ইসলামের দৃষ্টিতে সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা

27

 

গত পর্বের পর

সশস্ত্র বাহিনী ও মানবকল্যাণ
পবিত্র ইসলাম একটি সুন্দর বিধানের নাম। এ বিধানে মানবকল্যাণ মহান এক ইবাদত। অনেকে নামাজকে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত মনে করলেও মানবকল্যাণকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। মানবকল্যাণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে ইসলামের বিধান হলো নামাজের পূর্বে আজানে হাইয়া আলাস্ সালাহ (নামাজের জন্য এসো) বাক্যটি উচ্চারণের সাথে সাথে হাইয়া আলাল ফালাহ (কল্যাণের জন্য এসো) বাক্যটি উচ্চারণ করতে হয়। নবজাতক শিশুর জন্মের পরই আজানের মাধ্যমে কল্যাণের কথা স্মরণ করে দিতে হয়।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ৮২ বার “ওয়াকিমুসসালাহ ওয়াউতুজজাকাত’ অর্থাৎ নামাজ কায়েম করো যাকাত প্রদান করো, কথাটি ঘোষণা করেছেন। যেখানেই নামাজের কথা সেখানে অসহায় মানুষের কল্যাণে যাকাতের কথা বলা হয়েছে। এতে আত্মস্থ হয় যে, শুধু নামাজ-রোজা ইবাদত নয়, মানবকল্যাণও মহান ইবাদত।
নামাজ শেষে আমরা মহান আল্লাহর দরবারে মুনাজাতে পবিত্র কোরআনের যে আয়াত পাঠ করি তা হলো, “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসনাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আজাবান্নার।”
অর্থাৎ “হে আল্লাহ, তুমি আমাদের দুনিয়ার কল্যাণ দাও, আখিরাতের কল্যাণ দাও এবং জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা করো।” (সূরা:আরাফ, আয়াত-২৩)।
এই পবিত্র আয়াতে দুনিয়ার কল্যাণের কথা আগে বলা হয়েছে, কারণ দুনিয়াটা ঠিক না থাকলে আখিরাত ঠিক থাকে না।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এক সাহাবী জানতে চেয়েছিলেন, সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন “রুন্নাস ইয়ান ফেউন্নাস” যিনি মানুষের কল্যাণ করেন তিনিই সর্বোত্তম। অন্য এক হাদিসে তিনি এরশাদ করেছেন, “যিনি মহামানবতার সেবায় নিজের জীবনকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেন তিনিই মহামানব।” মহামানব নয় নেহায়েত সাধারণ ও স্বাভাবিক মানুষ খুঁজে পাওয়া বর্তমানে কঠিন, যেসব মানুষ সমাজের বা মানুষের উপকার না করলেও অপকার করে না, যে অন্যায় করে না, যে ঘৃণা করে না, এমন মানুষ যখন আমরা খুঁজছি তখনি বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী দেশ বিদেশে শান্তি রক্ষায় নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অপরের কল্যাণে আনন্দ পান। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সততা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, শৃঙ্খলা, সাহসিকতা, কর্তব্যপরায়ণতা শুধু দেশে নয়, বিশ্বে আজ প্রশংসিত। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী আজ দুনিয়ার বুকে বীর প্রসবিনী। এটি শুধু আমার কথা নয়, পবিত্র কোরআনেরও মহান ঘোষণা। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, “কুন্তু খায়রা উম্মাতি উখরিজাত লিন্নাস” অর্থাৎ “তোমাদের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে মানুষের (সর্বধর্মের) কল্যাণ করো”। মানুষ কল্যাণের মাধ্যমে হয় শ্রেষ্ঠ জাতি বা আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির সেরা জীব। অকল্যাণ নিকৃষ্ট । ফার্সি ভাষার প্রধান কবি হযরত শেখ সাদী (রহঃ) লিখেছেন, “গাধা নিকৃষ্ট এক প্রাণী। মানুষ মানুষকে গাধা বলে গালি দেয়। এই গাধা মানুষের কল্যাণ ছাড়া অকল্যাণ করে না। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে যদি মানুষের অকল্যাণ করে তখন সে গাধার চেয়ে নিকৃষ্ট, আর কল্যাণ করলে সে সৃষ্টির সেরা জীব।”
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন মাত্র তেইশ বছর। আর মানবতার কল্যাণ সাধন করেছেন সমগ্র জীবন। তার শিক্ষা হলো, মানুষের সেবাই উত্তম ইবাদত। যে মুসলমান ধর্মের অন্যান্য বিধান পালন করে অথচ মানব কল্যাণ করে না, সে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের বড় অংশ ত্যাগ করে ক্ষুদ্র অংশকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রহমত ও কল্যাণকামী বলে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের নিকট এক রাসূল এসেছে। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তার জন্য কষ্টদায়ক। তোমাদের জন্য তিনি কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি দয়াবান এবং পরম দয়ালু”। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ১২৮)
উপরোক্ত আয়াতে মহানবী হযরত মোহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কল্যাণকামী ও দয়ালু বলে ঘোষণা করা আমাদের জন্যও কতর্ব্য। কারণ কল্যাণ মুসলমানের ঈমানের অংশ।
সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে সহগ্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ৯ পদাতিক ডিভিশনের নেতৃত্বে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, পুলিশ, আনসার, বিজিবিসহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের যৌথ সহযোগিতায় উদ্ধার অভিযান সফল ভাবে সম্পাদন হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি ভবন থেকে ২,৪৩৮ মানুষ জীবিত উদ্ধার এক বিরল ও অসাধারণ ঘটনা। সামরিক ও বেসামরিক যৌথ সহযোগিতায় দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সব সময় প্রস্তুত থাকে। ২০০৭ সালে প্রবল বন্যা, সিডর, আইলার মতো বড় প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী সেনানিবাসে বসে থাকে নি, সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি হতে রক্ষার মুখ্য কর্মসূচি তারা পালন করেন। বিমান বাহিনীর হেলিকপটার দ্বারা দ্রুত দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় ত্রাণ ও ঔষধ পৌঁছিয়ে দেয়। এসব সেবাধর্মী কাজে নৌবাহিনী সদস্যরাও পিছিয়ে ছিল না, তাদের নৌযান নিয়ে সমুদ্র ও নদীর তীরবর্তী দুর্গত এলাকায় গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। একদিন দুইদিন নয়, মাসের পর মাস সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা জনগণের পাশে থেকে কল্যাণ সাধনের অনেক দৃষ্টান্ত রেখেছে।
বন্যা পরিস্থিতির দিকে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রেখে বন্যাকবলিত মানুষের সাহায্য করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রয়েছে এক পর্যবেক্ষণ সেল’। সামরিক প্রকৌশলীগণ লোডার, ডোজার দ্বারা বালি পাথর ফেলে অনেক নদীভাঙন প্রতিরোধ করেছে। কঠিন দুর্যোগের সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দিন রাত পরিশ্রম করে মানুষের সেবা ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে থাকেন।
দুর্যোগের সময় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো ইসলামের মহান শিক্ষা ও ইবাদত। দুর্যোগ কবলিত এলাকায় ধর্ম বর্ণ, শত্রæমিত্র পার্থক্য না করে সব মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ প্রদান করেছেন । হিজরতের ষষ্ঠ বছর মক্কা শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি খুব ব্যথিত চিত্তে দুর্ভিক্ষকবলিত মক্কাবাসীর জন্য পাঁচশত দিরহামের ত্রাণসামগ্রী প্রেরণ করেছিলেন। অথচ এই মক্কার কাফিরগণ ছিল তার চরম শত্রু। এই শত্রুদের বিপদের কথা শুনে তিনি খুশি না হয়ে মর্মাহত হন। (সূত্র ড. হামীদুল্লাহ, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষা কৌশল শীর্ষক প্রবন্ধ; সীরাত স্মারক, ১৪২২ হিজরি)
আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম সর্বধর্মের মানুষের সেবক, তারপর (চল্লিশ বছর পর) ধর্ম প্রচারক। তিনি সর্বধর্ম ও মতের মানুষের সেবা করেছেন বলেই তার প্রচারিত ধর্ম মানুষ গ্রহণ করেছে। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়ত প্রাপ্তির কথা তিনি প্রথম জানালেন স্ত্রী খাদিজাকে (রা:)। হযরত খাদিজা (রা:) বললেন, “আল্লাহ আপনাকে কখনো অসম্মান করবেন না, কারণ আপনি অসহায়, দুঃস্থ, শোষিত মানুষের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম ব্যবহার করেছেন, মেহমানকে মর্যাদা দিয়েছেন।” (প্রাগুক্ত, কিতাবুল যাদইল ওয়াহরি, হাদিস নং ৩, ১ খ পৃঃ ৪)।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়ত প্রকাশিত হওয়ার আগেও ব্যাপক সেবামূলক কর্মকাÐে জড়িত ছিলেন যা আমরা হযরত খাদিজাতুল কোবরার (রা:) বর্ণনা হতে জানতে পারি। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন সময় উন্নয়ন কর্মকাÐে অংশগ্রহণ, দুর্যোগ মোকাবিলা, জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালন, জাতীয় ভোটার আইডি কার্ড তৈরী, বঙ্গবন্ধু সেতু নজরদারী সন্ত্রাস দমন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাউন্টার ইনসারজেন্সি অপারেশন, পাওয়ার স্টেশন স্থাপন, কি পয়েন্ট ইনস্টলেশনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনসহ সব কাজই মানবকল্যাণের মহান ব্রত নিয়ে সম্পাদন করে থাকেন।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুসরণ করতে চাইলে নামাজ, রোজা, হজের মতো মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তিনি সব সময় মানবতার কল্যাণে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদান করতেন। প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “সৃষ্টি জগৎ আল্লাহর পরিবারভুক্ত । ঐ ব্যক্তি মহান আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয়, যে তার পরিবারের অধিক কল্যাণ করে । (মিশকাত শরিফ, হাদিস নং-৪৭৮১)।
তিনি আরো ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, মহান আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না।” (জামে-আত-তিরমিজি, হাদিস নং -১৮৭২)।
আরেক হাদিসে বর্ণিত আছে, “তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি অনুগ্রহ করো, আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন।” (প্রাক্তন, হাদিস নং-৩৭৫)। চলবে

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক