চক্রকে কিছুতেই নির্র্মূল করা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার এলাকায় আমদানি-রপ্তানি পণ্য লোপাটকারী চক্র তৎপর রয়েছে। পণ্য লুট করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ডাকাতচক্রের সদস্যরা খুন-খারাবির মত ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাতেও দ্বিধা করছে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরপাকড় এবং নজরদারিতেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না লোপাটকারী চক্র। কারখানা থেকে শিপমেন্টের জন্য রপ্তানি পণ্য বন্দরে আনার সময় পথিমধ্যে লোপাট হয়ে যাওয়ার ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত ৬ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের কারখানা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আনার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুÐে কাভার্ড ভ্যানভর্তি ১ কোটি ১৩ লাখ টাকার রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট পণ্য নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন চালক ও তার সহকারী। পরে কাভার্ড ভ্যানটি উদ্ধার হলেও চালক, সহকারী ও পণ্যের হদিস মেলেনি। গত ৯ নভেম্বর সীতাকুÐ মডেল থানায় মামলার পর রাতে চট্টগ্রাম বন্দর-ফৌজদারহাট সংযোগ সড়কের শুকতারা রেস্তোরা এলাকা থেকে পুলিশ পরিত্যক্ত অবস্থায় কাভার্ড ভ্যানটি উদ্ধার করে। পুলিশ বলছে, কাভার্ড ভ্যানের কাগজপত্র, নম্বর, চালক ও সহকারীর নাম-ঠিকানা সবই ভুয়া। সংঘবদ্ধ লোপাটকারী চক্র পরিকল্পিতভাবে পণ্যগুলো চুরি করেছে। ঘটনার পর থেকেই পলাতক রয়েছেন কাভার্ড ভ্যানের চালক ও সহকারী। তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ। পুলিশ তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
পণ্য পরিবহন ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন দুই হাজারের অধিক যাত্রীবাহী বাস, আট হাজারের বেশি প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস এবং চার হাজারের বেশি মিনি ট্রাক ও হিউম্যান হলার চলাচল করে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক ট্রাক ও লরি চলাচল করে ত্রিশ হাজারের বেশি। প্রতিদিন আমদানি-রপ্তানি পণ্যভর্তি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের একটি বড় অংশ যায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে। এসব ট্রাক-কাভার্ডভ্যানে থাকে তৈরি পোশাক, আমদানিকৃত তুলা, প্লাস্টিক দানা, ফেব্রিক্স ও এক্সেসরিজসহ নানা ধরনের পণ্য। চট্টগ্রামভিত্তিক রি-রোলিং মিল থেকে রডবাহী প্রচুর ট্রাক চলাচল করে এই মহাসড়ক দিয়ে। সীতাকুন্ড্ে শিপইয়ার্ড থেকেও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত রি-রোলিং মিলগুলোতে স্ক্র্যাপবাহী যানবাহনের চলাচল রয়েছে। পণ্যবাহী এসব যানবাহন অনেক সময় পথিমধ্যে সংঘবদ্ধ ডাকাতচক্রের কবলে পড়ছে। ডাকাতচক্র কখনও পণ্যভর্তি আস্ত গাড়িই নিজেদের ডেরায় নিয়ে যায়। আর পণ্য লুট করতে গিয়ে তারা অনেকসময় ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যানের চালক-হেলপারকে খুন করতেও দ্বিধা করছে না।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, মহাসড়কে পণ্য লুটের সঙ্গে অন্তত দেড়শ’ ডাকাতচক্র কমবেশি সক্রিয় রয়েছে। মহাসড়কের দাউদকান্দি, কুমিল্লা, চৌদ্দগ্রাম, ফেনী, মিরসরাই, সীতাকুন্ড, ভাটিয়ারি ও ফৌজদারহাট পর্যন্ত এদের জাল বিস্তৃত রয়েছে। ডাকাতচক্রের ইনফরমার বা তথ্যদাতা হয়ে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করে নগরীর কদমতলী এলাকার ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ব্রোকারদের একটি অংশ। এরা পণ্য নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হওয়ার আগেই লোপাটচক্রকে কত নম্বর গাড়িতে কী মালামাল নেয়া হচ্ছে তা জানিয়ে দেয়। পরিবহন শ্রমিকদের কারও কারও সাথে ডাকাতচক্রের সখ্যতারও অভিযোগ রয়েছে। ইনফরমারের দেয়া তথ্যে রাতের বেলায় পণ্যবাহী যানবাহন যাওয়ার পথে মহাসড়কের বিভিন্ন স্পটে অবস্থান নেয় সংঘবদ্ধ লোপাটকারী চক্র। অস্ত্রের মুখে চালককে জিম্মি করে পণ্যভর্তি যানবাহন অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার পর মালামাল লুটে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয়া হয়। লুণ্ঠিত এসব পণ্য হালিশহর, মিরসরাই, সীতাকুÐসহ তাদের নির্ধারিত কয়েকটি এলাকার গুদামে রেখে পরবর্তীতে সময়-সুযোগ বুঝে অভ্যন্তরীণ বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন সময়ে পুলিশি অভিযানে সংঘবদ্ধ চক্রের কিছু সদস্য ধরা পড়লেও মহাসড়কে পণ্য লোপাটচক্রের অপতৎপরতা নির্মূল করা যাচ্ছে না।
মহাসড়কে আমদানি-রপ্তানি পণ্য লোপাটচক্রের অপতৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম পূর্বদেশকে বলেন, মানুষের জীবনযাপন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে নিরাপত্তাই হচ্ছে প্রধান শর্ত। নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে কোনো কিছুই বিকশিত হওয়া সম্ভব নয়। মহাসড়কের পথিমধ্যে আমদানি-রপ্তানি পণ্য লোপাট হয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন ফোরামে আমরা আলোচনা করেছি। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এতকিছুর পরও এ অপকর্ম নির্মূল করা যায়নি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হচ্ছে দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। এটি নিরাপদ রাখা না গেলে দেশের অর্থনীতি সঙ্কটে পড়বে।
পুলিশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, মহাসড়কে নিরাপত্তা দায়িত্বে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করে। হাইওয়ে পুলিশ ছাড়াও থানা এবং এলিট ফোর্স র‌্যাবও ক্ষেত্রবিশেষে মহাসড়কে অপরাধ দমনে দায়িত্ব পালন করে থাকে। মহাসড়কে অপরাধ দমনে সমন্বিতভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য এরইমধ্যে ইউনিট প্রধানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।