ঈদের পর করোনা ‘ভয়াবহ রূপ’ নেওয়ার আশঙ্কা

67

ঈদুল ফিতরকে ঘিরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে বিপুলসংখ্যাক মানুষ যেভাবে চলাফেরা করছে, এতে ঈদের দুই সপ্তাহের মধ্যে করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। সেই সাথে যদি ইন্ডিয়ার ভেরিয়েন্ট সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, তাহলে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
এদিকে দেশে করোনা ভাইরাসের যে ভয়াবহ সংক্রমণ চলছে তা বোঝার কোনো উপায়ই নেই। গত কয়েকদিন ধরে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গ্রামের উদ্দেশ্যে পথে পথে লাখো মানুষের ঢল নেমেছে। ঈদের কেনাকাটা করতে দোকানপাট ও শপিংমলে দেখা যাচ্ছে উপচেপড়া ভিড়। রাস্তাঘাটে, অলিতে-গলিতে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে ইচ্ছেমতো। কেউ মাস্ক পরছে না, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।
গত সোমবার এক সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে মানুষের অবাধে চলাফেরার কারণে ঈদের পর দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি ভারত ও নেপালের মতো ভয়াবহ হতে পারে।
চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন, ঈদের পর দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে- যা হবে ভয়াবহ। তখন ডাক্তার-নার্সের সংকট সৃষ্টি হবে। ব্যাহত হবে চিকিৎসাসেবা। পরিস্থিতি ভারতের চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে। দেখা দেবে অক্সিজেনের ভয়াবহ সংকট। যেখানে সেখানে চিকিৎসার অভাবে রোগীরা মারা যাবে।
তারা বলেন, যখন ইউরোপের দেশ ইতালিতে প্রথম ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন পাশের দেশ স্পেনের মানুষ ভেবেছিল এটা ইতালির সমস্যা। তাদের কিছু হবে না। এরপর একটা সময় দেখা গেল ইতালির চেয়ে স্পেনের অবস্থাই বেশি খারাপ হয়েছে। যখন ফ্রান্স তাদের নাগরিকদের হাসপাতালে জায়গা দিতে পারছিল না, প্রতিদিন শত শত মানুষের মৃত্যু হচ্ছিল তখন পাশের দেশ ইংল্যান্ড ভেবেছিল এটা ফ্রান্সের সমস্যা। তাদের কিছু হবে না। ঠিক ২ সপ্তাহ পর ইংল্যান্ডের অবস্থা ফ্রান্সের চেয়ে খারাপ হয়ে যায়। আবার আমেরিকার অবস্থা খারাপ হওয়ার পর তার পাশের দেশ মেক্সিকোর অবস্থা এখন এতটাই খারাপ, ওরা শেষকৃত্য করার জায়গা পর্যন্ত দিতে পারছে না। অথচ সপ্তাহ দুয়েক আগে সতর্ক হয়ে সঠিক প্রস্তুতি নিলে এসব দেশে যারা মারা গেছেন তার অর্ধেক মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হতো।
বর্তমানে ভারতে প্রতিদিন মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। হাসপাতালগুলো অক্সিজেন দিতে পারছে না। দলে দলে মানুষ হাসপাতালের সামনে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। ভারতের পাশের দেশ হিসাবে আমরা যদি ভেবে থাকি আমাদের কিছু হবে না তাহলে আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি। ভাইরাস পরিস্থিতি যে দেশেই অনেক খারাপ হয়েছে পরে তার পাশের দেশে এর প্রভাব পড়েছে তার চেয়ে ভয়াবহ। কারণ তারা নিজেরা প্রস্তুতি না নিয়ে অবহেলা করেছে।
তারা বলেন, তাই সময় থাকতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে হবে। অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। ভারতীয় নতুন ভ্যারিয়েন্টের ঢেউ যদি শেষ পর্যন্ত না আসে তাহলে ভালো। তবে এসে পড়লে সেটি হবে আরও ভয়াবহ। কারণ এ পর্যন্ত করোনার যতগুলো ভ্যারিয়েন্ট তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ভারতের ভেরিয়েন্টটি।
করোনা মোকাবিলায় স্বাচিপ গঠিত কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়ক আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, এখন যেভাবে চলছে তাতে একটা নতুন ধরনের মিশ্রণ সৃষ্টি হবে। মার্কেট ও শপিংমলে মানুষের ঢল এখানে কে সংক্রমিত করছে কেউ জানে না, এ কারণে নিরবে সবার মাঝে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে। দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি মার্কেটে মোটেও মানা হচ্ছে না। আর মার্কেটে সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়টি হলো- বাচ্চা ও বয়স্করা সেখানে যাচ্ছে। এছাড়া ঈদে শহর থেকে ঘরমুখো মানুষগুলো বড় ধরনের বিপযর্ষ ডেকে আনবে। তারা জানে কিংবা জানে না নিজেরা সংক্রমিত। একারণে গ্রামের অনেকইে সংক্রমিত হয়ে আবার শহরে আসবে।
তিনি বলেন, এখন সবখানে যে সংমিশ্রণ হচ্ছে এটার প্রতিবিম্ব দেখা যাবে ঈদের দুই সপ্তাহের মধ্যে। এর মধ্যে আরও ভয়ংকর বিষয়টি হলো- ইন্ডিয়ার ভেরিয়েন্ট। এই ভেরিয়েন্টের সংক্রণের ক্ষমতা অনেকগুণ বেশি। এর মধ্যে যদি এই সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় তাহলে অনেক বড় ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।
সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, যদি করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়, তাহলে লাফিয়ে লাফিয়ে সংক্রমণ বাড়ে। এখন সংক্রমণের হার অনেকটাই কমে এসেছে। তবে গণপরিবহন ও শপিংমল-মার্কেটসহ সবকিছু স্বাভাবিক করে দেওয়ায় সংক্রমণ তীব্রতা আবার বাড়তে পারে। যা ঈদের ১০ থেকে ১২ দিন পর পরিস্থিতি বোঝা যাবে। তাই টিকা নেওয়ার পাশাপাশি সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ মাস্ক ব্যবহারে শতকরা ৯০ ভাগ করোনা ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে জানান সিভিল সার্জন।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আবদুর রব বলেন, করোনা ভাইরাস দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। লকডাউন পার্মানেন্ট কোন সমাধান নয়। এখানে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। বেশিদিন লকডাউন চললে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরী হতে পারে। কভিড চিকিৎসায় প্রতিদিন সরকারের হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এভাবে আসলে আর কতদিন চলবে? ইতিমধ্যে চিকিৎসক, নার্স আর স্বাস্থ্যকর্মীরা হাপিয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, আমার কাছে শুধু একটা সমাধান ই আছে। তা হল, প্রিভেনশন। একমাত্র প্রিভেনশন। শতভাগ মাস্ক ব্যাবহার নিশ্চিতকরণ। কভিড চিকিৎসায় হাজার কোটি টাকা খরচ না করে, সরকারের উচিৎ সবার জন্য ফ্রি মাস্কের ব্যবস্থা করা। প্রতিদিন যারা মাস্ক ছাড়া বের হবে, তাদেরকে অতিদ্রুত মাস্ক সরবরাহ করা এবং প্রতিটা জায়গায় শতভাগ মানুষের মাস্ক ব্যাবহার নিশ্চিত করা। তাহলেই ৯৫ ভাগ সংক্রমণ কমে যাবে।