মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
মুনাফিকের তালিকা : বিখ্যাত সাহাবী হযরত হুজাইফা (রাঃ) কে রহস্য পুরুষ হিসেবে সকলে জানতো। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু তার কাছেই মুনাফিকদের পরিচয় জানতেন। কোন লোক ইন্তেকাল করলে সকলে লক্ষ্য করতেন তার জানাজাতে হুজাইফা (রাঃ) উপস্থিত হলো কি না ? জানাজায় হুজাইফা (রাঃ) উপস্থিত হওয়া মানে, লোকটির নাম মুনাফিকের তালিকায় নেই। যদি তিনি কোন ব্যক্তির জানাজায় অংশগ্রহণ না করেন তাহলে অনেকে বুঝে নিতেন লোকটির নাম মুনাফিকদের তালিকায় আছে। আমিরুল মোমেনিন খলিফাতুল মোসলেমিন হযরত ওমর (রাঃ) হযরত হুজাইফা (রাঃ)’র নিকট জানতে চাইতেন তার মুনাফিকের নামের তালিকাটিতে ওমর (রাঃ)’র নাম আছে কি না। হুজাইফা (রাঃ) বললেন, হযরত ওমর (রাঃ) নিজ কানে শুনেছে নবীজী বলেছেন, ওমর বেহেশতে যাবে।
হযরত আব্বাস (রাঃ)’র পরনালা: হযরত আব্বাস (রাঃ) ছিলেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় চাচা। তার ঘর ছিল মসজিদে নববীর সাথে লাগানো। তার ঘরের একটি পরনালার সাথা মসজিদের প্রাঙ্গণে পড়ে। পরনালার যে অংশ মসজিদে নববীর প্রাঙ্গণ পড়েছে সে অংশটি হযরত ওমর (রাঃ) ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন। হযরত আব্বাস (রাঃ) ওমর (রাঃ)’র দরবারে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করলে এটা আপনি কী করলেন ? হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, মসজিদে নববীর অংশে লাগানো পরনালার অংশটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছি কারণ মসজিদের জায়গায় পরনালা লাগানো জায়েজ নেই। হযরত আব্বাস (রাঃ) বললেন, এ পরনালা আমি মহানবী (দঃ) এর অনুমতি নিয়ে লাগিয়েছি।
একথা শুনে হযরত ওমর (রাঃ) বললেন,আপনি আমার সাথে চলুন। দু’জন মসজিদে নববীতে পৌঁছলেন। হযরত ওমর (রাঃ) রুকুর মত করে ঝুকে আব্বাস (রাঃ) কে বললেন, হে আব্বাস! আমার কোমরের উপর দাঁড়িয়ে এ পরনালা লাগিয়ে নিন। খাত্তাবের পুত্রের সাহস নেই মহানবী (দঃ) এর অনুমতিতে লাগানো পরনালা ভেঙে ফেলার। হযরত আব্বাস (রাঃ) বললেন, থাক পরনালাটি আমি লাগিয়ে নেব।
আবু হানিফা (রহঃ)’র এশার ওজু দ্বারা ফজরের নামাজের কারণ: একদিন ঈমামে আজম আবু হানিফা (রাহঃ) এমন এক আবেদ যিনি এশার ওযু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেন। একথা শুনার পর ঈমাম আবু হানিফা (রাহঃ) মনে মনে ভাবলেন, আমি তো এশা ওজু দ্বারা ফজরের নামাজ আদায় করি না। যে প্রশংসা আমার করা হচ্ছে তা আমার মধ্যে নেই। তখনই তিনি অঙ্গীকার করলেন আজ হতে জীবনভর এশার ওজু দিয়ে ফজর নামাজ পড়বেন। সেদিন হতে তিনি সারারাত ইবাদত করতেন এবং এশা ওজু দ্বারা ফজরের নামাজ আদায় করতেন।
বাদশাহ হারুনুর রশীদের রাজত্বের মূল্য একগ্লাস পানি: একদিন বাদশাহ হারুনুর রশীদ একগ্লাস পানি পান করতে চাইলেন। পাশে বসে ছিলেন পাগল প্রকৃতির এক সাধক বাহলুল মজনু। বাদশাহ’র কাছে বাহলুল জানতে চাইলেন, আপনি কোন মরুভূমিতে আছেন তখন প্রচন্ড আপনার পানির পিপাসা কিন্তু কোথাও পানি নেই। তখন একগ্লাস পানি কতটুকু সম্পদের বিনিময়ে ক্রয় করবে ? বাদশাহ বললেন, নিজের জীবন রক্ষার জন্য আমার যত সম্পদ আছে তার বিনিময়ে আমি একগ্লাস পানি ক্রয় করবো। বাহলুল বললেন, এখন আপনি আল্লাহর নাম নিয়ে পানি পান করুন। বাহলুল আবার বাদশাহ’র কাছে আবারো প্রশ্ন করলেন, আপনি এখন যে একগ্লাস পানি পান করেছেন তা যদি শরীর হতে বের না হয়, প্রস্রাব যদি বন্ধ থাকে, তখন কত সম্পদের বিনিময়ে প্রস্রাব বের করবে ? বাদশাহ বললেন, প্রস্রাব বের করার জন্য কেউ আমার যদি রাজত্বটা চায় তাও আমি দিয়ে দিব। বাহলুল বললেন, আমিরুল মোমেনিন! আপনার রাজত্বের মূল্য একগ্লাস পানি। রাজত্ব নিয়ে অহংকার করোনা। আল্লাহ পাক সবকিছু বিনামূল্যে দিয়েছেন। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর।
হযরত আলী (রাঃ)’র নামাজ, মুয়াবিয়া (রাঃ) খানা: হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)’র মধ্যে যত বিরোধ ও যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কোন পক্ষ অবলম্বন না করে উভয়ের কাছে যেতেন। নামাজের সময় হযরত আলী (রাঃ)’র সৈন্যবাহিনীর সাথে নামাজ পড়তেন আর খানার সময় খেতেন মুয়াবিয়া (রাঃ) সৈন্যবাহিনীর সাথে। আবু হুরায়রার কাছে জানতে চাইলেন তার কারণ। তিনি বললেন, হযরত আলীর কাছে নামাজ ভালো,মুয়াবিয়ার নিকট খানা ভালো।
রোম সম্রাটের প্রস্তাব মুয়াবিয়া (রাঃ)’র না: সিফ্ফিনের যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)’র সৈন্যবাহিনী পরস্পর মুখোমুখি। এমনি সময় রোমের সম্রাটের পক্ষ হতে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কাছে প্রস্তাব আসলো হযরত আলী (রাঃ)’র বিরুদ্ধে অনেক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করার। এ প্রস্তাব সাথে সাথে প্রত্যাখ্যান করে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন, ‘হে খ্রিস্টান বাদশাহ! তুমি ভাবছো আমাদের মত বিরোধের সুযোগ নিয়ে আমাদের মুসলমান ভাই হযরত আলী (রাঃ)’র উপর আক্রমণ করবে ? জেনে রেখো! হযরত আলী (রাঃ)’র বিরুদ্ধে সামান্যতম আঘাতও যদি কোন অমুসলিমের পক্ষ হতে আসে তাহলে আমার সৈন্যবাহিনীর পক্ষহতে সর্বপ্রথম তাদের শিরোচ্ছেদের তলোয়ার উত্তোলিত হবে।
নীলনদের কাছে হযরত ওমর (রাঃ)’র পত্র: মিসরের ঐতিহাসিক নীলনদের পানি প্রতিবছর শুকিয়ে যেতো। প্রতিবছর একজন সুন্দরী নারীকে নীলনদে বিসর্জন দিলেই পানির স্রোত প্রবাহিত হতো।
আমিরুল মোমেনিন হযরত ওমর (রাঃ)’র খিলাফতকালে মিসর মুসলমানদের দখলে আসে। মিসরের গভর্নর নিযুক্ত হলো আমর ইবনুল আস। গভর্নর খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) কে জানালেন, এখানে পানির প্রবাহের জন্য নিষ্পাপ নরবলি হচ্ছে, যা ইসলাম সমর্থন করে না। হযরত ওমর (রাঃ) বিষয়টি অভিহিত হয়ে নদীর নিকট পত্র লেখেন। পত্রে খলিফা লিখলেন, ‘হে নদী! তুমি যদি আল্লাহর নির্দেশে প্রবাহিত হও,তাহলে তার কাছেই প্রার্থনা করছি, তুমি যেন প্রবাহিত হও। যদি প্রবাহিত হওয়া এবং শুকিয়ে যাওয়া তোমার ইচ্ছায় হয় তাহলে তোমার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই।
এই পত্রটি হযরত ওমর (রাঃ) কুমারীর পরিবর্তে নীলনদের শুকনো বালির ওপর নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দিলেন। হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়ে খলিফার চিঠিখানা নীলনদে রাখলেন, সাথে সাথে নীলনদের পানি প্রবাহিত হতে শুরু করলো। এ বছর আগের তুলনায় বেশি পানি প্রবাহিত হলো। আজ পর্যন্ত নীলনদ আর শুকায়নি।
লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক
