ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ

93

প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেম প্রীতি সৌহার্দ্য সম্প্রীতির মাধ্যমে একটি কল্যাণকর সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ইতিবাচক পদ্ধতি ‘দাওয়াত’ দ্বারা মানুষের কাছে ইসলামের মহান শিক্ষা তুলে ধরেছিলেন জোর করে শক্তি প্রদর্শন দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করা যায় না, করতে গেলে শান্তি আসে না, নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়ত প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক একটি সংগঠন গঠন করেছিলেন। এই সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য ছিলো ‘মক্কা নগরীতে কারো উপর অত্যাচার করা হলে সবাই সম্মিলিতভাবে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং অত্যাচারিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাহায্য করবে। মানব ইতিহাসে এটি একটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান এক দৃষ্টান্ত। দুনিয়ার মাঝে যুদ্ধ বিগ্রহে যত লোকের মৃত্যু হয়েছে তার চেয়ে অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে ধর্মীয় হানাহানিতে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা আমরা অত্মস্থ করতে পারিনি বলেই আমাদের এই অধঃপতন।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল ধর্মের মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তিনি মদিনার বসবাসরত ইহুদীদের দশটি গোত্র, আওস ও খাযরায গোত্রের বারটি উপগোত্র, মুসলমান ও পৌত্তলিকদের ঐক্যবদ্ধ করে মানবেতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান মদিনার সনদ বা চুক্তি সম্পাদন করে একটি নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। এই চুক্তিটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে ২৪টি ধারা এবং দ্বিতীয় অংশে ২৯টি ধারা। প্রথম অংশ মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক এবং দ্বিতীয় অংশে আছে মদিনায় বসবাসরত সকল ধর্মের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক। এই চুক্তির ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট লিখিত আছে, ‘বানু আওফের ইহুদীরা মুমিনদের সাথে একই জোটভুক্ত বলে গণ্য হবে। ইহুদীদের জন্য তাদের ধর্ম, মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম, তাদের গোলামদের এবং তাদের নিজেদের ব্যাপারে একই কথা প্রযোজ্য হবে। তবে যে ব্যক্তি জুলুম বা অপরাধ করবে, সে তার নিজকে ও নিজ গৃহবাসীদের ছাড়া অন্য কাউকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না’।
এই চুক্তির ফলে মদিনার মুসলিম ও অমুসলিম সকলের রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বীকার করে নেয়া হয়, মদিনার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়, একটি আন্তর্জাতিক সমাজের সূচনা হয়, একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়, সব ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়, জুলুম, অত্যাচার নিষিদ্ধ হয়, জুলুম, অত্যাচার নিষিদ্ধ হয়, গোত্র সমূহের কলহের অবসান হয়।
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে ৮০টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ২৭টি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁর যুদ্ধনীতি ছিল ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। অমুসলিমদের জন্য কোন যুদ্ধনীতি না থাকলেও তিনি মুসলমানদের জন্য কঠোর নিয়মনীতি প্রদান করেছিলেন। তাঁর যুদ্ধনীতির কয়েকটি উল্লেখ করা হলো, (১) অমুসলিম বৃদ্ধদের হত্যা করা যাবেনা। (২) অমুসলিম নারী হত্যা করা যাবে না। (৩) অমুসিলম শিশু হত্যা করা যাবে না। (৪) অমুসলিম ধর্মরুদের সম্মান করতে হবে। (৫) অমুসলমানের ক্ষেত ও ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করা যাবে না। (৬) অমুসলিমদের উপাসনালয় ধ্বংস করা যাবে না। এ ধরনের আরো কিছু নিয়মনীতি ছিল। মনে রাখতে হবে তাঁর যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষামূলক, প্রতিরোধমূলক বা প্রতিশোধমূলক নয়। যে ধর্মে যুদ্ধের ময়দানে এ ধরনের নিয়মনীতি পালনের নির্দেশ আছে সে ধর্মে সাধারণ অবস্থায় হত্যা-গুপ্তহত্যা অমার্জনীয় অপরাধ তাঁর জীবনে যত যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে কঠোর যুদ্ধনীতির কারণে সব যুদ্ধের শত্রæ মিত্রের প্রাণহানির সংখ্যা মাত্র এক হাজারের বেশি নয়। অথচ আধুনিক সভ্যতার দাবীদার দুই বিশ্বযুদ্ধের নিহত হয় সাড়ে তিন কোটি মানুষ। এখনো পৃথিবীতে প্রতিদিন মরছে কত শত মানুষ তার ইয়ত্তা নেই।
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদাইবিয়ার সন্ধিতে ‘রাসুলুল্লাহ’ শব্দটি হযরত আলী (রা.)’র ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বহস্তে কেটে দিয়েছিলেন। শান্তির জন্যই সে বছর যুদ্ধ না করে অনেকটা কাফিরদের পক্ষে সন্ধি করে মদিনায় ফিরে যান। অনেক মুসলমান সেদিন এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলে নবীজীর সমর্থনে মহান আল্লাহ এ সন্ধি পরাজয় নয়, নিশ্চিত জয় ঘোষণা করে কোরআনের আয়াত নাজিল করেছেন। পরবর্তীতে এই পরাজয়ই নিশ্চিত করে মক্কা বিজয়।
মুসলমানগণ আজ নিজের নফসের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছেনা অথচ অন্যের ওপর জোর করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। অন্য মতবাদ বিশ্বাসীদের ওপর আঘাত করছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ মানে নিজের নফসের ওপর নিয়ন্ত্রণ। এটি করতে পারলে মানুষ পরিশুদ্ধ হয়। পরিশুদ্ধ মানুষ হতে পারলে সে মানুষের কথা বা মতাদর্শ অন্য মতাদর্শের মানুষগণ গ্রহণ করে।
বাংলাদেশে যারা জঙ্গি তারা তাদের পরিবারেই আদর্শ মানুষ নয়। তারা বাবা-মায়ের সাথে থাকতে পারে না। তাদের কোন পরিবার তাদের সাথে থাকতে রাজি নন। তাদের লাশ পরিবার গ্রহণ করেনা। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগে পরিবারে আদর্শ প্রচার করেছেন এবং গ্রহণযোগ্য করেছেন তারপর বাইরে। এটি তার সুন্নাত এবং নীতি ছিল। জঙ্গিরা এ নীতির বিপরীতে অবস্থান করছে।
আদম(আ.)’র পুত্র কাবিল হাবিলকে হত্যা করে। বিশ্ব জগতের প্রথম মানব হত্যাকারী কাবিল এ হত্যাকাণ্ডের কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবীর বুকে সমস্ত হত্যাকারী কাবিলের অনুসারী, পথভ্রষ্ট।
মুসলমানদের মনে রাখতে হবে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্ব প্রথম সর্বধর্মের মানুষের সেবক, তারপর, ধর্ম প্রচারক। মক্কায় ধর্মপ্রচারক মদিনায় রাষ্ট্রনায়ক। এই মদিনার রাষ্ট্রে প্রথম ছিল ৫-৬% মুসলমান বাকী সব অমুসলিম। তিনি ছিলেন অমুসলিম রাষ্ট্রের অধিনায়ক (পরবর্তীতে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়)। তিনি সর্বধর্মের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলেই অমুসলিমগণ তাকে আজীবন রাষ্ট্র নায়ক নিয়োগ করেছিলেন।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অনেক অত্যাচার, অবিচার হয়েছে, তবু তিনি কোনদিন গালি দেননি, অভিশাপ দেননি, প্রতিশোধ নেননি, কাউকে আঘাত করেননি, কারো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেননি, ক্ষতি সাধন করেননি, শুধু উচ্চারণ করেছেন, ‘আল্লাহুমা ইহদি কাওমী ফাইন্নাহুম লা ইয়ালামুন’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি তাদেরকে হেদায়ত কর, তারা আমাকে বুঝেনি।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে চরম ধৈর্য্যশীল ছিলেন। ধৈর্যের কারণেই ইসলাম প্রচার এবং প্রসার লাভ করেছে। মহান আল্লাহ পাক বলেননি, আমি হাজী-নামাজীদের সাথে আছি। বলেননি আমি যাকাত প্রদানকারী, কলমা পাঠকারী, রোজা পালনকারীদের সাথে আছি। তিনি বলেছেন, ‘ইন্নাল্লাহা মায়াস সোয়াবেরিন’ আমি ধৈর্যশীলদের সাথে আছি। পরিশেষে ধৈর্যশীলরাই বিজয়ী হয়।
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মুমিনগণ উটের মতো সহনশীল ও নরম; যদি আকর্ষণ করা হয় তবে সে আকৃষ্ট হয়। আর যদি পাথরের ওপর উপবিষ্ট করানো হয় সে উপবিষ্ট হয়’। মহান আল্লাহ পাকের নিকট আজ আমাদের ফরিয়াদ মুসলমানগণ যেন সহনশীল হয়ে মহানবী (দ.)’র দেখানো পথ অনুসরণ করতে পারি।
যারা জঙ্গি তারা স্পষ্ট মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান করছে। একাত্তর ও পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড হতে শুরু করে ২১ আগস্টসহ সকল জঙ্গি হামলা একই সূত্রে গাথা। এসব সংঘাত ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির নয়, আদর্শের সাথে আদর্শের। পাকিস্তানি আদর্শের সাথে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দ্ব›দ্ব। এসব অপশক্তিকে রোধ করতে আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একাত্তরের মত তাদের পরাজিত করতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে গণসচেতনতা। সংস্কার করতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রবর্তন করতে হবে আলোকিত বিজ্ঞান প্রযুক্তির এবং মানব কল্যাণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা। মানবজাতি কেন শ্রেষ্ঠ! পবিত্র কোরানে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে সৃষ্ট করা হয়েছে, যাতে তোমরা মানুষের কল্যাণকর।’ মানব কল্যাণেই শ্রেষ্ঠ, অকল্যাণে নিকৃষ্ট। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তিনিই শ্রেষ্ঠ যিনি মানুষের কল্যাণ করেন’। জঙ্গিবাদীরা মানুষের কল্যাণ তো দূরের কথা, মানব প্রজাতি ধ্বংসের উৎসবে মিলিত হয়েছে। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা প্রাকৃতিক এক অপরূপ সৌন্দর্য্যমণ্ডিত ভূমি সোনার বাংলাকে আমরা জঙ্গিবাদের আখড়া বানিয়ে একাত্তরের মত শ্মশানে পরিণত করতে দিতে পারি না। সমাপ্ত

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক