ঈদের আনন্দ ধনী-গরিব ভাগাভাগি করে নিন

35

 

রোজার শেষেই আসছে অনাবিল হাসি-আনন্দের ঈদ। এখন থেকেই ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে ঈদের আমেজ। শাওয়াল মাসের ঈদের চাঁদ উদিত হওয়ার অপেক্ষায় আছেন দেশের সর্বস্তরের মুসলিম জনতা। ঈদের আনন্দে শামিল হতে রোজার মাসের শুরু থেকেই বিত্তবানরা নানা ধরনের কেনাকাটায় ব্যস্ত আছেন। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে রোজা ও ঈদ ত্যাগ ও আত্মসংযমের বার্তা নিয়ে এলেও ঘরে ঘরে ঈদের খুশি, রোজার ব্যতিক্রমী অনুভ‚তি সবাইকে স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। মানুষে মানুষে মেলাতে, একে অপরের সাথে মানবিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার যে বার্তা ও আহবান নিয়ে রোজা এবং ঈদ আসে বছর ঘুরে, তা সবাই সমভাবে উপভোগ-উপলব্ধি করতে পারে জোর দিয়ে এই দাবি করা যায় না। বরং এই রোজা ও ঈদ গরিব, ভাগ্য বিড়ম্বিত, অভাবী মানুষের জন্য অনেক সময় বিষাদতুল্য ঠেকে এক শ্রেণীর বিত্তবানদের ভোগবাদী জীবনদৃষ্টির কারণেই। ঈদ মানে সর্বজনীন আনন্দোৎসব। ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন জীবনবোধে সমৃদ্ধ হওয়ার প্রেরণার নামই রোজা। অথচ আমাদের এই প্রিয় স্বদেশে চারপাশে আমরা কী দেখছি? ত্যাগ ছেড়ে, আত্মশুদ্ধির পথ ছেড়ে বস্তুমোহে, বিলাসী জীবনে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মহোৎসব যেন চলে রোজা-ঈদ মৌসুমে। রোজা ও ঈদের আনন্দ মুষ্টিমেয় ভাগ্যবান বিত্তবানরাই দু’হাতে লুফে নিচ্ছে। এ কেমন ত্যাগ, এটাই সংযম আমাদের? এই রোজার মাসেও অপচয়-বিলাসিতা যেন থামছেই না। রোজার মাসে বিত্তবানরা অধিক কেনাকাটায় মেতে থাকায় বাড়ে ভোগ্যপণ্যসহ নানা পণ্যের দাম। ফলে ভোগান্তি বাড়ে গরিবদের। যাদের থাকে না ক্রয় ক্ষমতা টাকার জোরে ধনীরা ভোগ উৎসবে মত্ত থাকে। শক্তিমান-বিত্তবানদের দাপটে-উপহাসে গরিব মানুষগুলোর চোখে-মুখে আজ হাসি নেই। এদের আনন্দ-খুশি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। লাখ দেড় লাখ টাকা দামের হাজারো লেহেঙ্গা এই ঈদে ধনীরা প্রতিদিনই হজম করে নিচ্ছে। ঈদকে বিলাস জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে ধরে নিয়ে বাহারি পণ্য ক্রয়ের উৎসবে ধনীরা মেতে আছে মাসজুড়ে। অথচ তাঁর আশপাশের শত শত গরিব অভাবী মানুষ নিজ স্ত্রীর জন্য এখনো শ’তিনশ টাকা দামের একটি শাড়ি, নিজের জন্য একটি সাধারণ লুঙ্গি, বাচ্চাদের জন্য কমদামের প্যান্ট-শার্ট কেনার সামর্থ্যও রাখে না। লাখ-পাঁচ লাখ টাকার বাজেট নিয়ে কোমর বেঁধে নেমে ঈদের আনন্দের সবটুকুই ধনীরা লুফে নেয়। অন্যদিকে গরিব মানুষেরা এই ঈদে জনপ্রতি একটি নিম্নমানের পোশাকও কিনতে পারে না। দারিদ্র্যের সীমাহীন কশাঘাতে ওরা জর্জরিত। ওরা বিপন্ন। ওরা অধিকার হারা। তবুও এই অভাবী দুস্থ মানুষের দিকে ধনীদের সহানুভ‚তির দৃষ্টি পড়ে না। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা, ভোগ-বিলাসে ডুবে থাকার নামই কী রোজার সংযম, ঈদের চেতনা ও শিক্ষা? প্রিয়নবী (দ.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজে পেট পুরে খায়, অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধায় কাতর থাকে সে তো আমার উম্মতের দলভুক্ত নয়’।
