উইঘুর মুসলিমদের আর কত নিপীড়ন সইতে হবে?

21

 

উইঘুর সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই এই জাতির ইতিহাস সম্পর্কে একটু জানতে হবে আমাদের। প্রায় চার হাজার বছর আগের এই জাতি মূলত স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী। পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার একটি দেশ, যার চতুর্পাশ্বে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান। এ অঞ্চলে মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস ১৩০০ বছরের বেশি পুরনো। ১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে চীনের অভ্যুদয়ের সময় প্রদেশটির জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলমান ছিল; বর্তমানে যা মাত্র ৪৫ শতাংশ। ১৯১১ সালে মাঙ্কু সা¤্রাজ্য উৎখাতের মাধ্যমে পূর্ব তুর্কিস্তানে চীনা শাসন চালু হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনচেতা বীর উইঘুররা এই বৈদেশিক শাসনের সামনে মাথা নোয়ায়নি। এ কারণে ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে তারা দুবার চীনাদের সঙ্গে সাহসিকতার চরম রূপ দেখিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু তবুও ভাগ্য তাদের অনুকূলে ছিল না। ১৯৪৯ সালে তারা চীনা কমিউনিস্টদের হাতে পরাজিত হয় আর জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ গড়ে ওঠে।
চীনের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হওয়ার পর থেকেই এই জাতির উপর শুরু হয়েছে এক অমানবিক নিপীড়ন নির্যাতন। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হচ্ছে তাদের এই অমানবিকতা নিয়ে পুরো বিশ্ব অনেকটাই নির্ভাক। ফ্রিডম ওয়াচের মতে, চীন হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম ধর্মীয় নিপীড়ক দেশ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এসব নিপীড়নের কথা বিশ্ববাসী খুব একটা জানতে পারে না।
জাতিসংঘের একটি কমিটি জানতে পেরেছে যে ১০ লাখের মতো উইঘুর মুসলিমকে পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং অঞ্চলে কয়েকটি শিবিরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এসব ক্যাম্পে তাদের ‘নতুন করে শিক্ষা’ দেয়া হচ্ছে। চীন সরকার এ বন্দি শিবিরকে ‘চরিত্র সংশোধনাগার’ নাম দিয়েছে। চীন সরকারের দাবি, উচ্ছৃঙ্খল অবস্থা থেকে নিরাপদ ও সুরক্ষা দিতেই তাদের এ কার্যক্রম। চরিত্র সংশোধনাগারের নামে চীন সরকার এ সব মুসলিমদের প্রতি চরম অত্যাচার ও নির্যাতন করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীন সরকারের বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মুসলিমদের বন্দি করা এখনো থামেনি সেখানে। সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্যমতে, চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের জন্য যেসব ‘পুনঃশিক্ষণ’ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে – তাতে নারীরা পরিকল্পিতভবে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। একইসঙ্গে শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকারী লোকজনের ওপর চীন সরকারের নিপীড়নমূলক নজরদারির তথ্যপ্রমাণ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
মুসলিম নির্যাতনের এসব তথ্য যাতে চীনের বাইরে যেতে না পারে সেজন্য তারা প্রতিনিয়িত মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগে বিধি-নিষেধ আরোপ করছে। সরকারিভাবে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য জিনজিয়াং প্রদেশে ভ্রমণও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সম্প্রতি জিনজিয়াং প্রদেশের যে কোনো একটি শহরকে ভূগর্ভস্থ পারমানবিক পরীক্ষা ও বিস্ফোরণের জন্য বাছাই করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করছে চীন সরকার। শুধু তাই নয়, ১৯৬৪ সাল থেকে জিনজিয়াং প্রদেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি ক্ষতিকর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।
চীন সরকারের জুলুম অত্যাচার থেকে বাঁচার লক্ষ্যে জিনজিয়াংয়ের প্রায় ২৫ লাখ অধিবাসী পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। নানা অজুহাতে উইঘুর মুসলিমদের জেল-জুলুম এমনকি মৃত্যুদÐ দিচ্ছে চীন সরকার। শুধু তা-ই নয়, চীন সরকার মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধ্বংসে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যা ধীরে ধীরে তারা বান্তবায়ন করছে। তার কিছু হলো- জিনজিয়াং প্রদেশের কোনো পুরনো মসজিদ সংস্কার করতে না দেয়া। নতুন মসজিদ নির্মাণের অনুমোদন না দেয়া। বৌদ্ধমন্দিরের আদলে সংস্কার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই কেবল পুরনো মসজিদ সংস্কারের অনুমোদন মেলে। প্রকাশ্যে ধর্মীয় শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই জিনজিয়াং-এ। তাই কঠিন গোপনীয়তার মধ্যেই ধর্মীয় শিক্ষা নিতে হয় উইঘুরদের। পবিত্র হজকে পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। পোস্টারের মাধ্যমে চীন সরকার এ প্রচারণা চালাচ্ছে যে, নামাজের জন্য মসজিদ নয় বরং নামাজ পড়ার জন্য ঘরে যাও। উইঘুর মুসলিমদের ইসলামি সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে চীন সরকার নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। মুসলমানদের শিক্ষার সুযোগও অত্যন্ত সীমিত করা হয়েছে। সুকৌশলে তাদের অশিক্ষিত রাখা হচ্ছে। এই একটি বিষয়ে মুসলিম বিশ্বের নীরবতা নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরী করে দেয় সাধারণ মানুষের মনে। মিয়ানমার সরকার যখন হাজার হাজার সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাকে হত্যা করে এবং সাত লাখ রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে, মুসলিম বিশ্ব চুপ ছিল না। প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। কিন্তু একই প্রতিবাদের ঝড় চীনের এই পৈশাচিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে হচ্ছে না। পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে ইসলামকে দমন করার যে নারকীয় চেষ্টা, সে বিষয়ে সবসময়ই সবাই নীরব ছিলো। শুধু মুসলমান হওয়ার অপরাধে ১০ লাখেরও বেশি উইঘুর মুসলিমকে অবৈধভাবে জিনজিয়াংয়ের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ আটকে রাখা হয়েছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজের মূল ধারায় নেয়ার প্রক্রিয়া’র নামে সেখানে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে নির্মম নির্যাতন। যা আধুনিক ইতিহাসে মুসলমানদের ওপর সবচেয়ে নির্লজ্জ সন্মুখ হামলা-নির্যাতন। আর এই দমন-নিপীড়নের প্রতিবাদে বিশ্বের ৪৯টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ প্রায় কিছুই বলেনি। মালয়েশিয়া গত বছর এক ডজন উইঘুর শরণার্থীকে চীনে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করেছিল, কুয়েত পার্লামেন্টের চার সদস্য জানুয়ারিতে উইঘুরদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিল এবং তুরস্ক গত মাসে চীনের নির্মম আচরণের নিন্দা জানিয়েছিল। ব্যস, এটুকুই। বাকি ৪৬টি দেশ বিষয়টি নিয়ে কিছুই বলেনি, বলা ভালো এড়িয়ে গেছে। একমাত্র আল-জাজিরা ছাড়া আরব মিডিয়াগুলোতে এমনকি ইরান, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো বড় মুসলিম দেশগুলোতেও এ বিষয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায়নি।
বাংলাদেশও একটি মুসলিম রাষ্ট্র। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এই বিষয়ে সবসময় নিরব ভ‚মিকা পালন করেছে। এদেশের আলেম সমাজও এই বিষয়টা নিয়ে খুব একটা কথা বলেন না। মাঝে মাঝে কয়েকটি মানববন্ধন আর সভা-সেমিনার হয়েছে উইঘুর মুসলমানদের নির্যাতন বন্ধ নিয়ে। কিন্তু সেগুলোও ঠিক সেভাবে সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসেনি। এভাবে আসলে কিছুই সম্ভব না। বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ এই বিষয়টি নিয়ে সরাসরি চীনের সাথে আলাপ করা। জাতিসংঘে এ বিষয়ে অভিযোগ দেওয়া, অন্যান্য মুসলিম দেশের সাথে এই ইস্যু নিয়ে বৈঠক করা দরকার বাংলাদেশের। বাংলাদেশের মাধ্যমেও চাইলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক