ইয়াবা কারবারীদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক

56

কক্সবাজারে জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাংবাদিকদের মধ্যস্থতায় চলছে ইয়াবা কারবারীদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া। ইয়াবা কারবারীদের সম্ভাব্য আত্মসমর্পণ ঘিরে জেলাব্যাপী চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এ প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
সমালোচকদের মতে, ইয়াবা কারবারীরা জীবন রক্ষায় পুলিশ হেফাজতে যাচ্ছে। যেটি নিয়ে এতো বিতর্ক সে কাজটি সফল করতে ভূমিকা রাখছেন বেসরকারী টেলিভিশনের এক সাংবাদিক। তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন ইয়াবা সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সারাদেশে আলোচিত সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। ইয়াবা কারবারীদের আত্মসমর্পণ করাতে প্রাণান্তকর কষ্ট করছেন তিনি। তার ব্যক্তিগত চেষ্টায় অনেক ইয়াবা কারবারীকে বিদেশ থেকেও দেশে ফিরিয়েছেন তিনি। বদির এ অতিউৎসাহী ভূমিকাকেও অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। কি হচ্ছে তা নিয়েও মানুষের মধ্যে বাড়ছে কৌতূহল। কেউ কেউ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বেশির ভাগ মানুষের দৃষ্টিতে এ প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ।
তাদের মতে, ইয়াবা কানেকশনের অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথিত ক্রসফায়ারে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছে। যেখানে টেকনাফ পৌরসভার জনপ্রিয় কাউন্সিলর একরামুল হকের মতো কিছু নিরপরাধ লোকও বলি হয়েছেন। সেখানে একই অভিযোগে অভিযুক্ত ইয়াবা কারবারীদের মতো ঘৃণ্য অপরাধীদের আত্মসমর্পণের সুযোগ করে দেয়া হাস্যকর সিদ্ধান্ত। আবার অনেকে এটিকে দূরভিসন্ধিমূলক বলেও মন্তব্য করেন। সম্ভাব্য আত্মসমর্পণ ঘিরে কক্সবাজারজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা। চুনোপুঁটি পাচারকারীদের অনেকেই বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়া আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত পাচারকারীদের অনেকেই জীবন রক্ষায় পুলিশ হেফাজতে যাওয়ায় কক্সবাজারের মানুষের মনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
তবে কক্সবাজার পুলিশের অতিরিক্ত সুপার ইকবাল হোসাইন বলেন, ইয়াবা নির্ম‚লে জিরো টলারেন্স নিয়ে কাজ করছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপরাধ স্বীকার করে কোন অপরাধী আত্মসমর্পণ করলে তাকে সুযোগ দেয়া উচিত।
তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত কোন ইয়াবা ব্যবসায়ীই আইনের আওতার বাইরে থাকতে পারবে না। যেভাবেই হোক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
আইনশৃংখলা বাহিনীর সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এ পর্যন্ত ৫১ শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী মারা গেছেন। প্রায় প্রতিদিনই একজন দু’জন করে ইয়াবা কারবারী ক্রসফায়ারে কিংবা নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারাচ্ছে। এ অবস্থায় ইয়াবা কারবারী এবং তাদের মদদদাতারা মৃত্যুর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। এর মাঝেও থেমে নেই ইয়াবা ব্যবসা। পাচারকালে গত এক সপ্তাহে প্রায় তিন লাখ ইয়াবাসহ কয়েকটি চালান আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে।
মাদক নির্মূলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে ইয়াবা কারবারীরা গ্রেপ্তার এড়াতে ও প্রাণ বাঁচাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে যায়। অনেকে বিদেশ পাড়ি জমায়। দেশের সকল জেলায় মাদকের অভিযান অব্যাহত থাকায় সেখানেও নিজেদের নিরাপদ রাখতে না পেরে আত্মসমর্পণের সুযোগ লুফে নেয় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। ইতোপূর্বে ইয়াবা ব্যবসা ছাড়তে সরকার ও আইনশৃংখলা বাহিনী বার বার তাগাদা দিলেও কান দেয় নি। কিন্তু বর্তমানে নিরূপায় হয়ে প্রাণ বাঁচাতে আইনশৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে চলে আসে বেশির ভাগ ইয়াবা কারবারী। এর মধ্যে রয়েছে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির তিন ভাই শফিকুল ইসলাম প্রকাশ শফিক, আবদুল আমিন, ফয়সাল রহমান ও বদির ভাগিনা সাহেদ রহমান নিপু এবং সাহেদ কামাল, টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ছেলে দিদার মিয়া ও টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর নুরুল বশর ওরফে নুরশাদ, হ্নীলা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের পশ্চিম লেদার নুরুল হুদা মেম্বার, ৭নং ওয়ার্ডের আলী খালির জামাল মেম্বার, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের নাজিরপাড়ার এনামুল হক মেম্বার, সাবরাংয়ের মোয়াজ্জেম হোসেন প্রকাশ ধানু মেম্বার, শাহপরীর দ্বীপের রেজাউল করিম মেম্বার, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের আলী আহমদ চেয়ারম্যানের দুই ছেলে আবদুর রহমান ও জিয়াউর রহমান, হ্নীলার পশ্চিম সিকদার পাড়ার ছৈয়দ আহমদ, নাজিরপাড়ার আবদুর রহমান, পুরাতন পল্লান পাড়ার শাহ আলম, জাহাজপুরার নুরুল আলম, হ্নীলা পশ্চিম সিকদার পাড়ার রশিদ আহমদ, ওয়ালিয়াবাদের মারুফ বিন খলিল বাবু, মৌলভীপাড়ার একরাম হোসেন, মধ্যম ডেইল পাড়ার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, চৌধুরী পাড়ার মং সং থেইন প্রকাশ মমচি ও দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার জুবাইর হোসেন। এছাড়াও যে ৩৮ শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী সেফ হোমে রয়েছেন তারা হলেন হ্নীলা পূর্ব পানখালীর নজরুল ইসলাম, পশ্চিম লেদার নুরুল কবীর, নাজিরপাড়ার সৈয়দ হোছন, নাইটং পাড়ার মো. ইউনুচ, সাবরাং আলীর ডেইলের জাফর আহমদ, হ্নীলা ফুলের ডেইলের রুস্তম আলী, শামলাপুর জুমপাড়ার শফিউল্লাহ, একই এলাকার ছৈয়দ আলম, উত্তরলম্বরীর আবদুল করিম প্রকাশ করিম মাঝি, রাজারছড়ার আবদুল কুদ্দুছ, জাহেলিয়া পাড়ার মো. সিরাজ, সাবরাংয়ের আবদুল হামিদ, নাজিরপাড়ার মো. রফিক, নতুন পল্লান পাড়ার মো. সেলিম, নাইট্যংপাড়ার মো. রহিম উল্লাহ, নাজির পাড়ার মো. হেলাল, চৌধুরী পাড়ার মোহাম্মদ আলম, তুলাতলীর নুরুল বশর, হাতিয়াঘোনার দিল মোহাম্মদ, একই এলাকার মোহাম্মদ হাছন, দক্ষিণ নয়াপাড়ার নুর মোহাম্মদ, সদর কচুবনিয়ার বদিউর রহমান, পূর্ব লেদার জাহাঙ্গীর আলম, মধ্যম জালিয়া পাড়ার মোজাম্মেল হক, ডেইল পাড়ার আবদুল আমিন, উত্তর আলী খালীর শাহ আজম, দক্ষিণ নয়াপাড়ার আলমগীর ফয়সাল, সাবরাং ডেইল পাড়ার মো. সাকের মিয়া, সাবরাংয়ের আলী আহমদ, উত্তর শীলখালীর মো. আবু ছৈয়দ, হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুরার মোহাম্মদ হাসান আবদুল্লাহ, রাজার ছড়ার হোসেন আলী, সাবরাং নয়াপাড়ার মো. তৈয়ব, উত্তর জালিয়া পাড়ার নুরুল বশর মিজি, নাজির পাড়ার জামাল হোসেন, মৌলভী পাড়ার মো. আলী ও এই এলাকার আবদুল গনি।
এদিকে কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ইয়াবা ব্যবসায়ীর সবশেষ তালিকার ১ হাজার ১৫১ জনের মধ্যেও এদের সবারই নাম রয়েছে।
অপরদিকে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা নিজেদের সমর্পণ করায় সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে সাধারণ মানুষের মাঝে কৌতূহল দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাধারণ ক্ষমা করলেও তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পক্ষে সাধারণ মানুষসহ সচেতন মহল। আবার অনেকে দেশের প্রচলিত আইনে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, যেসব ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, তাদের নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। ঠিক কতজন ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করবে, তা এখনো চ‚ড়ান্ত হয়নি।
তিনি বলেন, যারা আত্মসমর্পণ করবে, তাদের ওপর পুলিশের নজরদারি কবে। আত্মসমর্পণের সুযোগ পাওয়ার পরও যদি কোন ব্যক্তি পূর্বের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তখন পুলিশ আরও কঠোর হবে।