এখানে প্রিয়নবী (দ.) বলেছেন একজন সচ্ছল ব্যক্তিকে তার প্রতিবেশীর প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবেশী সে মুসলিম বা অন্য ধর্মাবলম্বী যেই হোক না কেন। বলা হয়েছে প্রতিবেশীর কথা। প্রতিবেশী সে যে ধর্মের, গোত্রেরই অন্তর্ভুক্ত হোক তার দুর্দশায়- দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানোর কড়া নির্দেশনা স্বয়ং নবীজীর (দ.)। তাহলে যে বিত্তবান মানুষগুলো লাখ টাকা দামের লেহেঙ্গা কিনে কৃত্রিমভাবে ঈদের আনন্দের ষোলোকলা পূর্ণ করছে, তার পাশের দরিদ্র পরিবার অভাবে-কষ্টে ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারছে না- ওই পরিবারটির দিকে চোখ মেলে তাকানোর, সহানুভূতি-সহমর্মিতা দেখানো খুব জরুরি নয় কি? দেশ ও সমাজের সবাইকে হাশি-খুশিতে রাখাই তো বিত্তবান, সমাজপতি ও সরকারের নৈতিক-ধর্মীয় দায়িত্ব। খলিফাতুর রসুল ইসলামের সোনালি দিনের ন্যায়নিষ্ঠ শাসক হযরত ওমর (রা.) রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন- ‘শুধু কোনো মানুষ নয়, আমার শাসনের আওতাভুক্ত ফোরাত নদীর তীরে একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মরে তাহলে আমি ওমরকে আল্লাহর কাছে দায়িত্বে গাফলতির জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এর জন্য আমি ওমরই দায়ী থাকবো’। এই হচ্ছে ইসলামের জীবন দর্শন। সাহাবায়ে কেরামের দায়িত্বনিষ্ঠা ও ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই একটি বাণী থেকে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গের, নেতৃত্বের বহু কিছু শেখার আছে। একেই বলে প্রজাবাৎসল্য, মানবতাবোধ ও ইনসাফ। নিজে যথেচ্ছ খেয়ে দেয়ে নিশ্চিন্তে কাটানোর মোহ, খুব দামি পোশাকে ঈদ করার যে অভীপ্সা-আকাক্সক্ষা তা তখনই সার্থক ও পরিপূর্ণ হয় যখন চারপাশের মানুষেরাও একই মানের না হলেও কোনো রকম দিন চালানোর ভরসা পায়, ঈদ উদযাপনের আনন্দে শামিল হবার যদি সুযোগ পায়।
অবর্ণনীয় কষ্টে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হওয়া নদীভাঙনে গৃহহারা, ছিন্নমূল পথ শিশুদের দিকে এই ঈদে একটু নজর দিন। তাদের প্রয়োজন পূরণ করুন। এই ঈদে তাদের নতুন জামা-কাপড় কিনে দিন। গরিব পরিবারগুলোকে সেমাই চিনি ছোলা কিনে দিয়ে তাদেরও ঈদের আনন্দে শামিল হবার সুযোগ দিন। সঠিকভাবে হিসাব করে জাকাত দিয়ে গরিব মানুষগুলোর ভাগ্য বদলে দিন। গরিব মানুষের সুখে-দুঃখে সমব্যথী হোন। এই মানবিক দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র, বিদ্বান-বিত্তবান সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভ‚মিকা রাখতে হবে। তৃণমূলের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের চোখে-মুখেও থাকে যেন ঈদের হাসি, আনন্দের ঝিলিক। এটাই সিয়াম ও ঈদের অন্তর্নিহিত দর্শন ও আহবান। মনে রাখবেন নামাজ যেমন ফরজ, তেমনি জাকাতও ফরজ বিধান। জাকাত না দিলে তার নামাজও কবুল হবে না। গরিব খুঁজে খুঁজে জাকাতের টাকা বণ্টন করে মানবিক দায়িত্ব পালন করুন। ঈদের আনন্দ গরিব-ধনী সবাই ভাগাভাগি করে নিন।
লেখক: প্রধান উপদেষ্টা, নিকাহ্ রেজিস্ট্রার কল্যাণ সংস্থা চট্টগ্রাম