ইসলামের পুনর্জাগরণে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.)’র ভূমিকা

15

 

বিশ্বব্যাপী ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষার প্রচার প্রসারে উপমহাদেশের যে কয়েকজন অসাধারণ প্রতিভাধর মনীষী বহুমুখী অবদান রেখেছেন, যাঁদের সৃজনশীল কর্ম তৎপরতায় ইসলামের আলোক রশ্মি বিশ্বের বুকে আজো ভাস্বর তাঁদের মধ্যে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী (র.) অন্যতম। মাওলানা বেরলভী (র.) ১০ শাওয়াল ১২৭২ হিজরি মুতাবিক ১৪ জুন ১৮৫৬ খ্রি.ভারতের ইউপির বেরেলী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর বুজুর্গ দাদা নাম রাখলেন মুহাম্মদ আহমদ রেযা খান , শ্রদ্ধেয় পিতা আহমদ মিয়া বলে ডাকতেন। মাতা ¯েœহের সাথে ‘আমান মিঞা’ নামে ডাকতেন। তাঁর সংখ্যা তাত্তি¡¡ক নাম ‘আল মুখতার।‘তিনি ১২৭৬ হিজরি মুতাবিক ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে চার বছর বয়সে কুরআন মাজীদ পাঠ সমাপ্ত করেন। খোদা প্রদত্ত অসাধারণ মেধা শক্তির কারণে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় ১২৮৬ হিজরি মুতাবিক ১৮৬৯ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে শিক্ষার সমাপনী সনদ অর্জন করেন।
মাওলানা বেরলভীর হাদিসের সনদসূত্র হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী হযরত শেখ আবেদ সিন্ধী ও আল্লামা আবদুল আলী ল²েীভীর সাথে সম্পৃক্ত। আ’লা হযরত ১২৯৪ হিজরি মোতাবিক ১৮৭৭খ্রি. বুজুর্গ পিতা আল্লামা নক্বী আলী খানের সাথে হযরত শাহ আলে রসূল মারহারভী (ওফাত: ১২৯৬হি./১৮৭৮খ্রি.) এর হাতে বায়আত গ্রহণ করে সিলসিলায়ে কাদেরীয়ায় অন্তর্ভুক্ত হন। কামিল মুর্শীদ নব দীক্ষিত মুরীদের চেহারা অবলোকনে নূরানী দ্বীপ্তি দেখে পিতাপুত্র উভয়কে খিলাফত ও ইযাযত দান করেন। খিলাফতের অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে আ’লা হযরত তরীক্বত জগতে এক রুহানী ইনকিলাব ও ঈমানী বিপ্লব সাধন করেন। আ’লা হযরত তরীকতের নামে প্রচলিত অনৈসলামিক কার্যকলাপের মূলোৎপাটন করে এক্ষেত্রে যুগান্তকারী সংস্কার সাধন করেন। কতিপয় লোক শরীয়ত ও তরীক্বতের বিভাজনে লিপ্ত হয়ে ইসলামী শরীয়তের মৌলিক নীতিমালাকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র ‘তরীক্বত’ অবলম্বনই যথেষ্ট। এমন মানসিকতা পোষণ করত এ ভ্রান্ত ধারণার আপনোদনে মাওলানা বেরলভী কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। তাঁর মতে, শরীয়ত ও তরীক্বত একটি অপরটির পরিপূরক । একটির পালন আর অপরটির বর্জন বিভাজনের নামান্তর যা পূর্ণতার অন্তরায়, বরং শরীয়ত ও তরীক্বতের সমন্বয়েই ইসলামের পূর্ণতা এ বিষয়ে তিনি ‘শরীয়ত ও তরীক্বত’ নামে একটি স্বতন্ত্র পুস্তক রচনা করেন।
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (র.) ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলিল প্রমাণাদির ভিত্তিতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা হারাম সম্পর্কিত ‘আযযুবদাতুয যাকীয়্যাহ লিতাহরীমে সুজুদুত তাহীয়্যাহ’ নামক একটি গবেষণাধর্মী নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি শুধু গভীর জ্ঞানের অধিকারী একজন আলেমে দ্বীন ছিলেন তা নয় বরং জাতির ক্রান্তিকালে ইসলামের শাশ্বত আদর্শকে সঠিক রূপে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি সুনিপুণ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। এ কালজয়ী ব্যক্তিত্ব তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের দ্বারা বিশ্বজনীন স্বীকৃতি ও সম্মান স্বরূপ ‘আ’লা হযরত’, ‘কলম সম্রাট’, ‘শুজায়াতে জঙ্গ’, (রণবীর) ইত্যাদি দুর্লভ সম্মানে ভূষিত হন এবং জ্ঞানী-গুণী ও সুধী মহলে সর্বত্র তিনি সমাদৃত হন। ধর্মীয় জটিল কঠিন বিষয়াদির বিশ্লেষণধর্মী সমাধান করার পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতিষশাস্ত্র ও নক্ষত্র বিদ্যায় তিনি প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ১৯১৯খ্রি. ১৮ অক্টোবর ইংরেজি ‘দি এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় আমরিকার জ্যোতিষ বিজ্ঞানী প্রফেসর আলবার্ট এফ পুরটা একটি ভবিষ্যৎবাণী করেন যে, ১৯১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বরে কয়েকটি গ্রহ সূর্যের সামনে চলে আসার দরুন উদ্ভূত মধ্যাকর্ষণ পৃথিবীতে মহা প্রলয়ের সৃষ্টি করবে। আ’লা হযরতকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কুরআন সুন্নাহর গবেষণার আলোকে মহাকাশ বিজ্ঞানীর ভবিষ্যৎবাণী ভ্রান্ত বলে রায় দেন। ১৭ ডিসেম্বর দেখা গেল পৃথিবীর কোথাও কোন প্রকার বিপর্যয় দেখা যায়নি। আ’লা হযরতের গবেষণা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হলো। যুক্তরাষ্ট্রীয় বিজ্ঞানীর ভবিষ্যৎবাণী ভুল প্রমাণিত হলো।
প্রাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের ভ্রান্ত তত্তে¡র বিরুদ্ধে এটা ছিলো ইসলামের এক সুমহান বিজয়। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আ’লা হযরতের জ্ঞানগবেষণার বিশাল জগৎ বিনির্মিত । মার্কিন বিজ্ঞানীদের মতবাদ খন্ডনে আ’লা হযরত পরপর তিনটি গবেষণাধর্মী পুস্তক রচনা করেন।
১। আল কালিমাতুল মুলহামাতু ফীল হিকামাতিল মুহকামা লিওয়াহীল ফালসাফাতিল মুশাআমাহ (১৯১৯খ্রি.)
২। ফওযে মুবীন দর রদ্দে হরকতে যমীন(১৯১৯খ্রি.)
৩। নুযুলে আয়াত ই ফুরকান বি সুকূনে যমীন ওয়া আসমান(১৯১৯খ্রি.)
উপমাহাদেশে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে ও ধর্মীয় অঙ্গনে আক্বিদাগত বিভ্রান্তির নাজুক সন্ধিক্ষণে মুসলিম মিল্লাতের ঈমান আক্বিদা সংরক্ষণে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে ১৮৯৭ সনে ভারতের পাটনায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কনফারেন্সে মাওলানা বেরলভী (র.) এর প্রদত্ত ভাষণ মুসলমানদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র রচনা করেছে। তিনি ছিলেন প্রকৃত পক্ষে দ্বিজাতি তত্তে¡র পথিকৃৎ। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা তাঁরই চিন্তাধারার বাস্তব রূপায়ন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সনে দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি দান করেছে। তিনি ১৩৩৯ হিজরি মুতাবিক ১৯২০ খ্রি. ‘তরকে মোয়ালাত’ বা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে ঐতিহাসিক ফতোয়ার আলোকে বৃটিশ বেনিয়াদের কবল থেকে ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার প্রয়াসে সকলকে সজাগ করেন। মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দ্বি-জাতি তত্ত¡ (ঞড়ি ঘধঃরড়হ ঞযবড়ৎু) এর বিকল্প নেই বলে ঘোষণা করেন। এ ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯২০ সালে ‘আল হুজ্জাতুল মুতামেনা বি আয়াতিল মুমতাহিনা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। যা উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক অভ্রান্ত দলিল। এছাড়া তিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর আরো কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন।
১। এলামুল এলাম বিআন্না হিন্দুস্তান দারুল ইসলাম (১৯৮৮খৃ.)
২। দাওয়ামুল আয়শি ফী আইম্মাতি কুরাইশি (১৯১২খ.)
৩। তাদবীর ই ফালাহ ওয়া নাজাত ও ইসলাহ (১৯১২খৃ.)
বিশ্বব্যাপী ইসলামী আদর্শের প্রচার প্রসারে তাঁর অবদান ছিল বিস্ময়কর। জ্ঞানবিজ্ঞানের সর্ব ক্ষেত্রে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই । কুরআন, হাদিস ,তাফসীর , ফিকহ, উসূল, দর্শন, মান্তিক , ভাষাতত্ত¡, ধর্মতত্ত¡, সুফীতত্ত¡, সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রতিটি শাখায় ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান এক অতলান্ত সুবিস্তৃত মহাসাগর। বিশ্বের বহু জ্ঞানী গুণী পন্ডিতবর্গ এ মনীষীর প্রতিভার স্বীকৃতি দিয়েছেন। আল্লামা ড. ইকবাল তাকে যুগের আবু হানিফা অভিধায় ভূষিত করেছেন। আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. স্যার জিয়াউদ্দিন তাঁকে নোবেল প্রাইজের যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ১৩৩০ হিজরি মুতাবিক ১৯২২ খ্রি. শায়খ মুসা আলী আশ শামী আল আযহারী কর্তৃক ইমামুল আইম্মা আল মুজাদ্দিদুল উম্মাহ তথা চতুর্দশ শতাব্দীর মহান সংস্কারক উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর রচিত সহস্রাধিক গ্রন্থাবলী ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। তাঁর রচনাবলী ইসলামের এক অমূল্য সম্পদ।
আদর্শ জাতি ও সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে তাঁর জীবন দর্শনের গবেষণা আজ সময়ের দাবি। বিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলামের শাশ্বত মূল্যবোধ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে তাঁর গ্রন্থাবলী ভাষান্তরের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, তাঁর জীবনের অন্যান্য কীর্তি বাদ দিলেও আল কুরআন ও ফিকহ শাস্ত্রের উপর তাঁর অনবদ্য অবদানের নিমিত্তে ইতিহাসে তিনি চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন।
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের উপর নির্ভুল ও বিশুদ্ধতম অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর প্রণীত‘কানযুল ঈমান ফী তারজুমাতিল কুরআন’ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ১৩৩০ হিজরি মুতাবিক ১৯১১খ্রি. এর অনুবাদ কর্ম সম্পন্ন হয়েছিল। পরবর্তীতে তাঁরই খলিফা সদরুল আফাযিল মাওলানা সৈয়্যদ নাঈম উদ্দিন মুরাদাবাদী (র.) (ওয়াফাত:১৩৬৭ হি./১৯৪৮খ্রি.) ‘খাযাইনুল ইরফান ফী তাফসীরুল কুরআন’ নামে এ উর্দু তরজুমার উপর তাফসীর বা পার্শ্ব টীকা লিখেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় ‘কানযুল ঈমান’ অনূদিত হয়ে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজিতে চারজন অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া বাংলা, উর্দূ, ফারসি, ডাস, হিন্দি, হাঙ্গেরি, রোমান ভাষাসহ আরো ২০ ভাষায় অনুবাদ হয়।
মাওলানা বেরলভী ১২৮৬ হিজরি ১৪ শাবান মুতাবিক ১৮৬৯ খ্রি. মাত্র তের বৎসর দশ মাস বয়সে স্বীয় বুজুর্গ পিতা মাওলানা নক্বী আলী খানের তত্ত্বাবধানে ফতওয়া লেখার কাজ শুরু করেন। ১২৯৩ হিজরি মুতাবিক ১৮৭২ খ্রি. সাত বছর পর ফতওয়া লেখার স্বাধীন অনুমতি লাভ করেন। ১২৯৭ হি. মুতাবিক ১৮৮০খ্রি. পিতার ইন্তেকালের পর থেকে ফতওয়া লেখার সার্বিক দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে আঞ্জাম দিতে থাকেন। ১৩৩৭হি./১৯১৮খ্রি. তাঁর ফতওয়া লেখার কাজ পঞ্চাশ বছরে উন্নীত হয়। এ পঞ্চাশ বছর অবধি অক্লান্ত শ্রম ও সাধনার বিনিময়ে হানাফী ফিকহ শাস্ত্রের ইনসাইক্লোপিড়িয়া তথা বিশ্বকোষ নামে খ্যাত ত্রিশ খন্ডের এ বিশাল ফতওয়া গ্রন্থের সংকলন সম্পন্ন হয়েছিল। মাওলানা হাসান রেযা খান আ’লা হযরতের ফিকহি যোগ্যতা মূল্যায়নের উপর গবেষণা করে ভারতের পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে ২২ ডিসেম্বর পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্বের বুকে আপন সৃষ্টিশীলতার দ্বারা যাঁরা মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে ঠাঁই করে নিয়েছেন, ইমাম আহমদ রেযা খাঁন তেমনি এক কিংবদন্তী তুল্য মহামনীষীর নাম। ১৩৪০ হিজরি সালের ২৫ সফর ১৯২১ খ্রি. শুক্রবার বাদ জুমা ২টা ৩৮ মিনিটে হিজরি চতুর্দশ শতাব্দীর মহান মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা(র.) মহান প্রভুর অনন্ত সান্নিধ্যে গমন করেন।

লেখক : অধ্যক্ষ, খতীব, কদম মোবারক
শাহী জামে মসজিদ, মোমিন রোড