ইসলামে আলেম-ওলামাদের সম্মান ও মর্যাদা

476

 

একজন আলেম দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে গেলে মানুষ যেমনি দিশেহারা হয়ে যায় ঠিক তেমনি কোনো আলেম চলে গেলে পুরো দেশ ও সমাজ দিশেহারা হয়ে যায়। এসব আলেম-ওলামা না থাকলে পৃথিবী ঠিক থাকবে না। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবীর সব মানুষ মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে চতুষ্পদ জন্তুতে পরিণত হয়ে যাবে। তাই ইসলামে আলেম-ওলামাদের সম্মান ও মর্যাদা সর্বোচ্চ। যারা প্রকৃত আলেম তাদের মর্যাদা আল্লাহর দরবারে অতি উচ্চে। সাধারণ মানুষের মাঝে আলেমরা হলেন নক্ষত্ররাজিতুল্য। যাদেরকে অনুসরণ করার মাধ্যমে মানুষ সঠিক পথের সন্ধ্যান লাভ করে থাকে। আলেমরা আল্লাহর ওলি বা বন্ধু। তাঁদের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করা আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করার শামিল। হাদিসে কুদসিতে আছে, আল্লাহতাআলা বলেন, “যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলির সঙ্গে শত্রæতা করবে আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘােষণা করলাম।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫০২)।
নবী-রাসুলদের উত্তরাধিকার : আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের সম্মানিত করেছেন ওহির জ্ঞান ও জীবন-বিধান দিয়ে। সেই ওহির জ্ঞান ও বিধি-বিধান মানবজাতির কাছে পৌঁছানোর জন্য তিনি প্রেরণ করেছেন যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল। তাঁরা ছিলেন জগত্বাসীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় করুণা ও রহমতস্বরূপ। আল্লাহর রহমতের সেই নবুয়তি ধারা আদম (আ.) থেকে শুরু হয়ে সমাপ্ত হয়েছে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। তিনি শেষ নবী। তাঁর পর আর কোনো নবী এই দুনিয়াতে আগমন করবেন না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলেমদেরকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, “নিশ্চয় আলেমরা হলেন নবীদের উত্তরাধিকারী।” [সহীহ তিরমিজি, আবু দাউদ]
আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্যদাতা : যুগে যুগে যাঁরা এই নবীদের জ্ঞান ধারণ করে আসছেন তাঁরাই যুগের হক্কানি উলামায়ে কেরাম। যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ আমাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছেছে তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও অন্যান্য ইসলামী শাস্ত্রের সুবিন্যস্ত বিশাল বিশাল গ্রন্থাবলি। আল্লাহ তাআলা তাঁদের বানিয়েছেন নিজ একত্ববাদের অন্যতম সাক্ষী। তিনি ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। ফেরেশতারা এবং ন্যায়নিষ্ঠ আলেমরাও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।”(সুরা: আলে ইমরান : ১৮) আলেমরা সম্মানিত : উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নাই, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছােটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না।” (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২১৪৩)।
মৃত্যুর পরও আলেমের নেক আমল জারি থাকে : মানুষ মৃত্যুবরণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আলেমের আমল জারি থাকে। একজন আলেম জীবিত অবস্থায় ইলম বিতরণ করার কারণে অনেকে উপকৃত হয়েছেন। সেজন্য মৃত্যুবরণ করার পরও তার সওয়াব তিনি পেতে থাকবেন। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি উৎস থেকে তা অব্যাহত থাকে : সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম ও নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।” (সহীহ মুসলিম: ৪৩১০)
সকল সষ্টি আলেমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে : কুরআন-সুন্নাহর ইলমে সমৃদ্ধ ব্যক্তির জন্য বড়ই সুসংবাদ যে, তার জন্য আল্লাহর নিকট সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে। আনাস ইবনু মালিক (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “ইলমের অধিকারী ব্যক্তির জন্য সব কিছুই ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি সমুদ্রের মাছও।” (মুসনাদু আবী ইআ’লা: ২/২৬০)
আল্লাহতায়ালা আলেমদের শান ও মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন, কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-আল্লাহ তায়ালা স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন । যে, তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, এবং ফেরেশতাগণ, আলেমগণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। (সুরা আলে ইমরান।
আলেমদের আনুগত্য : তাঁরা আম্বিয়ায়ে কেরাম থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাঁদের কাছেই মানুষ লাভ করে কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান। চিনতে নিজের প্রভুকে, শিখতে পারে আল্লাহর বিধি বিধান। বুঝতে পারে শরিয়তকে। মানতে পারে হালাল-হারামকে। তাঁদের মাধ্যমেই মানুষ খুঁজে পায় নিজের আসল পরিচয়। যাঁদের সংস্পর্শে এসে অন্ধকার জগতের মানুষগুলো সন্ধান পায় আলোকিত জীবনের। মৃত হৃদয়গুলো হয় পুনর্জীবিত। তাঁরা পৃথিবীর জন্য রহমত। তাঁরা উম্মতের জন্য বরকত। ইরশাদ হয়েছে,“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো, অনুসরণ করো রাসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বসম্পন্ন (ন্যায়পরায়ণ শাসক ও আলেম) তাদের।” (সুরা : নিসা,আয়াত : ৫৯)
আলেমদের কাছে জিজ্ঞাসা : আলেমদের কাছে ইসলাম সবার আগে। তাঁরা দ্বিনের অতন্দ্র প্রহরী। দ্বিন রক্ষার ঢাল ও সুদৃঢ় প্রাচীর। ইসলামের বিরুদ্ধে সব ধরনের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় তাঁরা সর্বদা সচেষ্ট। তাঁরা নিজেদের সর্বশক্তি ব্যয় করে সব ধরনের বাতিল মতবাদকে রুখে দেওয়ার জন্য সর্বদা অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে যান। তাঁরা হক কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। হক প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জান-মাল ব্যয় করাটা গৌরব মনে করেন। বাতিলের মুখোশ উন্মোচন করতে কালক্ষেপণ করেন না। তাঁদের হাতেই জিন্দা হয় সুন্নত। দূরীভূত হয় বিদআত। যেকোনো শরয়ি সমস্যা নিরসনে তাঁদের দ্বারস্থ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ তাআলা নিজেই। তিনি ইরশাদ করেছেন, “অতএব আলেমজ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো,যদি তোমাদের জানা না থাকে।”(সুরা : নাহল : ৪৩)
হাদিসের আলোকে আলেমদের মর্যাদা : উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নাই, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না।” (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২১৪৩, মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস : ৩৮৪) । আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বৃদ্ধ মুসলমান, কোরআনের আদব রক্ষাকারী ও কোরআন অনুযায়ী আমলকারী হাফেজ এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশাহর সম্মান করা মহান আল্লাহর সম্মান করার অন্তর্ভুক্ত।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৫৩)
আলেমদের সমালােচনা ও গালি দেওয়ার পরিণতি : ইমাম হাফেজ আবুল কাসেম ইবনে আসাকির (রহ.) বলেন, হে ভাই জেনে রাখো, উলামায়ে কেরামের দোষ চর্চা করা বিষাক্ত জিনিস। আল্লাহ তাআলার অভ্যাস হলো উলামায়ে কেরামের কুৎসা রটনাকারীকে তিনি লজ্জিত করেন (এটা কারো অজানা নয়)। যে ব্যক্তি উলামায়ে কেরামের সমালোচনা করবে আল্লাহ তার মৃত্যুর আগে তার অন্তরকে মৃত বানিয়ে দেবেন। (আত-তিবয়ান ফি আদাবে হামালাতিল কোরআন : ২৭-২৯) আলেমের সঙ্গে দুশমনি ও গালি দেওয়ার কারণ দুটি হতে পারে। যথা-১. ব্যক্তিগত কোনো কারণে। ২. আলেম হওয়ার কারণে। কোনো আলেমকে আলেম হওয়ার কারণে গালি দেওয়া, তাঁর সঙ্গে শত্রæতা বা বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করা একটি কুফরি কাজ। এটি খুবই ভয়াবহ মানসিকতা। এমন মানসিকতা লালনকারী ব্যক্তি তাওবা না করলে ঈমানের সঙ্গে তার মৃত্যু হবে কি না ঘাের সন্দেহ আছে। উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা মোটেও বলা অত্যুক্তি হবে না যে, আলেম-ওলামাদের মর্যাদা ও সম্মান আকাশতুল্য। তাদের সাথে বেয়াদবি, তাদের কষ্ট দেয়া ও নির্যাতন করা অত্যন্ত গোনাহের কাজ। এর জন্যে দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন মুসিবতের সম্মুখীন হতে হবে। অতএব যারা আলেম-ওলামা তাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান সকলের অবশ্য কর্তব্য। আলেম-ওলামাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দানের মাধ্যমে দুনিয়া ও পরকালে আল্লাহর ভালোবাসা ও প্রিয় নবীজি (সা.) মহব্বত লাভ করা সম্ভব।
লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস
এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড