ঈমানের পরিপন্থী কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকুন

631

ঈমান উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায় না। বাপ দাদারা ঈমানদার মুসলিম হলে সন্তান-সন্ততি ও বংশধররাও মুসলিমই থাকবে এমটা চিন্তা করাও সঠিক নয়। ঈমান অনেকগুলো আকিদা-বিশ্বাসের সমষ্টি। প্রকৃত ঈমানদার মুসলিম আকিদা-বিশ্বাসের বহির্ভূত কোনো কথাও কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে না। যেমন অজু ভঙ্গের কারণ পাওয়া গেলে অজু ভেঙে যায়। তেমনি ঈমানবিরোধী বিশ্বাস ও কর্মকান্ড থেকে ফিরে এসে তাওবা না করে সে মারা গেলে তাকে কি ঈমানদার বলা হবে? এ ফিতনার যুগে ঈমানের ওপর টিকে থাকা বড়ই কঠিন। পবিত্র হাদিস তিরমিজি ২২৬০ এ বর্ণিত আছে, ‘এমন এক যুগ আসবে, যখন দ্বিনের ওপর অটল থাকা হাতে জ্বলন্ত অঙ্গার রাখার মতো কঠিন হবে।’ অন্য এক হাদিস আবু দাউদ ৪২৫৯ বর্ণিত আছে, ‘কিয়ামতের আগে অন্ধকার রাতের ন্যায় এমন ভয়াবহ ফিতনা একের পর এক আসতে থাকবে যে মানুষ সকালে ঈমানদার থাকবে তো বিকেলে কাফের হয়ে যাবে, বিকেলে ঈমানদার থাকবে, তো সকালে কাফের হয়ে যাবে।’ ঈমান-আকিদা ঠিক রাখতে ঈমানের পরিপন্থী কথা ও কাজ সম্পর্কে জানা জরুরি। প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার পথে ঈমানের পরিপন্থী কথা ও কাজ পরিহার করার সুবিধার্থে এ প্রবন্ধে ঈমানের পরিপন্থী কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো ঃ
কোনো কুফরি বিশ্বাস অন্তরে লালন করা : বিশ্বাস গত নিফাক (কপটতা) বিদ্যমান থাকাও ঈমানের অন্তরায়। নিফাক বিভিন্ন প্রকার আছে তন্মধ্যে একটি হলো বিশ্বাসগত নিফাক। এর অর্থ অন্তরে কুফরি মতবাদ বা ইসলাম বিদ্বেষ লালন করে ও কথা বা কাজে মুসলিম দাবি করা। এটি কুফরির জঘন্যতম প্রকার। যখন কারো কথা বা কাজে নিফাক প্রকাশিত হয়ে পড়ে, অন্তরে লালিত কুফরি আকিদা ও ইসলাম বিদ্বেষ মুখে ও এসে যায়, তখন তো তার ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক করতেই হবে। বিশ্বাসগত নিফাকের বিভিন্ন রূপ আছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ ক) শরিয়ত বা শরিয়তের কোনো বিধানকে অপছন্দ করা। খ) ইসলামের নবী (সা:), কোরআন, ইসলামী নিদর্শনের কিংবা ইসলামের কোনো বিধানের বিদ্রুপ বা অবজ্ঞা করা। ইসলামের কিছু বিশ্বাস ও বিধানকে মানা আর কিছু না মানা। ঘ) শরীয়তের কোনো বিধানের ওপর আপত্তি করা বা কোনো স্থায়ী বিধানকে সংস্কারযোগ্য মনে করা। ঙ) ইসলামের কোনো অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন আকিদা বা বিধানের অপব্যাখ্যা করা।
ইসলামের নিদের্শনাবলি বিষয়ে বিরূপ ধারণা পোষণ : পবিত্র ইসলামের মৌলিক আলামত বা নিদর্শন হলো শাতাইরে ইসলাম। কলেমা, ইবাদত, আল্লাহর রাসুল, আল্লাহর কিতাব, আল্লাহর ঘর কাবা, অন্যান্য মসজিদ ও ইসলামের অন্যান্য পবিত্র স্থান, বিশেষত মসজিদে হারাম, মিনা, আরাফা, মুজদালিফা, মসজিদে আকসা ও মসজিদ-ই নব্বী, হজ ও কোরবানীর পশু ইত্যাদি। পবিত্র কোরআন মাজিদে এই নিদর্শনগুলোর মর্যাদা রক্ষার আদেশ করে ইরশাদ হয়েছে, ‘এগুলোর মর্যাদা রক্ষা প্রমাণ করে, অন্তরে তাকওয়া আছে, আল্লাহর ভয় আছে।’ (সূরা : হজ, আয়াত, ৩২)
ঈমানদারকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে, তার মধ্যে শাআইরে ইসলামের ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে কিনা। কেউ এগুলোর অবমাননা করলে আমার কষ্ট হয় কিনা। কুফরি কার্যকলাপ ও অশোভন আচরণ সম্পর্কে আমার মনে ঘৃণা জাগছে না, আর না এই বেয়াদবি কাজের বিষয়ে আমার অন্তরে কোনো বিদ্বেষ; শাআইয়ের বিষয়ে এই যদি হয় আমার আচরণ অনুভূতি, তাহলে নিশ্চিত বুঝে নিতে হবে, অন্তর একেবারেই ঈমান শূন্য।
আল্লাহকে বিধানদাতা মেনে নিতে সংশয় করা ঈমানের অন্তরায় : মুসলিম রাষ্ট্র পরিচালনা এবং মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত তাদের ফরজ দায়িত্ব ইসলামী নীতি ও বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা। ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা, হদ, কিসাদ ও ইসলামী দন্ডবিধি কার্যকর করা, রাষ্ট্র পরিচালনা আইন, বিচার ও নির্বাহী ক্ষেত্রে ইসলামী বিধি বিধানের আনুগত্য করা। পবিত্র কোরআনের সুরা মায়িদা, আয়াত : ৪৯-৫০ এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী তাদের বিচার নিস্পত্তি করো। তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ না করো এবং তাদের সম্পর্কে সতর্ক হও, যাতে আল্লাহ যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তারা আর কিছু থেকে তোমাকে বিচ্যুত না করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেই তবে জেনে রাখো যে কোনো কোনো পাপের কারণে আল্লাহ তাদের বিপদাপন্ন করতে চান এবং মানুষের মধ্যে অনেকেই তো সত্যত্যাগী। তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধি বিধান কামনা করে? বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান দানে আল্লাহর চেয়ে কে শ্রেষ্ঠতর? যেসব বিষয়ে কোরআন সুন্নাহর সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত নিদের্শনা আছে, সেখানে হুবহু ওই নির্দেশনার অনুসরণ করা এবং তা কার্যকর করা জরুরি। এ সব বিষয়ে নতুন আঙ্গিকে বিন্যাস ও সংকলনের কাজ হতে পারে, কিন্তু তা পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কোনো সুযোগ নেই। তদ্রুপ যেসব থেকে বিমুখ হয়ে আলাদা আইন প্রণয়ন কিংবা তার স্থলে মানবরচিত আইন গ্রহণের কোনো অবকাশ নেই।
পবিত্র কোরআনের সুরা নিসা, আয়াত ৫৯-৬১ বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ যদি তোমারা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করো তবে তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসুলের এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকার, কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে তো পেশ করো আল্লাহ ও রাসূলের কাছে। এটাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।
তুমি তাদের দেখো নাই, যারা দাবি করে যে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগুবের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তারা প্রত্যাখান করার জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদের ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়। তাদের যখন বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আসো, তখন মুনাফিকদের তুমি তোমার থেকে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে।’ ‘তাগুতের’ অর্থ আল্লাহর ওই বিদ্রোহী বান্দা, যে আল্লাহ মোকাবেলায় নিজেকে বিধান দাতা মনে করে এবং মানুষের ওপর তা কার্যকর করতে চায়। প্রকৃত পক্ষে কোনো তাগুত ব্যক্তি বা দলের বানানো আইন হচ্ছে ইসলামের বিপরীতে ভিন্ন ‘ধর্ম’। যা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন ছাড়া ঈমান সাব্যস্ত হয় না।
আল্লাহকে হাকিম ও বিধানদাতা মেনে নিতেই দ্বিধা ও সংকোচ কিংবা অস্বীকৃতি থাকে, রাজনীতি ও রাজ্য চালনায় আসমানি বিধানের ‘অনুপ্রবেশ’ কেন এই যদি হয় মনের কথা তাহলে নিশ্চিত বুঝতে হবে, সে ইসলামের গন্ডি থেকে খারিজ।
ইসলামের বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা করা : আকাইদ ও আহকামগুলোর কোনো একটিরও এমন কোনো ব্যাখ্যা করাও সরাসরি কুফর, যার দ্বারা তার প্রতিষ্ঠিত অর্থই বদলে যায়। ঈমানের বিষয়গুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত অর্থেই ঈমান আনতে হবে। নিজের পক্ষ থেকে সেগুলোর কোনো অর্থ নির্ধারণ করে, কিংবা কোনো বেদ্বিনের নব উদ্ভাবিত অথ গ্রহণ করে ঈমানের দাবি করা সম্পূর্ণ অর্থহীন ও সুস্পষ্ট মুনাফেকি। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনের সুরা : হা-মীম আস সাজদা, আয়াত : ৪০ এ বলেন ‘যারা আমার আয়াতকে বিকৃত করে তারা আমার অগোচরে নয়। শ্রেষ্ঠকে? যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, সে? না, কিয়ামতের দিন নিরাপদে থাকবে, সে? তোমাদের যা ইচ্ছা করো; তোমরা যা করো তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা।’
কিছু হারা বা কুফরি বিশ্বাস ও কর্মকান্ড :
১) রাশিচক্র ও গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব বিশ্বাস করা এ বিষয়ে নবীজীর পবিত্র হাদিস বুখারি ১২৭ এ বর্ণিত আছে, ‘ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, রাশিচক্র ও গ্রহ-নক্ষত্রের নিজস্ব কোনো প্রভাব বা ক্ষমতা নেই। সুতরাং ভাগ্য ও শুভ-অশুভ গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে হওয়ায় আকিদা রাখা শিরক।’
২) হস্তরেখা বিদ্যার মাধ্যমে রেখা ইত্যাদি দেখে ভূত-ভবিষ্যতের শুভ-অশুভ সম্পর্ক বিশ্লেষণ দেওয়া এবং এগুলো বিশ্বাস করা কুফরি’। (সহিহ মুসলিম, হাদিস ২২৩০)
৩) রত্ন ও পাথর ইত্যাদির মাধ্যমে ভবিষ্যতের শুভ-অশুভ সম্পর্কে বিশ্লেষণ দেওয়া তা গ্রহণ করা কুফরি (সহিহ মুসলিম হাদিস :৫৩৭)
৪) কোনো কিছুকে কুলক্ষণ মনে করা‘কোনো বস্তু বা অবস্থা থেকে কুলক্ষণ গ্রহণ করা বা কোনো সময়, দিন বা মাসকে অমঙ্গল মনে করা ভ্রান্ত বিশ্বাস। কোরআন হাদিসে প্রমাণিত নেই এরূপ কোনো লক্ষণ বিশ্বাস করা ভ্রান্ত বিশ্বাস।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭১৭)
৫) অমুসলিমদের উপাসনায় গমন ও তাদের পূজা অর্চনায় অংশগ্রহণ‘কোনো মুসলমানের জন্য অমুসলিমদের উপাসনালয়ে গিয়ে তাদের প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করা, মন্দিরে গিয়ে মুর্তিকে সম্মান জানানো এবং পূজা-অর্চনায় অংশগ্রহণ ঈমান বিধ্বংসী কাজ।’ তিরমিজি, হাদিস-১৭৮৫)
৬) পীর সাহেবকে বা মাজারে সিদজা করাঅর্থাৎ পীর সাহেব বা মাজারকে উদ্দেশ্য করে সিজদা করা হারাম। তবে হাত স্পর্শ করে সালাম, কদমবুছি ও চুমু খাওয়া বৈধ।
৭) পর্দা নিয়ে উপহাস করা শরিয়তের যে সব বিধান, অকপটভাবে প্রমাণিত বা ধর্মের সর্বজনবিদিত আবশ্যকীয় বিষয়, পর্দার বিধিান ও তার অন্তর্ভুক্ত তা নিয়ে উপহাস করা কুফরি।
৮) দাড়ি-টুপি নিয়ে উপহাস দাড়ি-টুপির উপহাস করা মূলত নবী (সা.) এর সুরত নিয়ে উপহাস। তাই উপহাসকারী ঈমানহারা হয়ে যাবে।
৯) আলেমদের অপমান ও অবজ্ঞা করা ইলমের কারণে বা দ্বিনের ধারক-বাহক হওয়ায় উলামায়ে কেরামকে হেয় প্রতিপন্ন করা বা কটাক্ষ করা কুফরি। হ্যাঁ, পার্থিব বিষয়ে তাদের কারো কোনো ব্যক্তিগত কর্মের কারণে কটাক্ষ করার দ্বারা কাফের হবে না।
১০) কোরআনের অবমাননা কুফরি কোরআন শরীফের অবমাননা করা বা পুড়িয়ে ফেলা বা ছিঁড়ে ফেলা স্পষ্ট কুফরি।
১১) রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ছবি ও ব্যঙ্গচিত্র আঁকা রাসূলে করিম (সা.) এর অবমাননা যে কোনোভাবেই করা মুখে হোক কিংবা ছবি এঁকে হোক কুফরি। বিশেষত নবীজি (সা:) এর ছবি আঁকাও প্রকাশ্য নবী দ্রোহ। সুতরাং এ ধরনের বেআদব, রাসূলদ্রোহীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা দায়িত্বশীলদের ওপর ফরজ।
১২) নবী কারিম (সা.) এর পর নবুয়তের দাবিদার ও তাঁর অনুসারি কাফের হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী, তাঁর পর আর কেউ নবী হবে না এ কথার ওমর ঈমান রাখতেই হবে। যদি কেউ আল্লাহর ওপর ঈমান আনে কিন্তু নবী কারিম (সা.) কে শেষ নবী হিসেবে না মানে সে কাফের। (সূরা, আহজাব, আয়াত-৪০)
উল্লেখিত বিষয়গুলো স্মরণে রেখে ঈমান মজমুত রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের ঈমান বিধ্বংসী যাবতীয় বিশ্বাস ও কার্যকলাপ থেকে রক্ষা করুন। আমিন। (সূত্র ফতোয়া গবেষক ও মুহাদ্দিস)

লেখক: স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন