উগ্রবাদীদের বান্দরবান কানেকশনের রহস্য কী?

6

তুষার দেব
দেশে নতুন আবিষ্কৃত উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র বান্দরবান কানেকশন জনমনে রহস্য সৃষ্টি করেছে। যদিও নানা নামে তৎপর উগ্রবাদে বিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন কারণে অনেক আগে থেকেই পাবর্ত্য চট্টগ্রামকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে পছন্দের শীর্ষে রেখে আসছে। ইতোপূর্বে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সংগ্রহে পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎপর কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের যোগসাজশের অভিযোগ এসেছিল। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এখন উগ্রবাদী সংগঠনের সাথে রোহিঙ্গা সংযোগ বেশি আলোচিত হচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. এমদাদুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য অত্যাধিক স্পর্শকাতর এলাকা। তার মধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি ও থানচিসহ সন্নিহিত এলাকায় আমাদের সাথে প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। এসব সীমান্ত দিয়েই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সঙ্গত কারণেই উগ্রবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের উদ্দেশ্য হাসিলে রোহিঙ্গাদের টার্গেট করতেই পারে। আর ভৌগলিক অবস্থানসহ অনুকূল পরিবেশের জন্য তারা সংগঠিত হওয়ার জন্য বান্দরবানকে বেছে নিয়ে থাকতে পারে।
র‌্যাব বলছে, এক সময়ে জঙ্গি সংগঠন হুজির পাহাড়ে আস্তানা গাঁড়ার খবর নানা মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল। আফগান ফেরতদের এই দলটি গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারের মুসলমান রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিয়ে লড়াইয়ে অংশ নেয়া। নব্বইয়ের দশকে রোহিঙ্গাদের দুই সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এআরএনও) এর সঙ্গে হুজির সম্পর্কের খবরও আলোচনায় আসে। উগ্রবাদ বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণকারী সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ উত্থানের সময় বিগত ২০০৩ সালের ২৬ ও ২৭ আগস্ট বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির জঙ্গল থেকে পুলিশ, বিডিআর ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল। তাদের ২০০৫ সালের মূল্যায়ন অনুযায়ী, বান্দরবানে জেএমবির বেশ তৎপরতা ছিল। তারা রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। বান্দরবানের সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় নব্য উগ্রবাদী জঙ্গিরা মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) সহ বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের সাথে সখ্য গড়ে তুলেছে। নিরাপদে প্রশিক্ষণ নেয়াসহ বিস্ফোরক দ্রব্য ও অস্ত্র সংগ্রহে তারা পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা নিচ্ছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানিয়েছে, বিগত ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ জেলার সীতাকুÐ উপজেলার প্রেমতলা এলাকায় ‘ছায়ানীড়’ নামের বাড়িতে জঙ্গি আস্তানায় নিহত হওয়া পাঁচজনের মধ্যে তিন জনের বাড়ি ছিল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। একইসঙ্গে ওই এলাকার ‘সাধনকুটির’ থেকে গ্রেপ্তার হওয়া অন্যজনের বাড়িও নাইক্ষ্যংছড়িতে। ওই অভিযানে নিহতরা ছিলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন, তার স্ত্রী জুবাইরা ইয়াসমিন ও তাদের শিশু সন্তান। আর আমিরাবাদের সাধনকুটির থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জুবাইরা ইয়াসমিনের ভাই জহিরুল হক ওরফে জসিম। জুবাইরা ইয়াসমিন ও তার ভাই জহিরুল হক ওরফে জসিম নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের যৌথ খামারপাড়ার নুরুল আলম ও জান্নাত আরার সন্তান। জুবাইরা ইয়াসমিনের স্বামী কামাল হোসেনের বাড়িও বাইশারীর যৌথ খামারপাড়ায়। অভিযানের পর পুলিশ তখন জানিয়েছিল, সীতাকুÐ পৌরসভার প্রেমতলা ও আমিরাবাদ এলাকার দুটি বাসা ভাড়া নিয়েছিল ‘নব্য জেএমবির’ এই জঙ্গিরা। দুই বাসায় থাকা ছয় জঙ্গির চারজনই আত্মীয়। তাদের মধ্যে দুজন আত্মঘাতী বিস্ফোরণে মারা গেছে। অন্য দুজনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। টঙ্গীতে হুজি’র শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানকে প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টার পরের দিন কুমিল্লায় পুলিশের ওপর বোমা হামলা করে দুই জঙ্গি। যাত্রীবাহী বাসে নিরাপত্তা তল্লাশির সময় এ হামলার ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের সহায়তায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জঙ্গি জহির ওরফে জসিম (২৫) এবং হাসানকে (২৪) আটক করা হয়। এদের মধ্যে হাসানের বাড়ি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারীর করলিয়া মোড়া এলাকায়। তার বাবার নাম নুর হোসেন।
এর আগে ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর হাটহাজারী থানার আমানবাজারে নগর গোয়েন্দা পুলিশ এক শীর্ষ জঙ্গির গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে একটি এমকে-১১ স্নাইপার রাইফেল, দুইশ’ রাউন্ড গুলি এবং বিস্ফোরকসহ সেনাবাহিনীর পোশাক জব্দ করেছিল। তবে অভিযানের সময় ওই আস্তানায় শীর্ষ জঙ্গি ফাহাদ (পরবর্তীতে নিহত) বা অন্য কেউই ছিলেন না। জব্দকৃত এমকে-১১ স্নাইপার রাইফেলটি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি একটি আধুনিক স্নাইপার রাইফেল। এর আগে দেশে এ ধরনের স্নাইপার রাইফেল জব্দ করার নজির ছিল না। গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে ¯œাইপার রাইফেলসহ গোলাবারুদগুলো বান্দরবানে তৎপর একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর কাছ থেকে সংগ্রহ করার কথা আলোচনায় এসেছিল।