ইসলাম ও স্বাধীনতা

48

বাঙালির গৌরবগাথা ইতিহাস চর্চা করলে একশ্রেণীর মানুষ বলেন, অতীতের কথা আলোচনা করে ভবিষ্যতের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করো না। আসলে যাদের অতীত অধ্যায় অন্ধকার তারাই অতীত চর্চায় কষ্ট পান। পবিত্র কোরআনে বর্তমান ও ভবিষ্যতের চেয়ে অতীতের আলোচনা অনেক বেশি। আ’দ, মাসুদ, আদম (আ.), মুসা (আ.), ইব্রাহিম (আ.) ইসা (আ.) নুহ (আ.)’র ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সুন্দর ভাবে। কোরআনের শিক্ষা হলো অতীতকে বারবার স্মরণ করো, অতীত হতে শিক্ষা অর্জন করে সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণ করো। যে জাতি অতীত ভুলে সে জাতি একটি মৃত জাতি। অতীত হতে আমরা বর্তমানে এসেছি এবং ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করবো। অতীতকে ভুলে যাওয়া মানে নিজের অস্থিত্বকে ভুলে যাওয়া।
পাকিস্তান এখনো যে দলটি শাসন করে, তার নাম ‘মুসলিম লীগ’। এই দলটির নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হয়। যে দলটি পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করে সেদলটি বাঙালিদের প্রতিষ্ঠিত একটি দল। ১৯০৬ সালে ঢাকার বুকে নবাব স্যার সলিম উল্লাহ’র নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই মুসলিম লীগ। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা বিষয়ে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় তাতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পাকিস্তান স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেননি, ভোট দিয়েছিলেন বাঙালিরাই। বাঙালির প্রতিষ্ঠিত দলের নেতৃত্বে, বাঙালির ভোটে যে পাকিস্তান অর্জিত, সে পাকিস্তান ১৯৭১ সালে বাঙালির ভাঙলো কেন, প্রশ্ন উত্থাপন হতে পারে। যারা (পশ্চিম পাকিস্তানি) পাকিস্তান চাননি, তারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রক্ষার জিহাদের ডাক দিল। যে জাতি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করলো সে জাতির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য গণতন্ত্র ও অর্থনীতির ওপর আক্রমণ করলো পাকিস্তানিরা। এ ধরনের শোষণ কোন জাতির উপর পৃথিবী নামক গ্রহটির মধ্যে হয়নি। পাকিস্তান ভাঙার জন্য সৃষ্টি করেনি বাঙালিরা, বাধ্য হয়ে ভাঙতে হলো। পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী পাকিস্তানিরাই, ভারত নয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিজয় অর্জন। বিজয়ী জাতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করলে পাকিস্তান বাঙতো না এবং আমাদের ভারতের সহযোগিতা নেওয়ার প্রয়োজনও হতো না।
শত জুলুমের মধ্যে পাকিস্তানিরা পবিত্র ইসলামকে ব্যবহার করতো ব্যাপক ভাবে। পাকিস্তানের বিরোধীতাকে ইসলামের বিরোধিতা বলে প্রচার চালিয়ে ধর্মকে করতো কলঙ্কিত। অথচ পাকিস্তানি নেতাদের চেয়ে বাঙালিরা ছিল অধিক ধর্মপ্রাণ। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে একজন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান আসেনি, যার লেবাস ইসলামী অথবা মুখে দাড়ি আছে। অথচ রাষ্ট্রটি ছিল পৃথিবীর বুকে প্রথম ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’। তাদের শাসকরা মদ নারী ভোগ করতো। খৃস্টানী সংস্কৃতি ছিল তাদের পছন্দ। আর আমরা বাঙালি সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলাম। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নার নিকট ইসলামের টুপিটা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যে ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধ হলো, তিনি তো মদ-নারী ভোগী ছিলেন। তার নেতৃত্বে অথচ একাত্তরে ‘জিহাদ’ হলো বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে। এই হলো তাদের ইসলামের নমুনা। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মদ জুয়া ঘোড়দৌড়ের মত অনৈসলামিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করেন।
মানুষকে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেছেন। করা হয়েছে সৃষ্টির সেরা বা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। সৃষ্টির মধ্যে জ্বীন এবং ইনসানকে দিয়েছে স্বাধীনতা। সহজে দাসত্ব তারা মানতে চায় না। থাকতে চায় না পরাধীন। স্বাধীনতা মানুষের খুবই প্রিয়। ইসলাম ধর্মে স্বাধীনতার গুরুত্ব ব্যাপক। স্বাধীনতা না থাকলে আল্লাহর দ্বীন পালন করা সম্ভব নয় বলে হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে জন্ম ভূমির মায়া ত্যাগ করে মক্কায় পাড়ি জমাতে হয়েছিল। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জন্মভূমি মক্কা হতে মদিনায় পাড়ি দিতে হয়েছিল। হযরত মুসা (আ.)কে নীল নদ পাড়ি দিয়ে একটি স্বাধীন জনপদ অনুসন্ধান করতে হয়েছিল। আমরা সে স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালে একটি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। এই যুদ্ধটিও প্রথম আমরা শুরু করিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকার বুকে ঘুমন্ত মানুষের ওপর পাকিস্তানি সৈনিকরা গুলি চালিয়ে গণগত্যার সূত্রপাত করে। বাঙালিরা চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের প্রতিবাদ শুরু করে। ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধবিগ্রহ হারাম কিন্তু চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের প্রতিরোধ করতে পারে আত্মরক্ষার জন্য। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে ৮০টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং শতাধিক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। একটি যুদ্ধও তিনি নিজের ইচ্ছায় করেননি, চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের প্রতিরোধ করেছেন, আত্মরক্ষার জন্য। ১৯৭১ সালে বাঙালিরা চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের প্রতিরোধ করে আত্মরক্ষার জন্য।
বীর মুক্তিযোদ্ধার শ্লোগান ছিল রণাঙ্গনে ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’। পাকিস্তানিরা সবক্ষেত্রে বাঙালিদের ওপর জুলুম করে শ্লোগান উচ্চারণ করলো, ‘তোমার আমার ঠিকানা, মক্কা মদীনা। একটি চরম অন্যায় যুদ্ধে তারা ধর্মকে নিয়ে আসলো। চিন্তা করুন , মদীনাওয়া কী এভাবে জুলুম করেছিল ? মক্কাওয়ালা কী জুলুমের পক্ষে ? নাউজুবিল্লাহ। যারা মানুষ হত্যা করলো তাদের নাম ছিল ‘আলবদর’ বা বদরের যুদ্ধের সৈনিক। বদরের যুদ্ধের সৈনিকদের আদর্শ কী ছিল, তারা কী অন্যায় করে, জুলুম করে হত্যা করেছিল ? তারা মক্কা, মদীনা, বদরকে অপমানিত ও কলঙ্কিত করলো। তারা আরো বলেছিল ‘ইয়ে মুসলমান কা ঈমান, কয়েম রহেগা পাকিস্তান’। না তাদের ঈমান ঠিক ছিল না, পাকিস্তান ১৯৭১ সালে কায়েম (প্রতিষ্ঠিত) থাকেনি। ভবিষ্যতে পাকিস্তান আবারও ভাঙতে পারে। বেলুচিস্তানে চলছে বর্তমান বড় ধরনের স্বাধীনতা আন্দোলন।
আমার কাছে কেউ যদি প্রশ্ন করে ১৯৭১‘র মুক্তিযুদ্ধের বড় সুফল কী ? আমি বলতে চাই, বড় সুফল হলো, আমরা আজ পাকিস্তান নামক এক ব্যর্থ রাষ্ট্রের অংশ নই। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের ‘স্বাধীনতা’। সুফল হলো বাংলাদেশ জঙ্গিবাদী ব্যর্থ রাষ্ট্র নয়। পাকিস্তানের মত বাংলাদেশের মসজিদে মসজিদে এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে হত্যা করে না। জঙ্গিবাদের কারণে পাকিস্তানে দুইশত মসজিদ বন্ধ হলেও বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোর দুয়ার সবার জন্য খোলা। মুসলমানদের সেরা বিজ্ঞানী আবদুল কাদির পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক অপরাধী। বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর বুকে একটি মডেল। পাকিস্তানের এক লেখক কিছুদিন পূর্বে লেখেছেন, বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এভাবে এগিয়ে গেলে কিছুদিন পর কয়েকটি পাকিস্তানকে কিনতে পারবে। অথচ স্বাধীনতার পর পাকিস্তানিরা আমাদের পাওনা ফেরত দেয়নি। তখন বাংলাদেশে বিমান ছিল না, জাহাজ ছিল না, ছিল না টাকা ছাপানোর রিজার্ভ ব্যাংকের নিকট স্বর্ণমুদ্রা। পৃথিবীর সেরা সেরা অর্থনীতিবিদগণ ফতোয়া দিয়েছিল, বাংলাদেশ দেউলে হয়ে যাবে, দাঁড়াতে পারবে না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি। সে রাষ্ট্রটি সম্পর্কে এখন দুনিয়ার সেরা সংবাদ মাধ্যম ও সেরা অর্থনীতিবিদগণ বলেছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নের ‘রোল মডেল’। আমরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরাজিত করেছি, বর্তমান আবার মুক্তির যুদ্ধে (অর্থনৈতিক মুক্তি) পরাজিত করেছি। সত্যি বাংলাদেশ এক মিরাকল।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক