ইসলামে আশুরার ফজিলত ও আমল

23

ফখরুল ইসলাম নোমানী

মহররম মাসের ১০ তারিখকেই আশুরা বলা হয়। নিঃসন্দেহে আশুরার দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার দিন। এ দিনটি মুসলিম উম্মাহকে পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ দিনেই ঘটেছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ও মর্মান্তিক কারবালা ঐতিহাসিক ঘটনা। এক কথায় এ দিনটি দ্বীন প্রতিষ্ঠায় হিজরত এবং হক তথা উত্তম প্রতিষ্ঠার জন্য এক সুমহান দিন। এ কারণেই মুসলিম উম্মাহ এ দিনটিকে বিশেষ ইবাদাত-বন্দেগি তথা রোজা পালনের দিন হিসেবে শ্রদ্ধা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালন করে থাকে।
আশুরার দিনটি হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গী-সাথীদের জন্য বিজয়ের দিন হলেও এ দিনেই ঘটেছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয় বিদরাক ও মর্মান্তিক কারবালা ঐতিহাসিক ঘটনা। আল্লাহর জমিনে দ্বীন তথা উত্তম প্রতিষ্ঠায় ইসলামের অগ্রসেনানী হজরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ আত্মত্যাগ এক মহাঅনুপ্রেরণা। এ দিনটিতে ইবাদাত বন্দেগির ফজিলত ও তাৎপর্য অনেক বেশি। সংক্ষেপে আশুরার কিছু ফজিলত ও তাৎপর্য তুলে ধরা হলো :
ক. মুসা আলাইহিস সালামের সফলতা ও ফিরাউনের ধ্বংস : আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালামকে এ দিনে মহান সফলতা দান করেছেন। নিজেকে প্রভু দাবিকারী অত্যাচারী ফিরাউন হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর অনুসারীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার নির্যাতন চালাতেন। এ দিনে আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল মুসা ও তাঁর অনুসারী বনি ইসরাইলকে ফিরাউনের অত্যাচার থেকে নাজাত দান করেছেন। ফিরাউন ও তার দলবলকে বাহরে কালজুম তথা লোহিত সাগরে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দেন। আল্লাহ তাআলা প্রমাণ স্বরূপ কুরআনে উল্লেখ করেন আর যখন আমি তোমাদের জন্য সাগরকে দ্বিখন্ডিত করেছি অতঃপর তোমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছি এবং ডুবিয়ে দিয়েছি ফিরাউনের লোকদিগকে তোমাদের চোখের সামনে। (সুরা বাক্বারা : আয়াত ৫০)।
খ. আশুরার রোজা পালনে গুরুত্ব : হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেভাবে আশুরা ও রমজানের রোজার গুরুত্ব সহকারে অনুসন্ধান করতে দেখেছি অনুরূপভাবে অন্য কোনো রোজার ব্যাপারে তা দেখেনি। (বুখারি ও মুসলিম) আশুরার দিন রোজা রাখা সুন্নাত। আশুরার রোজা সব নবীর আমলেই ছিল। নবী করিম (সা.) মক্কায় থাকতেও আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে রাসুলুল্লাহ (সা.) দেখতে পেলেন, ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখছে। প্রিয় নবী (সা.) তাদের রোজার কারণ জানতে পারলেন, এদিনে মুসা (আ.) সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত লাভ করেন। এদিনেই তিনি বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কয়েদখানা থেকে উদ্ধার করেন এবং এদিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন সেই সাগরে ডুবে মারা যায়। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইহুদিরা এই দিন রোজা রাখে।
গ. এ দিনে ছোট বাচ্চারাও রোজা রাখত : হজরত রুবাইয়্যেই বিনতে মুআ’ওয়েয রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার দিন সকালে আনসারি সাহাবাগণের গ্রামগুলোতে দূত পাঠিয়ে (এ রকম) ঘোষণা দিতে বলেন যে ব্যক্তি সকালে কিছু খেয়ে ফেলেছে সে যেন বাকি দিন না খেয়ে পূর্ণ করে। আর যেব্যক্তি না খেয়ে আছে সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। তিনি (রুবাইয়্যেই) বলেন এরপর আমরা নিজেরা রোজা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরকেও রোজা রাখাতাম। আর তাদেরকে তুলা দ্বারা বানানো খেলনা দিতাম। যখন তাদের কেউ খানার জন্য কাঁদত তখন ইফতারি পর্যন্ত ঐ খেলনা দিয়ে রাখতাম। (বুখারি ও মুসলিম)। মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে আমরা বাচ্চাদের জন্য তুলা দ্বারা খেলনা বানাতাম এবং আমাদের সাথে রাখতাম। যখন তারা খানা চাইত তখন তাদেরকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম; যাতে করে তারা তাদের রোজা পূর্ণ করে।
ঘ. রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার রোজা : হজরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন জাহেলিয়াতের যুগে কুরাইশরা আশুরার রোজা রাখত এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও রাখতেন। এরপর যখন তিনি মদিনায় আগমন করলেন তখন তিনি আশুরার রোজা রাখেন এবং রাখার জন্য নির্দেশ দেন। অতঃপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো তখন তিনি আশুরার রোজা (ফরজ হিসাবে) রাখেননি। এরপর যে চাইত রাখত এবং যে চাইত বিরত থাকত। (বুখারি ও মুসলিম)
ঙ. রমজানের পরে আশুরার মর্যাদা : হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন রমজানের পরে সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। (মুসলিম ও তিরিমজি)
চ. আশুরার রোজায় বিগত বছরের গোনাহ থেকে মুক্তি : হজরত আবু কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট আশা করছি যে তিনি বিগত এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দিবেন। (মুসলিম)
পবিত্র আশুরার বা মহররমের ১০ তারিখ যেসব তাৎপর্যময় ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল সংক্ষেপে সেগুলো তুলে ধরা হলো :
১. এ দিনে আল্লাহ তাআলা পৃথিবী সৃষ্টি করেন। আর এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।
২. এ দিনে হজরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসেন। মহররমের ১০ তারিখে আল্লাহ পাক আদম (আ.)-এর দোয়া কবুল করেন এবং এ দিনে তিনি স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে সাক্ষাৎ করেন।
৩. হজরত নুহ (আ.)-এর জাতির লোকেরা আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হওয়ার পর ১০ মহররম তিনি নৌকা থেকে ঈমানদারদের নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন।
৪. হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকÐে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর ১০ মহররম সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন।
৫. হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর মহররমের এ দিনে আল্লাহর রহমতে সুস্থতা লাভ করেন।
৬. হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে কূপে পতিত হন এবং এক বণিক দলের সহায়তায় মিসরে গিয়ে হাজির হন। তারপর আল্লাহর বিশেষ কুদরতে তিনি মিসরের প্রধানমন্ত্রী হন। ৪০ বছর পর ১০ মহররম পিতার সঙ্গে মিলিত হন।
৭. হজরত ইউনুস (আ.) জাতির লোকদের প্রতি হতাশ হয়ে নদী অতিক্রম করে দেশান্তরিত হওয়ার সময় নদীর পানিতে পতিত হন এবং মাছ তাঁকে গিলে ফেলে। মাছের পেট থেকে তিনি আল্লাহর রহমতে ৪০ দিন পর মুক্তি পান ১০ মহররম তারিখে।
৮. হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের অত্যাচারের কারণে তাঁর দলবলসহ অন্যত্র চলে যান। পথিমধ্যে নীল নদ পার হয়ে তিনি ফেরাউনের হাত থেকে আশুরার দিন মুক্তি পান। আর ফেরাউন তার দলবলসহ নীল নদের পানিতে ডুবে মারা যায়।
৯. হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির লোকেরা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করলে মহররমের ১০ তারিখ আল্লাহ পাক তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে মুক্তি দান করেন।
১০. মহররম মাসের ১০ তারিখ কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার অবতারণা হয়। এদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইমাম হোসাইন কারবালা প্রান্তরে শাহাদাতবরণ করেন।
উম্মুল মুমিনিন হজরত হাফসা (রা.) বলেন, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারটি কাজ কখনো পরিত্যাগ করেননি। আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, আইয়ামে বিদের রোজা তথা প্রতি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোজা এবং ফজর ওয়াক্তে ফরজের আগে দুই রাকাত সুন্নাত নামাজ।
আসুন পবিত্র মহররম মাস ও আশুরার দিনে (১০ মহররমের আগে বা পরে এক দিনসহ) আমরা রোজা রেখে আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ লাভ করার সুযোগ গ্রহণ করি। বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফার ও দান-খয়রাত করে এবং পরিবার-পরিজনের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহররম ও আশুরা থেকে আমাদের অফুরন্ত ফজিলত দান করুন। আমিন।

লেখক : ইসলামি চিন্তক ও গবেষক