ঈদ : গ্রামে আর নগরে

99

ড. মুহাম্মদ ফরিদুদ্দিন ফারুক

‘ঈদ’ শব্দটি আরবি। যার অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে আসা, বারবার আগমন করা ইত্যাদি। দিনটি যেহেতু প্রতিবছর খুশি ও আনন্দবার্তা নিয়ে সমাজে প্রত্যাগমন করে থাকে তাই দিনটিকে ‘ঈদ’ অভিধায় প্রকাশ করা হয়। কুরআন-হাদিসের আলোকে তাৎপর্য ও মূল্যায়ন বিবেচনার দিক থেকে হিসাব, পুরস্কার ও আনন্দ উৎসবের দিন হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার আরবি ‘আ-দাহ’ শব্দ থেকে ‘ঈদ’ শব্দের উৎপত্তি হতে পারে, তখন এর অর্থ হয় অভ্যস্ত করে তোলা। অর্থাৎ, আল্লাহ প্রতিবছর বান্দাহকে দয়া, করুণা ও আনন্দভোগে অভ্যস্ত করে তুলেন। তাহলো অভিবাদন, অভিনন্দন ও আথিতেয়তার চিরন্তন অভ্যাসে অভ্যস্ত করা। উক্ত দিনে নানামাত্রিক অনুষ্ঠান উপভোগকল্পে রোযাব্রত পালন করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ঈদ’ শব্দটির সরল অর্থ উৎসব, ঋতু, পর্ব। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ঈদ উদ্যাপিত হয় ৩১ মার্চ ৬২৪ খৃষ্টাব্দ ১ম শাওয়াল, মদিনায়। তারই ধারাবাহিকতায় মক্কা বিজয়ের পর ৬৩০ খৃষ্টাব্দে বিজয়ের ঠিকএগার দিন পর মক্কায় ঈদ পালিত হয়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কখন ঈদ উদযাপিত হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো ইতিহাস জানা যায় না। তবে ৬৪০ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার আরম্ভ হওয়ার অব্যবহিত পরে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের স›দ্বীপে ঈদ উদ্যাপিত হয় বলে ইতিহাস থেকে অবগত হওয়া যায়। সুলতানি আমলে (১৩০০-১৫৩৮ খৃ.) ঢাকায় প্রথম ঈদ উদ্যাপিত হয়েছে বলেও ইতিহাসে উল্লেখ আছে। ঈদ উদ্যাপন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হওয়ার সাথে সাথে এটি যে, চমৎকার সংস্কৃতিও বটে তার প্রমাণ মহানবি (সা.)’র হাদিসে জানতে পারি। রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন মদিনাবাসীদের দুটি দিন ছিলো; যে দিনদ্বয়ে তারা খেলাধুলা-আনন্দ-ফ‚র্তি করতো। রাসূল (সা.) এদিন দুটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা উত্তর দিলো, জাহিলিযুগে আমরা দিন দুটিতে খেলাধুলা করতাম। তখন তিনি বলেন, আল্লাহতা‘লা এদিন দুটির পরিবর্তে এরচেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। তাহলো ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দিন। এখানে ইসলামের একটি চমৎকার সৌন্দর্যবোধের বিষয় তাহলো বিনোদনের অন্যতম অনুঘটক সংস্কৃতির সাথে ইসলামি বিধানের একীভূতকরণ। ঈদ উদ্যাপনে ধর্মীয় বিধান যেমন ঈদের নামায, তাকবির ইত্যাদি তো অপরিবর্তিত আছে, সে-সাথে সংস্কৃতি হিসেবে যে দিকগুলো ইসলাম প্রবর্তন করেছে তারও ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। তা অঞ্চলভেদে যেমন নানারূপ পরিগ্রহ করেছে তেমনি সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তিত ও বিস্তৃতি লাভ করেছে। ইসলামের মৌলিক বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে সে-সব রোধে ইসলাম কোনো ধরনের বিধিনিষেধও আরোপ করে না। উপরন্তু বাঙালি সমাজে ঈদ সামাজিক-ধর্মীয় উৎসব হিসেবে সবিশেষ অবস্থান করে নিয়েছে। তবে আজকের যে ঈদোৎসব তার ধরণ-রূপ-রস-প্রকার-প্রকরণ এক শতাব্দী পূর্বে ভিন্ন ধরণের ছিলো। সে সময় বাংলাসহ গোটা ভারতবর্ষে ‘ক্রিসমাস ডে’কে সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে পরিগণিত করা হতো। এ দিনের আগে-পরে সরকারি ছুটি বরাদ্দ ছিলো। তারপর দূর্গাপূজাই ছিলো জাঁকালো এবং আড়ম্বরপূর্ণ দিবস। আর্থসামাজিকভাবে পশ্চাদপদ মুসলানদের পক্ষে ঈদকে জাতীয় পর্যায়ের উৎসবে পরিণত করা অসম্ভব ছিলো। কারণ শহর এবং গ্রামের মুসলিম নিবাসীদের অধিকাংশ বিত্তহীন ও শিক্ষাবঞ্চিত ছিলো। হিন্দুপ্রভাবিত বাংলার মুসলিম সমাজে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকেও নামায-রোযার ব্যাপক চর্চা ছিলো না এবং গ্রামাঞ্চলে মসজিদ তো ছিলোই না। তরুণরা তো দূরের কথা প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের মাঝেও রোযাব্রত পালনের প্রবণতা ছিলো কম। আবার যারা রোযা রাখতো তাদের একশ্রেণি বিশেষ প্রক্রিয়ায় পানাহার করাতে রোযা নষ্ট হয় না বলে মনে করতো। শুধুমাত্র ভাত খেলে রোযা ভঙ্গ হতো বলেই বিশ্বাস ছিলো। কিছু ধর্মসচেতন মুত্তাকি তার ব্যতিক্রম ছিলো।
বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ তাবাকাতুননাসিরি-এর লেখক মিহাজুস্ সিরাজ সেকালের ঈদ উৎসব প্রসঙ্গে বলেন, ঈদ উপলক্ষে মুসলিম শাসকগণ ধর্মোপদেশমূলক বক্তব্য রাখতেন এবং ইমাম নামাজ পড়াতেন। শহর-গ্রামে ঈদগাহে জামাত অনুষ্ঠিত হতো। রমযানের শুরু থেকেই ঈদের প্রস্তুতি শুরু হতো। আবুল মনসূর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) সেকালের ঈদ জামাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ঈদের জামাতে বড়রাই তাতে সামিল হতো। তাই জামাতে খুব অল্প লোকই দেখা যেতো। নতুন জামা-কাপড় পরিধান করে লোকেরা গান-বাজনা করতো। বাড়িবাড়ি সারারাত ঢোলের আওয়াজ ধ্বনিত হতো। ঈদের জামাতেও লোকেরা কাছা-ধুুতি পরিধান করে যেতো। নামাজের সময় কাছা খুলতেই হতো। তবে তা নামাজ শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে খুলতো। নামাজের কাতারে বসার পরই চুপিসারে কাছা খুলে নিতো, নামাজ শেষ হওয়ার পরই তা পরিধান করে নিতো। এ ধারা বিংশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশক পর্যন্ত অনেকটা চলমান ছিলো। এর অব্যবহিত পরে মুসলমানসমাজ শিক্ষা-দীক্ষায় ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাওয়ার ফলে তাদের সামাজিক-ধর্মীয় যাবতীয় কর্মকাÐে পরিবর্তন হতে থাকে। সবিশেষ বাংলাসহ উপমহাদেশে ব্যাপক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার কারণে একদিকে ধর্মাচারে শুদ্ধির উন্মেষ হয় অন্যদিকে সামাজিক সংস্কার সকলকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে তুলে। এর ধারাবাহিকতায় লেখালেখি, প্রকাশনা, ধর্মীয় ওয়ায-নাসিহত ইত্যাদিও কল্যাণে এ ধরণের সামাজিক ঐক্যের অনুষ্ঠানগুলো বেশ কার্যকর হয়ে ওঠে। ফলে এখনো আমরা দেখতে পাই দুই ঈদের আগে শহরের মানুষগুলোর গ্রামে যাওয়ার কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা! জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়ক-নৌপথে যুদ্ধাভিযানের আদলে ঘরে ফেরার কী দৃশ্য! বিংশ শতাব্দির আশি-নব্বইয়ের দশকেও ঈদকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য পরিলক্ষিত হতো তা রীতিমতো অপূর্ব। ঈদের দিন ধনী-গরিব, মনিব-ভৃত্য, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি অজানা-অচেনা মানুষজনের জন্য যে আতিথেয়তার আয়োজন তা মানবতার প্রকৃত রূপকেই প্রকাশ করে। ঈদের নামায শেষে কবরস্থানে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের কবর যিয়ারতের সে দৃশ্য মনজোড়ানো। দলবেঁধে শত শত অতিথির আগমনেও কখনো বিরক্তির লেশমাত্র কারো মুখে পরিদৃষ্ট হতো না, বরং অতিথির আধিক্যে আপ্লুত হতেই দেখা যেতো সবাইকে। অতীতের সকল ক্লেশ-কালিমা ভুলে গিয়ে হৃদ্যতার নবতর সংস্করণে ঈদ আসমানি উপঢৌকন, এ অনুভ‚তিই তাঁদেও পুঁজি। ঈদ মুসলিম ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীগণের জন্যও মুসলমানদের দরোজা উন্মুক্ত থাকে। সবিশেষ ভ্রাতৃত্বের হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঈদকে কেন্দ্র করে গ্রামগুলোর মেঠোপথ তার শহরে থাকা সন্তানদের ফিরে পায়। সরব হয়ে ওঠে গ্রামের আনাচ-কানাচ। সে-সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আতিথেয়তায় থাকতো মিষ্টান্নজাতীয় দ্রব্য। সবিশেষ নানাজাতের সেমাই, পুড়িং, কেক ইত্যাদি। সময়ের বিবর্তনে তাতেও আজকাল ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়; এখন মিষ্টির তালিকা সংকুচিত হয়ে ঝালের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সমধিক বলেই মনে হয়। তাই ঈদের দিনের খাবার মেন্যুতে দেখা যায় নুডলস, ছোলা, পোলাও-বিরিয়ানির মতো ভারী খাবার। সেই সাথে রসনায়ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় দেখা যায়, নানাজাতের বাদাম, ফ্রুটস এবং পানীয়ের হিড়িক। ক্ষেত্রবিশেষে শহুরে ঈদে নিষিদ্ধ পানীয়ের ব্যবহারের কথাও মাঝেমধ্যে কর্তকুহরে প্রতিধ্বনিত হয়। তবে শহরের ঈদ উদ্যাপন অনেকটা ভিন্ন আঙ্গিকের; সেখানে আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা কম বিধায় বন্ধু-বান্ধব, অফিস কলিগ, রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের বাসা-বাড়িতে যাওয়া-আসা হয়। সেখানকার আতিথেয়তার ধরণ-মাত্রাও বেশ জৌলুশপূর্ণ হয়ে থাকে।
অবশ্য আধুুুনিকতা পেরিয়ে উত্তরাধুনিকের একালে বেশ অশনি নিদর্শনও দৃশ্যমান হয়ে ওঠছে। একসময় কিশোর, তরুণ-তরুণীগণ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য কি যে উদগ্রীব ছিলো তা আর পরিলক্ষিত হয় না। কোনোমতে ঈদ জামাত শেষ করে মোবাইল কিংবা অন্য যে-কোনো ডিভাইস ব্রাউজিং-এ বুঁদ হয়ে থাকে। না আছে আত্মীয়তার সম্পর্কের অনুভ‚তি না আছে তার ব্যাপারে কোনো আবেগ-আগ্রহ, বরং যান্ত্রিক বিধ্বংসী যন্ত্রটিই তার জীবন হয়ে ওঠছে! গ্রামের নিষ্কলুষ পরিবেশও আজ দেখা যায় ঈদেও পূণ্য ঐতিহ্য শূন্য হতে চলেছে; গ্রামের টংদোকান, পুকুরঘাট, বটতলা ইত্যাদি জায়গায় দেখা যায়- জটলা, হাতে তাসের সেট, সামনে জুয়ার বেটে ছড়ানো ছিটানো টাকার বান্ডিল। একইভাবে দেখা যায়- ক্যারাম, মার্বেল ইত্যাদির খেলা, পশ্চাতে জুয়ার মেলা! তবুও ভ্রাতৃত্ব-হৃদ্যতা-সৌহার্দ্যরে বার্তাবাহী ঈদ ইসলামের অন্তর্নিহীত সৌন্দর্যবোধের প্রকাশের মাধ্যমে মানবতা ও মানবসত্ত্বার পূর্ণ বিকাশ সাধনের অন্যতম অনুঘটক। ঈদ সবার জীবনে বয়ে দিক খুশি-আনন্দ ও শান্তি-সুখের ফল্গুধারা। যেনো আসমানি তাগিদে সবাই পূতঃপবিত্র হয়ে উঠি-
ও মন রমযানেরই রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ…