ইয়াবার রুটেই আসছে ‘বার্মিজ’ স্বর্ণের বারও

14

তুষার দেব

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশি মিয়ানমার থেকে কেবল মাদকই নয়, ‘বার্মিজ’ স্বর্ণের বারও দেশে আসছে। আন্তর্জাতিক চোরকারবারি চক্র ইয়াবা পাচারের প্রধানতম এই রুটকে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের সাথে বার্মিজ স্বর্ণের বার চোরাচালানের জন্যও বেছে নিয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে কোস্ট গার্ড ও শুল্ক গোয়েন্দার যৌথ দলের হাতে দুই কেজির বেশি ওজনের ‘বার্মিজ’ স্বর্ণের বারের একটি চালান জব্দের পর কাস্টমস গোয়েন্দাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা এমনটি মনে করছেন।
দেশের বাজারে জুয়েলারি ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, বিমানবন্দর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ইউএইসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চোরাপথে আসা স্বর্ণের বারের সাথে বার্মিজ স্বর্ণের বারের তফাৎ রয়েছে। প্রায়সময় বিমানবন্দরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে চোরাপথে নিয়ে আসার পর জব্দ হওয়া স্বর্ণের বারগুলোর প্রতিটির ওজন থাকে ১০ তোলা বা ১১ দশমিক ৬৬ গ্রাম। কিন্তু সেই তুলনায় বার্মিজ স্বর্ণের বারগুলো অনেক বেশি ভারি। সাধারণত এগুলোর প্রতিটির ওজন থাকে দেড়শ’ গ্রামের উপরে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর টেকনাফ সদর ইউনিয়নের বরইতলীতে কোস্ট গার্ডের হাতে জব্দ হওয়া ১৩টি বার্মিজ স্বর্ণের বারের ওজন হচ্ছে দুই কেজি একশ’ ৫৯ দশমিক ৪৩ গ্রাম। তার মানে প্রতিটি স্বর্ণের বারের ওজন একশ’ ৬৬ দশমিক ১১ গ্রাম। আকারেও এগুলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা স্বর্ণের বারের তুলনায় কিছুটা লম্বাটে। তবে ভিন্ন দেশ থেকে চোরাপথে এসব স্বর্ণ দেশে আসলেও সেগুলোর গন্তব্য একই জায়গায় বলে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা মনে করেন। চোরাপথে আসা এসব স্বর্ণের বার দেশের জুয়েলারির বাজারে আসে না।
সীমান্ত কিংবা আকাশপথে বৈধ বা অবৈধ পন্থায় দেশে হরহামেশা নিয়ে আসা স্বর্ণের বার অলঙ্কারে রূপান্তরের মাধ্যমে ব্যবহারের উপযোগী করতে হলে সেগুলো দেশের বাজারে অর্থাৎ স্বর্ণের দোকানে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের দাবি, এসব স্বর্ণের বারের সিংহভাগই অলঙ্কারে রূপান্তর করার জন্য তাদের কাছে আসছে না। জুয়েলারি সমিতি (বাজুস)- এর চট্টগ্রাম শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্বপন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ব্যাগেজ রুলের আওতায় বা বৈধ পথে আনা স্বর্ণের সামান্য পরিমাণ হয়তো দেশের বাজারে আসতে পারে। তবে বাজারে চাহিদার তুলনায় এত বেশি পরিমাণে নিয়ে আসা স্বর্ণ আসলে কোথায় যাচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। বৈধ বা অবৈধ পথে কারা কী কারণে এত স্বর্ণের বার এনে মজুত করছে তাও পরিষ্কার নয়। আমাদের ধারণা, বিমানবন্দর বা দেশের সীমান্ত দিয়ে ভিন্ন ধরনের স্বর্ণের বার নিয়ে আসা হলেও এগুলোর গন্তব্য হয়তোবা একই জায়গায়। এক্ষেত্রে বিমানবন্দর বা দেশের সীমান্ত এলাকাকে স্বর্ণের বার পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।
টেকনাফ কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত সার্কেলের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাহমুদ হোসাইন মুরাদ পূর্বদেশকে বলেন, জব্দ হওয়া বার্মিজ স্বর্ণের বারের চালানটি সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে তুলনামূলক বড়। নিকট অতীতে সীমান্ত দিয়ে একসাথে ১৩টি স্বর্ণের বার জব্দ হয়নি। আমাদের ধারণা, আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি চক্র স্বর্ণের বার পাচারের জন্য এখন টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহারের জন্য বেছে নিয়ে থাকতে পারে। এ কারণে আমরা নিজেদের গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদারের পাশাপাশি সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে বাড়তি নজরদারি আরোপের জনস্য অনুরোধ করেছি।
কোস্ট গার্ড ও শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং থেকে শুরু করে বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার ওপার থেকে গত প্রায় এক মাস ধরে কামানোর গোলা বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দ শোনা গেলেও চোরাকারবারি চক্র বসে নেই। সময়-সুযোগমত তারা সীমান্তের ওপার থেকে জল ও স্থলপথে মাদকসহ চোরাই পণ্যের চালান এপারে তাদের ডেরায় নিয়ে আসছে। এর মধ্যে কোনও কোনও চালান আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা পড়ছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর দিবাগত গভীর রাতে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের বরইতলীতে কোস্ট গার্ড ও শুল্ক গোয়েন্দাদের যৌথ দল অভিযান পরিচালনা করে। এসময় হলুদ রংয়ের প্লাস্টিকের বস্তায় গুঁড়ের ভেতরে বিশেষ কায়দায় লুকানো ১৩টি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়েছে। তবে পাচারে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। কোস্ট গার্ডের টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো. আশিক আহমেদ জানান, অভিযান চলাকালে দিবাগত রাত দু’টার দিকে মিয়ানমার থেকে নাফ নদী হয়ে টেকনাফ স্থল বন্দরের দিকে একটি বোট আসতে দেখা যায়। ওই বোট থেকে এক ব্যক্তি একটি হলুদ রঙের বস্তা মাথায় নিয়ে বরইতলী প্যারাবনের ভিতর ঢোকে। তার গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়ায় কোস্ট গার্ড তাকে থামতে বলে। তখন ওই ব্যক্তি বস্তা ফেলে বরইতলীর গহীন পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়। পরে ওই বস্তায় তল্লাশি করে ৩০ কেজি বার্মিজ গুঁড়ের মধ্যে অভিনব কায়দায় লুকিয়ে রাখা মোট ২ কেজি একশ’ ৫৯ দশমিক ৪৩ গ্রাম ওজনের ১৩টি ‘বার্মিজ’ স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত স্বর্ণের আনুমানিক বাজারমূল্য এক কোটি ৫২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা হতে পারে।