ঈদে মিলাদুন্নবীর (দ.) ও ইসলামি সংস্কৃতির জাগরণ

1

 

প্রিয় নবী রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর শুভাগমনের মধ্য দিয়ে সমস্ত আঁধার বর্বরতা অরাজকতা তিরোহিত হয়ে মানবজাতির মধ্যে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির নজির সৃষ্টি হয়েছে। দেশে দেশে মানুষে মানুষে চলা যুদ্ধ সংঘাত হানাহানির পথ রুদ্র হয়েছে মহানবীর (দ) শুভাগমনের উসিলায়। সবচেয়ে বর্বর নিকৃষ্ট আরবের মানুষেরা মহানবীর (দ) প্রাণস্পর্শে সোনার খাঁটি মানুষে পরিণত হয়েছে। মাত্র কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় এবং আল্লাহর করুণায় লাখো লাখো আলোকিত মানুষ তৈরি হয়েছে পুরো আরবের জমিনে। যাঁদেরকে আমরা বলি উম্মতশ্রেষ্ঠ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী ও তবয়ে তাবেয়ীগণ। প্রিয় নবীর (দ) তিরোধান পরবর্তী সময়ে ত্রিশ বছর ধরে আরবের জমিনে ন্যায় ও ইনসাফের শাসন ও মানবিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন প্রিয় নবীর (দ) সোহবত ও সাহচর্যধন্য খোলাফায়ে রাশেদীন। এঁরা সকলেই ছিলেন মহান সাহাবায়ে কেরাম।
মহানবীর (দ) প্রবর্তিত ইসলাম যেমন সর্বকালের সর্বযুগের মানুষের জন্য প্রযোজ্য, ঠিক তেমনি প্রিয় নবীর (দ) রহমত ও করুণা সব সময় চলমান বহমান মানবসৃষ্টির সূচনা থেকে এবং থাকবে অনাদিকাল ধরে। আল্লাহ পাক কুরআন মজিদে বলছেনÑ ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন। অর্থাৎ হে রাসূল! আমি আপনাকে সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি। সত্যি প্রিয় নবীজীর (দ) শুভাগমন সৃষ্টিকুলের জন্য আল্লাহ পাকের বিশেষ রহমত।
বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ) মানে জশনে জুলুস উৎসব। চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ সারা দেশে নানা দরবার, খানকাহ, পীর মাশায়েখ, মাদ্রাসা ও দ্বীনি নানা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এই রবিউল আউয়াল মাসজুড়ে জশনে জুলস পালিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম-ঢাকার জশনে জুলুসে শামিল হন লাখো লাখো নবী-ওলীপ্রেমী ছাত্র উলামা জনতা তথা সর্বস্তরের অগণিত মানুষ। গাউসে জমান অলিয়ে কামেল রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত হযরতুল আল্লামা শাহসূফী হাফেজ সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ) এর নির্দেশে চট্টগ্রাম বলুয়ারদীঘি খানকাহ থেকে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম শাহসূফী নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর (রহ.) নেতৃত্বে জশনে জুলুস বের করা হয়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬ সন পর্যন্ত লাগাতার দশ বছর ধরে জশনে জুলুসের নেতৃত্বে দেন গাউসে জমান আল্লামা হাফেজ সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ)। এরপর থেকে দু’একবছর ছাড়া প্রায় ৩২/৩৩ বছর ধরে জশনে জুলুসের নেতৃত্ব দেন রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত হযরতুল আল্লামা শাহসূফী সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ (মজিআ)। এবার ঢাকা-চট্টগ্রামে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জশনে জুলুসের নেতৃত্ব দেবেন আওলাদে রাসূল (দ.) রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত পীরে বাঙাল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ (মজিআ)।
১৯৮৮ সন থেকে ২০১১ সনে ওফাতের আগ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে জশনে জুলুসের নেতৃত্ব দেন আওলাদে রাসূল (দ) শায়খুল ইসলাম হযরত শাহসূফী আল্লামা সাইয়্যিদ মইনুদ্দীন আহমদ আলহাসানী (ক)। তাঁর ওফাতের পর থেকে ঢাকার জশনে জুলুসে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তাঁরই খেলাফতপ্রাপ্ত একমাত্র শাহসূফী মাওলানা সাইয়্যিদ সাইফুদ্দীন আহমদ আলহাসানী আল মাইজভাÐারী (মজিআ)।
চট্টগ্রামের বায়েজিদ কুলগাঁও দরবারে হাশেমীয়া আলিয়া শরিফে শায়খুল ইসলাম উস্তাজুল উলামা ইমামে আহলে সুন্নাত শাহসূফী আল্লামা কাযী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ) সূচিত রবিউল আউয়াল মাসে ১২ দিনব্যাপী ঈদে মিলাদুন্নবী (দ) শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার এবছরসহ টানা সাড়ে চার দশক ধরে শানদার আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এছাড়াও ঢাকায় মাইজভান্ডার দরবার শরিফ গাউসিয়া রহমান মঞ্জিলের সাজ্জাদানশিন পীরে তরিকত মাওলানা সৈয়দ মুজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর নেতৃত্বে, নারায়ণগঞ্জে ইমামে রব্বানি দরবার শরিফের সাজ্জাদানশিন পীরে তরিকত মাওলানা সৈয়দ বাহাদুর শাহ মুজাদ্দেদীর নেতৃত্বে, চট্টগ্রাম বোয়ালখালী আহলা দরবার শরিফের সাজ্জাদানশিন পীরে তরিকত হযরত শাহসূফী সৈয়দ আবরার ইবনে শেহাব এর নেতৃত্বে ঢাকায় জশনে জুলুস আয়োজন করা হয় প্রতি বছর। চট্টগ্রাম বোয়ালখালী চরণদ্বীপ দরবার শরিফের সাজ্জাদানশিন উস্তাজুল উলামা বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন পীরে তরিকত আল্লামা মুফতি ইদরিস রজভীর (রহ) নেতৃত্বে প্রতি বছর জশনে জুলুস বের করা হতো। এখন তিনি বেঁচে নেই। এ বছর তাঁরই ছাহেবজাদা পীরে তরিকত মাওলানা আতাউল মুস্তফা রজভী ও অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ শোয়ায়েব রেজার নেতৃত্বে চরণদ্বীপে জশনে জুলুসের আয়োজন করা হবে বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি সৈয়দবাড়ি দরবার শরিফের সাজ্জাদানশিন পীরে তরিকত আল্লামা সৈয়দ মছিহুদ্দৌলার নেতৃত্বে বড় আকারে জশনে জুলুস বের করা হয়। চট্টগ্রাম বায়েজিদ আল আমিন হাশেমী দরবার শরিফের সাজ্জাদানশিন ও আনজুমানে আশেকানে মোস্তফা (দ) বাংলাদেশ এর সভাপতি পীরে তরিকত আল্লামা কাযী মুহাম্মদ ছাদেকুর রহমান হাশেমীর সভাপতিত্বে বায়েজিদে হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) দরগাহ প্রাঙ্গণে এবার ১২ দিন ব্যাপী ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হাটহাজারী ছিপাতলী জামেয়া গাউছিয়া মুঈনীয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পীরে তরিকত আল্লামা আবুল ফরাহ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিনের নেতৃত্বে ১২ রবিউল আউয়াল জশনে জুলুস বের করা হয়। প্রতি বছরের মতো এবারো চট্টগ্রাম চান্দগাঁও বারীয়া দরবার শরিফের সাজ্জাদানশিন পীরে তরিকত শাহসূফী মাওলানা সৈয়দ বদরুদ্দোজা বারীর নেতৃত্বে আনোয়ারা উপজেলায় পালিত হবে জশনে জুলুস। এতে হাজার হাজার দ্বীনদার সুন্নি জনতা অংশ নেন। চট্টগ্রাম রাঙ্গুনিয়া দরবার-এ-বেতাগী আস্তানা শরিফের সাজ্জাদানশিন পীরে তরিকত শাহসূফী মাওলানা গোলামুর রহমান আশরফ শাহ এর নেতৃত্বে ১৩ রবিউল আউয়াল তারিখে (২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টায়) এবারো ১১১তম জশনে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) জুলুস বের করা হবে।
চন্দনাইশ জাহাঁগিরিয়া দরবার শরিফ থেকেও জশনে জুলুস বের করা হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ জশনে জুলুসের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন সাতকানিয়া ধর্মপুর দরবার শরিফের সাজ্জাদানশিন পীরে তরিকত আল্লামা আবদুস শাকুর নকশবন্দী। চন্দনাইশ জামিরজুরি রজভীয়া আজিজিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল্লামা মুফতি আহমদ হোসাইন আলকাদেরীর নেতৃত্বেও জশনে জুলুসে হাজার হাজার সুন্নি জনতা শরিক হন। পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং কক্সবাজার জেলায়ও বর্ণাঢ্য আয়োজনে জশনে জুলুস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে প্রতি বছর।
ঈদে মিলাদুন্নবী (দ) শরিয়তসম্মত পন্থায় নানাভাবে উদযাপন করা যায়। জশনে জুলুস, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও জিয়াফত আয়োজনের মাধ্যমে প্রিয় নবী (দ) কে স্মরণ করা সর্বোত্তম পন্থা। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) বলেন, যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী (দ) মাহফিলে এক দেরহাম বা একটি টাকা খরচ করবে সে ব্যক্তি আমি আবু বকরের সঙ্গে বেহেশতে থাকবে। হযরত ওমর ফারুক (রা) বলেন, যে ব্যক্তি ইজ্জত সম্মানের সাথে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ) উদযাপন করবে সে যেন গোটা ইসলামকে জিন্দা রাখলো। হযরত আলী (রা) বলেন, যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবীকে সম্মান প্রদর্শন করবে সে ব্যক্তি ঈমানদার হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। অতএব, ঈদে মিলাদুন্নবী (দ) উদযাপনের মাধ্যমে আমরা আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও প্রিয় নবীর (দ.) শাফায়াত লাভে ধন্য হতে পারি।

লেখক : সাংবাদিক