ইসলামের দৃষ্টিতে সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা

57

 

গত পর্বের পর

প্রতিটি মানুষ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। মানুষ অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে দুনিয়াতে আসে, বসবাস করে এবং দুনিয়া হতে বিদায় নেয়। মানুষ অপরের কল্যাণ সাধন বন্ধ করলে জাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না। তাই মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে মানুষের প্রতি দয়াবান ও অনুগ্রহশীল হতে আহŸান জানিয়েছেন। সে আহŸানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন সময় আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করেছেন, করবেন, ইনশাআল্লাহ।
সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বন্যাকবলিত অঞ্চলে সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি হতে রক্ষায় যে ভাবে দায়িত্ব পালন করেন তা সত্যিই অসাধারণ পুণ্যময় কাজ। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ ব্যক্তিদের সেবা করার নির্দেশ দিয়ে ঘরে বসে থাকেননি, নিজ হাতে রুগ্ন ব্যক্তির সেবা করতেন। কোনো অসুস্থ ব্যক্তির খবর শুনলে তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ-খবর নিতেন এবং সেবা করতেন। অসুস্থ মানুষের কপালে হাত রাখতেন, দোয়া করতেন এবং তার পছন্দের খাবারের কথা জেনে তা এনে খেতে দিতে চেষ্টা করতেন। তিনি সাহাবীদের বলতেন, “তোমরা অসুস্থ ব্যক্তির সাথে দেখা করো”। (বুখারি শরিফ, হাদিস নং- ৫২৪৬)।
অসুস্থ ব্যক্তি ধনী, গরিব, মুসলিম, অমুসলিম, আত্মীয়, অনাত্মীয় যেই হোক প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পার্থক্য না করে সাধ্যমতো সেবা করতেন। মদিনার এক ইয়াহুদির সন্তান অসুস্থ হলে তিনি তার বাড়িতে গিয়ে তার খোঁজ-খবর নেন।
তৃষ্ণার্ত মানুষের পিপাসা নিবারণ করা ইবাদত। বন্যাকবলিত অসহায় মানুষের মাঝে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা মহাপুণ্যের কাজ (যা আমাদের সশস্ত্র বাহিনী করে থাকেন)। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে তৃষ্ণার্তকে পানি পান করাবে, আল্লাহ পাক তাকে পবিত্র পানীয় পান করাবেন।” (আবু দাউদ শরিফ) ।
এক সাহাবী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা দুনিয়াতে নেই, তার কল্যাণের জন্য আমি উত্তম কী করতে পারি? প্রিয়নবী মাহবুবে খোদা হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, তার জন্য একটি সুপেয় পানির কূপ খনন করে তৃষ্ণার্তদের মাঝে পানি বিলিয়ে দাও।” (আবু দাউদ শরিফ)।
বন্যাকবলিত অঞ্চলে বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক যৌথ সহযোগিতায় তৃষ্ণার্ত মানুষের পিপাসা নিবারণে সুপেয় পানির যে ব্যবস্থা করেন তার মাধ্যমে প্রিয়নবী হযরত মোহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান উপদেশ বাস্তবায়ন হয় ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পর সরকারের ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর উন্নয়ন কর্মকাÐ প্রশংসিত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসা, কষি, কর্মসংস্থান বাঙালি ও পাহাড়ীদের মধ্যে খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির উন্নয়ন সবার চোখে পড়ার মতো জন কল্যাণমূলক কাজ।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত জলসীমায় সব ধরনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের। সমুদ্রে যে কোনো ধরনের বহিঃশত্রæর আক্রমণ প্রতিরোধ, চোরাচালান। নিয়ন্ত্রণ, জলদস্যু নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ সব ধরনের জনবল, মালামাল অনুপ্রবেশ এবং বহির্গমন প্রতিরোধ নৌবাহিনীর নেতৃত্বে হয়ে থাকে। এসব হিতকর্ম দেশ ও মানবকল্যাণকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। মানুষ দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের মধ্যদিয়ে জীবনের পরিধি বৃদ্ধি করতে পারে। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, জীবনটাকে লম্বায় বড় করা যায় না, পরিধিতে বাড়াতে চেষ্টা করুন’। আমরা মহান আল্লাহ পাকের নিকট হতে যতটুকু হায়াত নিয়ে এসেছি, তা টেনে লম্বায় বড় করতে পারব না কিন্তু মহামানবতার সেবার মাধ্যমে জীবনের পরিধিকে অনেক বৃদ্ধি করতে পারি।
ইসলাম ও শান্তিরক্ষী বাহিনী
ইসলাম অর্থ শান্তি, মুসলিম অর্থ শান্তিকামী। মহান আল্লাহ পাকের একটি নাম ‘সালাম’ অর্থ শান্তি, মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হয় শান্তির অগ্রদূত। তিনি মদিনার যে পবিত্র ভূমিতে শুয়ে আছেন তার একটি নাম ‘দারুস সালাম’ বা শান্তির ঘর। তাঁর নবুয়ত প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি আরবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হিলফুল ফুযুল’ নামক সংগঠন গঠন করেছিলেন। এই সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য ছিল, ‘মক্কা নগরীতে কারো উপর অত্যাচার করা হলে সবাই সম্মিলিতভাবে সাহায্য করবে। মানব ইতিহাসে একটি মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এটি মহান এক দৃষ্টান্ত।
প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাণী নিয়ে কোনো দূতকে যখন অমুসলিম রাষ্ট্র প্রধানের নিকট প্রেরণ করতেন তখন সে দূত গিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানকে বলতেন, “আসলিম তাসলাম” অর্থাৎ “শান্তিতে আসো, শান্তিতে থাকো।
এক ইংরেজ লেখক লিখেছেন, “আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগে দুইজন মুসলমান দেখা হলে একটি আরবি বাক্য বলতে দেখি। আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম, তোমরা দেখা হলে কী যেন বলো? তারা আমাকে জানাল আমরা শান্তি বিনিময় করি। “আসসালামু আলাইকুম বলি।” তিনি চিন্তা করলেন, ইউরোপ, আমরিকার মানুষরা দেখা হলে বলে ‘গুডমর্নিং’ সকালে ভালো থাকো। বিকালে নয়, ‘গুড ইভিনিং’ বিকালে ভালো থাকো রাতে নয়, রাতে ভালো থাকো আগামীকাল নয়। ইসলাম ধর্মের নির্দেশ হলো একে অপরের সাথে দেখা হলে সাথে সাথে বলো ‘আসসালামু আলাইকুম’, অর্থাৎ তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হউক, আজ নয়, কাল নয়, শুধু ইহকাল নয় অনন্তকাল শান্তি বর্ষিত হউক। সালামের পর মোসাফাহা (হাত মিলানো), তারপর মোয়ানাকা (গলাগলি) করা সুন্নাত। আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ (তোমার ওপর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক) বলে নামাজ শেষ করা ইসলামের বিধান।
মহান আল্লাহ পাক দুনিয়াতে ধ্বংসাত্মক কাজের বিপরীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বার বার বলেছেন। তিনি পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, “এবং তারা দুনিয়াতে ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় আর আল্লাহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করে না।” (সূরা: আল মায়িদা: আয়াত ৬৪)
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অত্যাচার, অবিচার হয়েছে, তবু তিনি কোনোদিন কাউকে গালি দেননি, অভিশাপ দেননি, প্রতিশোধ নেননি, কাউকে আঘাত করেননি, কারো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেননি, ক্ষতিসাধন করেননি, শুধু উচ্চারণ করেছেন, “আল্লাহুম্মা ইহদি কাওমি ফাইন্নাহুম লা ইয়ালামুন” অর্থাৎ “হে আল্লাহ! তুমি তাদেরকে হেদায়েত করা, তারা আমাকে বুঝেনি। প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “মুমিনগণ সহনশীল ও নরম; যদি আকর্ষণ করা হয়। তবে সে আকৃষ্ট হয়। আর যদি পাথরের ওপর উপবিষ্ট করানো হয় সে উপবিষ্ট হয়। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তি ও আদর্শের বাণী নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন। তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য হুদাইবিয়ার সন্ধিতে রাসুলুল্লাহ শব্দটি হযরত আলী (রাঃ) ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বহস্তে কেটে দিয়েছিলেন। শান্তির জন্যই সে বছর তিনি যুদ্ধ না করে অনেকটা কাফিরদের পক্ষে সন্ধি করে মদিনায় ফিরে যান। অনেক মুসলমান সেদিন এ সিদ্ধান্তের সমালােচনা করলে তার সমর্থনে মহান আল্লাহ এ সন্ধি পরাজয় নয়, বরং নিশ্চিত জয় ঘোষণা করে কোরআনের আয়াত নাজিল করেন। পরবর্তী সময়ে এই কৌশলই পরাজয়ই নিশ্চিত করে মক্কা বিজয়।
শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল ধর্মের মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই মদিনার রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তিনি মদিনায় বসবাসরত ইয়াহুদিদের দশটি গোত্র, আওস ও খাযরায সোত্রের বারটি উপসোত্র, মুসলমান ও পৌত্তলিকদের ঐক্যবদ্ধ করে মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান ‘মদিনা সনদ সম্পাদন করে একটি নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। এই চুক্তিটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে ২৪টি ধারা এবং দ্বিতীয় অংশে ২৯টি ধারা। প্রথম অংশ মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক এবং দ্বিতীয় অংশে আছে মদিনায় বসবাসরত সকল ধর্মের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক। এই চুক্তির ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট লিখিত আছে, “বনু আওদের ইয়াহুদিরা মুসলমানদের সাথে একই জোটভুক্ত বলে গণ্য হবে। ইয়াহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম, মুসলমানের জন্য তাদের ধর্ম, তাদের গোলামদের এবং তাদের নিজেদের ব্যাপারে একই কথা প্রযোজ্য হবে। তবে যে ব্যক্তি জুলুম বা অপরাধ করবে, সে তার নিজকে ছাড়া অন্য কাউকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।
এই চুক্তির ফলে মদিনার মুসলিম অমুসলিম সকলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বীকার করে নেয়, মদিনার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়, একটি আন্তর্জাতিক সমাজের সূচনা হয়, একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়, সকল ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়, জুলুম, অত্যাচার নিষিদ্ধ হয়, গোত্রসমূহের কলহের অবসান হয়। ইসলাম শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাকে আমরা স্মরণ করি কিন্তু তার শান্তির পথ অনুসরণ করি না। স্মরণের মধ্যে যদি অনুসরণ না থাকে, সে স্মরণ ব্যর্থ হয়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, “ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ তোমার দেখানো পথ। আমাদের জাতীয় গৌরবের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনী মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো শান্তির পথ ভুলে যাননি।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৮৮ সাল হতে জাতিসংঘের অধীনে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক পরিমÐলে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অসাধারণ ভূমিকা দেশের জন্য বড় সম্মান বয়ে এনেছে।
অসাধারণ দেশপ্রেম, নেতৃত্বের প্রতি গভীর আস্থা, পেশাগত দক্ষতা ও শৃঙ্খলাবোধের কারণে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী আন্তর্জাতিক পরিমÐলে বড় ধরনের সম্মান অর্জন করেছে।
আমাদের সশস্ত্র বাহিনী পৃথিবী নামক গ্রহটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী। একুশ শতকের বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশ পৃথিবীর দূরের কোনো রাষ্ট্র নয়। সমগ্র পৃথিবীর কল্যাণ মানে বাংলাদেশেরও কল্যাণ।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক