ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর প্রিয়জনদের স্মরণ

3

 

আল্লাহ্ তা’আলার প্রিয় নবী-রাসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম, সাহাবায়ে কেরাম, আহলে বাইতে রাসূল ও আউলিয়ায়ে কেরামের শুভ জন্ম দিন এবং ওফাত দিনকে কেন্দ্র করে মাহফিল করা, নানা পুণ্য ও কল্যাণকর কাজের মাধ্যমে তাঁদের অবদানকে স্মরণ করা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় ও শরীয়তসম্মত কাজ। কেননা এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ তাঁদের জীবন, কর্ম ও অনুপম আদর্শ সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং নিজের জীবনেও তাঁদের আদর্শ বাস্তবায়নে আগ্রহী ও উৎসাহিত হয়ে উঠে। পবিত্র ক্বোরআনে প্রায় অর্ধশতাধিক আয়াতে নির্দেশ এসেছে আল্লাহর প্রিয়জনদের স্মরণ করার বিষয়ে। যেমন আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, হে হাবীব! স্মরণ করুন কিতাবে হযরত ইবরাহীমকে নিশ্চয় তিনি ছিলেন সত্যবাদী, নবী। [মারয়াম: ৪১] হে হাবীব! স্মরণ করুন কিতাবে হযরত মুসাকে। তিনি ছিলেন মনোনীত এবং তিনি ছিলেন রাসূল, নবী।)। [মারয়াম-৫১]
এ নির্দেশটি শুধু আল্লাহ্ তা’আলার নবী-রাসূলদের মাঝে সীমাবদ্ধ নয় বরং আউলিয়ায়ে কেরামের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন, “হে হাবীব! আপনি কিতাবে হযরত মারয়ামকে স্মরণ করুন যখন তিনি তাঁর পরিবারের লোকজন থেকে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে এক স্থানে আশ্রয় গ্রহন করেন।” [মারয়াম:১৬] এ আয়াতে হযরত মরিয়াম আলাইহাস সালামকে স্মরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একথা কারও অজানা নেই যে, হযরত মারয়াম আলাইহাস সালাম নবী ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন আল্লাহর একজন ওলী।
অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা’আলা ক্বোরআন করিমে তাঁর প্রিয় নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি যেন স্বীয় উম্মতদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে নেয়ামত অবতরণের দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেন। আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন- “আমি হযরত মূসাকে নিদর্শনাবলীসহ প্রেরণ করে বলেছিলাম যে, আপনি স্বজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আনয়ন করুন এবং তাদেরকে আল্লাহর দিনসমূহ স্মরণ করিয়ে দিন। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।” [ইবরাহীম-০৫]
এ আয়াতে আল্লাহ্ “তা’আলার দিনগুলো” মানে ওই সব দিন যে দিনগুলোতে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বিশেষ কোন বান্দা বা বিশেষ কোন জাতিকে কোন খাস বা বিশেষ নেয়ামত দ্বারা ধন্য করেছেন। আর এ দিনগুলো সাধারণত হয়ে থাকে- শুভ জন্ম দিন, বিজয়ের দিন ইত্যাদি।
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পালন করেন নিজের জন্মদিন : যেহেতু শুভজন্ম দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ নেয়ামত তাই রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই তাঁর নিজ জন্মদিন বা মিলাদ উদযাপন করেছেন নফল রোযা পালনের মাধ্যমে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক সোমবার রোযা রাখতেন। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এরশাদ করেন: “এটা ওইদিন যেদিন আমার শুভজন্ম হয়েছে বা মিলাদ হয়েছে, যে দিন আমার বেচাল হয়েছে এবং যে দিন আমার প্রতি প্রথম ওহী নাযিল হয়েছে।”(মুসলিম শরীফ-১১৬২, তিরমিযী-৭৬৭, নাসায়ী-২৩৮২, আবু দাউদ-২৪২৫, ইবনু মাজা-১৭১৩, মুসনাদে আহমদ-৫/২৯৯,৫/২৯৬, ৫/৩০৮) অর্থাৎ তিনি তাঁর শুভজন্মদিন উপলক্ষে আল্লাহ্ তা’আলার শুকরিয়া স্বরূপ এ নফল রোযা রাখতেন।
নেয়ামত প্রাপ্তির দিনকে স্মরণ করা নবীগণ আলাইহিমুস সালামের সুন্নাত : রমজান মুবারকের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার রোজা রাখা ফরজ ছিল। রমজানের রোজার হুকুম নাযিল হবার পর তা সুন্নাতে রূপান্তরিত হয়।
আশুরার রোযা কী ও কেন? বুখারী-মুসলিমসহ অসংখ্য হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন দেখতে পেলেন ইয়াহুদিরা মুহররম মাসের দশম তারিখে তথা আশুরার দিনকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নফল রোজার মাধ্যমে উদযাপন করছে। তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানায়- “এটি একটি মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ্ তা’আলা হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম এবং তাঁর জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন। আর ফেরআউন ও তার জাতিকে সমুদ্রে নিমজ্জিত করে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ার্থে হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম রোযা রেখেছিলেন, তাই আমরাও এ দিনে রোযা রাখি।” তখন রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘আমরা তোমাদের চেয়ে হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম এর অধিক হকদার এবং অধিক নিকটবর্তী। (কেননা তারা হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম এর প্রকৃত দ্বীন থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল), তাই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ দিনে রোযা রেখেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে এ দিন রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।” (বুখারী-২০০৪, মুসলিম-১১৬২, আবু দাউদ-২৪২৫, তিরমিযী-৭৪৯, ইবনু মাজা-১৭৩৮, আহমদ-৫/৩০৮, বায়হাক্বী ৪/২৮৬.)
এ হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিশেষ নেয়ামত প্রাপ্তির দিনগুলোকে স্মারণ করা সকল নবী-রাসূল আলায়হিমুস্ সালামের সুন্নাত। আরও প্রমাণিত হয় যে, বাৎসরিক একটি সুনির্দিষ্ট দিনকে উদযাপনের জন্য নির্ধারণ ও ধার্য করাও সুন্নাত, যা এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
জন্মদিবস ও ওফাত দিবসকে আল্ ক্বোরআনের বিশেষ সম্মান : আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর প্রিয়জনদের শুভজন্ম এবং তাঁদের বেচাল বা ওফাত দিবসকে ক্বোরআনুল করিমে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন এবং এ দিনগুলোকে বিশেষ শান্তি ও সালামের দিন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বরং আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এ দিনগুলোতে বিশেষ সালাম প্রেরণ করা হয়েছে। হযরত ইয়াহ্য়া আলায়হিস্ সালামের শুভজন্ম ও বেচাল শরীফ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন: “এবং তাঁর প্রতি সালাম বা শান্তি যেদিন তিনি জন্ম গ্রহণ করেছেন, যেদিন তিনি ওফাত পাবেন এবং যেদিন তিনি পুনর্জীবিত হবেন।” [সূরা মারয়াম:১৫] হযরত ইসা আলায়হিস্ সালাম তাঁর মাতৃক্রোড়ে এ ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ‘‘এবং আমার প্রতি সালাম ও শান্তি যেদিন আমি জন্ম গ্রহণ করেছি, যেদিন আমি ওফাত পাবো এবং যেদিন আমি পুনর্জীবিত হবো“। [মারয়াম:৩৩]
এ আয়াতদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হলো জন্ম ও ওফাতের দিনকে উপলক্ষ করে দুরূদ, সালাম, দোয়া, মুনাজাত ও নেয়ায-তাবাররুকাতের ব্যবস্থা করা নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত বরকত ও ফযিলতমÐিত কাজ। যদি এতে শরিয়ত বিবর্জিত কোন কাজ সংঘটিত না হয়।
আল্লাহ্ তা’আলার প্রিয়জনদের স্মরণের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ্ তা’আলা আরও এরশাদ করেন-“নিশ্চয় তাঁদের ঘটনাসমূহে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষা ও উপদেশ। এটা কোন মনগড়া কথা নয়, কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্যে পূর্বেকার কালামের সমর্থন এবং প্রত্যেক বস্তুর বিবরণ, রহমত ও হেদায়ত।”। [ইউসুফ:১১১] “আপনি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিন, কেননা স্মরণের মধ্যে রয়েছে মুমিনগণের জন্য অনেক উপকার। [যারিয়াত:৫৫]
মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমি আপনার নিকট পূর্ববর্তী রাসূলগণের যা ঘটনা বর্ণনা করেছি তা আমি আপনার হৃদয়কে সুদৃঢ় ও মজবুত করার জন্য, আর এভাবে আপনার নিকট মহাসত্য এবং ঈমানদারদের জন্য নসীহত ও স্মরণীয় বিষয়বস্তু এসেছে।। [হুদ: ১২০]
নবীগণ আলাইহিমুস সালাম ও আউলিয়ায়ে কেরামের রেখে যাওয়া নিদর্শনাদি থেকে বরকত হাছিল : আল্লাহ্ তা’আলার প্রিয়জনদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি থেকে বরকত হাছিল করা ক্বোরআন দ্বারা প্রমাণিত ও হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দ্বারা সাব্যস্ত। যেমনিভাবে হযরত ইউসুফ আলায়হিস্ সালামের জুব্বা মুবারকের মাধ্যমে তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব আলায়হিস্ সালামের চোখের দৃষ্টি ফিরে আসার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। (দেখুন সূরা ইউসুফ:আয়াত-৯৩])
আহলে বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে চিরস্মরণীয় করে রাখা : আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন: “নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলা চয়ন করে নিয়েছেন হযরত আদম, হযরত নূহ, হযরত ইব্রাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে সারা বিশ্ববাসীর মধ্য থেকে।” [আলে ইমরান:৩৩]
বলা বাহুল্য যে, আল্লাহর প্রিয়জনদের স্মরণ ও ভালোবাসার উদ্দেশ্যই হলো, তাঁদের জ্ঞান, আদর্শ, ইবাদত-রেয়াযত ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়ে তাঁদের অনুসরণ ও অনুকরণ করা। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন- “তাঁরা পরম সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, যাঁদেরকে আল্লাহ্ তা’আলা সঠিক পথের উপর অধিষ্ঠিত রেখেছেন। সুতরাং তোমরাও তাঁদের সেই সঠিক পথের অনুসরণ কর।” [আনয়াম:৯০]
হজ্বের সাথে সংশ্লিষ্ট কার্যাদি মূলত: আল্লাহর প্রিয়জনদের স্মরণ : আল্লাহ্ তা’আলার প্রিয় নবী-রাসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম এবং আউলিয়ায়ে কেরামের স্মরণকে চিরস্মরণীয় রাখার অন্যতম মাধ্যম হলো পবিত্র হজ্ব। আমরা দেখি পবিত্র হজ্বের অধিকাংশ আরাকান হলো মূলত নবী-রাসূল ও আউলিয়ায়ে কেরামের নিদর্শনাদিকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এক আসমানী ব্যবস্থা। কখনও ফরয এবং কখনও ওয়াজিব করে দিয়ে তাঁদের নিদর্শনকে শ্রদ্ধা জানানো আবশ্যক করে দেয়া হয়েছে। যেমন: মক্বামে ইবরাহীম হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল আলাইহিমাস সালামের স্মরণ। (বুখারী শরীফ-৩১৮৪)
সাফা- মারওয়া ও মযম কূপ হযরত হাজেরা ও তাঁর শিশু পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিমাস সালামের স্মরণ । (মুসনাদে আহমদ ৪/১৯)
পাথর নিক্ষেপ ও কুরবানী হযরত ইবরাহীম এবং হযরত ইসমাঈল আলাইহিমাস সালামের স্মরণ। (সূরা সাফ্ফাত:১০১ ও মুসনাদে আহমদ ৪/১৯) এভাবে এহরাম পরিধান করা, তাওয়াফ করা, আরাফা-মুজদালাফায় অবস্থান করা, তাকবীর-এ তাশরীক্ব পাঠ করা, ইত্যাদি হলো মূলত আল্লাহর প্রিয়জনদের স্মরণ।
উল্লেখ্য, হযরত হাজেরা, হযরত মারয়াম তাঁরা নবী ছিলেন না বরং তাঁরা ছিলেন আল্লাহর ওলী, হযরত হাজেরা আলাইহাস্ সালাম হলেন- হযরত ইবরাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর স্ত্রী এবং হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালামের মাতা। আর হযরত মারয়াম আলাইহাস্ সালাম ছিলেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের মাতা। তাই নবীগণ আলাইহিমুস সালামকে স্মরণ করা যেমনিভাবে কুরআনুল করীম ও হাদীসে পাকের নির্দেশ পালন করা, ঠিক সেভাবে আওলিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুর রাহমাকে স্মরণ করাও কুরআনুল করীম ও হাদীসে পাকের নির্দেশ পালন করা।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