ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে এক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আল্লামা আবদুল মালেক নুরী (রহঃ)

143

বহু মানুষের ভিড়ে কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন, যাঁরা কর্মগুণে ও চরিত্র মাধুর্যে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত। অসামান্য ব্যক্তিত্ত্বের আকর্ষণে তাঁরা সবার মাঝে শ্রদ্ধা আর মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকেন। তেমনই একজন কীর্তিমান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন মুজাহিদে আহলে সুন্নাত হযরতুলহাজ্ব আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল মালেক নূরী (রাহঃ)। সুন্নিয়তের প্রচার আর ইলমে দ্বীনের প্রসারে তিনি নিজেকে আজীবন উৎসর্গীত রেখেছিলেন। আলেমদের মাঝে এ ধরনের বহুমুখী গুণ-কর্ম বৈশিষ্ট্য সাধারণত চোখে পড়ে না।
জন্ম ও বংশধারা :
আজীবন সংগ্রামী এই ব্যক্তিত্ব ১৯৪৮ সালের কোন এক পবিত্র দিনে বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার অন্তর্গত কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নের পশ্চিম এলাহাবাদ গ্রামের এক বুজুর্গ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম শেরমত আলী আর মাতা বিলকিস খাতুন দুজনই ছিলেন বুজুর্গ ব্যক্তি। আর নানা হযরত নূর বকসু ফকির (রাহঃ) ছিলেন গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী হযরত কেবলার (কঃ) খলিফা।
শিক্ষা ও কর্মজীবন :
তিনি বাল্যকাল থেকে প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন। স্থানীয় মক্তবে সহীহ কুরান শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তিনি ১৯৫৫ সালে তৎকালীন প্রবীণ শিক্ষাগুরু মাওলানা ইসহাকের (রাহঃ) গভীর স্নেহে গাছবাড়ীয়াস্থ হাশিমপুর মকবুলিয়া ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন। দ্বীনি জ্ঞানার্জনের প্রতি প্রবল আগ্রহে তিনি ঐ মাদ্রাসা থেকে ১৯৬৫ সালে দাখিল এবং ১৯৬৭ সালে আলিম পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য চট্টগ্রামের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৬৯ সালে উলা তথা ফাজিল এবং ১৯৭০ সালে টাইটেল তথা কামিল সমাপ্ত করেন। দারুল উলুমে অধ্য্যয়নকালে সে সময়ের যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন শায়খুল হাদীস মাওলানা ফুরকান ছাহেব (রহঃ), মুফতি মাওলানা আমিন ছাহেব (রহঃ), মুহাদ্দিস ও শায়ের মাওলানা মতিউর রহমান নেজামী ছাহেব (রহঃ), এবং আল্লামা ইসমাঈল আরকানী ছাহেব (রাহঃ) প্রমুখ হুজুরদের একান্ত সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। ১৯৭১ সালে তিনি চন্দনাইশের সেই সময়ের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তাঁহার স্মৃতিবিজড়িত বিদ্যাপীঠ হাশিমপুর মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ মাওলানা ইসহাকের অনুরোধে শিক্ষক পদে চাকুরি নেওয়ার মধ্য দিয়ে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সফলতার নজীর স্থাপন করেছেন।
সুন্নিয়ত ও দ্বীন প্রচারে ভূমিকা পালন :
নবীর সুন্নত তরিকা ভিত্তিক পারিবারিক জীবন ও সামাজিক জীবন গঠনের লক্ষ্যে দিনের বেলায় কুরান হাদীসের জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি রাত্রিবেলায় নবী প্রেমে উজ্জীবত সুমধুর কন্ঠে ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে তিনি এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, শুধু ইসলাম বিরোধী আক্বিদা নয়, মানবরচিত যাবতীয় মতবাদ পরিত্যাগ করে পবিত্র কুরান ও হাদীসের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যেই মানবের ইহকালীন কল্যাণ এবং পরকালীন নাজাত নিহীত। জীবনের পুরোটা অংশ তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দ্বীন ইসলামের বাণী প্রচারে এবং রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পবিত্র আদর্শ তথা সুন্নাত বাস্তবায়নে ব্যয় করেছেন। চট্টগ্রাম জেলা শহর ছাড়া ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি সাবলীল জীবনধর্মী এবং কুরান হাদীসের সঠিক বয়ান করে সাধারণ মুসলমানের অন্তরে নবী প্রেমের জোয়ার সৃষ্টি করেন। সুন্নিয়তের এই অতন্দ্র প্রহরীর কারণে এতদঞ্চলে আজ পর্যন্ত কোনো বাতিল সরল প্রাণ সুন্নি মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার সাহস দেখায়নি।
দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে ভূমিকা :
শিক্ষা নামের মহান আলোর দিশারীর নামই শিক্ষক। তিনি মোমের ন্যায় নিজে জ্বলে অপরকেও জলতে সাহায্য করেন। গড়ে তুলেন আলোকিত ভূবন আর সম্ভাবনাময় পৃথিবী। যে পৃথিবীতে গরীব আর অশিক্ষা এ নিয়তি মেনে নিয়ে সভ্যতার আয়োজনে নিজের স্বার্থের কথা প্রায় ভুলতেই বসেছে সেখানেই আলোর পথযাত্রী আল্লামা নূরী (রাহঃ) এর যাত্রা। তিনি হতাশা আর দারিদ্রের জীবন মান নির্ণয়ে আলোর প্রদীপ হাতে গড়ে তোলেন সুন্নিয়তের বড় এক মারকায পশ্চিম এলাহাবাদ আহমদিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা। নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত এই মাদ্রাসায় শুরু থেকেই বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা পান উনার বাল্যকালের পড়ার সাথী ও কর্মজীবনের একান্ত সঙ্গী বরেণ্য আলেম মাওলানা আব্দুস সবুর চৌধুরী সাহেবের। নিজ হাতে গড়া মাদ্রাসাটিকে তিনি আপন সন্তানের চেয়েও বেশি স্নেহ করতেন। নবগঠিত মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়নে তিনি সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। নিজের কষ্টার্জিত টাকা ব্যয় থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে তিনি মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষকদের বেতন ভাতা জুগিয়েছেন। সামনে থেকে যে কোন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে তিনি বরাবরই সচেষ্ট থাকতেন। আলোর ভূবনে শিক্ষা নামের বিশাল কর্মযজ্ঞে তিনি লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীদের জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন পুস্পের সমাহারে।উনার সেই আলোভূবনে আজ প্রতিষ্ঠিত লক্ষ লক্ষ ছাত্র, যারা দেশ বিদেশে দ্বীন-ধর্ম, শিক্ষা আর মানবতার কল্যাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
তরিকতের শিক্ষা লাভ :
শরিয়তের একজন বিজ্ঞ আলেম হয়ে ও তিনি অনুধাবন করলেন যে তরিকতের দীক্ষা ছাড়া একজন পূর্ণাঙ্গ আলেমে দ্বীন হওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি জাহেরী জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি বাতেনী এলেমের জন্য তরিকায়ে আলিয়া কাদেরিয়া নক্সবন্দীয়ার একজন সত্যিকার বাআমল হক্কানী পীর হযরতুলহাজ্ব শাহসুফী মাওলানা আবু মুহাম্মদ জোহাদুর রহিম (রহঃ) এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। বায়াত গ্রহণের পর পীরের সাথে উনার এতটা হৃদ্যতা এবং বাতেনী সম্পর্ক গড়ে উঠে যে তিনি এক মূহুর্তের জন্য আপন পীরের সুহবত থেকে সরে দাঁড়াননি। স্বীয় পীর ও উনাকে এতটা কাছে টেনে নেন যে হুজুরকে আপন সন্তানের শিক্ষক মনোনিত করে দীর্ঘ কাল উনার খেদমতে রাখেন। পীরের সুহবতে তিনি শরীয়তী এলেমের পাশাপাশি মারেফাতের অনেক ঊঁচু মকামে পৌঁছেন।
সাদামাটা জীবনযাপন :
এত উঁচু মাপের একজন আলেমে দ্বীন হয়েও তিনি অত্যন্ত সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। অহংবোধ বলতে উনার চরিত্রে ছিল না। মিষ্টিভাষী এ ব্যক্তিত্বের সাথে এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সুসম্পর্ক ছিলো। নিজ জন্মস্থানের প্রতি ভালোবাসা উনাকে সবসময় সিক্ত করত। নিজ এলাকার মাঠি ও মানুষের প্রতি উনার বেশি অনুরাগ ছিলো। তাই তিনি জীবনের পুরোভাগই সেখানে কাটিয়ে দেন। আপন এলাকার মসজিদে তিনি দীর্ঘ ৪৮ বছর তথা ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত হাদিয়া ছাড়া খেতাবতের দায়িত্ব পালন করে অনন্য নজীর স্থাপন করে মুসল্লী তথা এলাকাবাসীকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ) এর আশেক এবং আউলিয়া-আলেমের অনুরাগী বানিয়েছেন।
ইন্তেকাল :
মহান এই শিক্ষাগুরু এবং বুযুর্গ আলেম লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী আর ভক্ত অনুরাগীদের শোকসাগরে ভাসিয়ে ২০১৯ সালের আজকের এই দিনে মহান আল্লাহর ও তাঁর হাবীবের দীদার লাভে ধন্য হন। হুজুর মানুষের মাঝে কতটা গ্রহণযোগ্য ও সম্মানের পাত্র ছিলেন তা উনার জানাযার নামাজে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিই প্রমাণ করে।আজ হুজুরের ১ম বার্ষিক ফাতেহা শরীফ উদযাপন উপলক্ষে আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল মালেক নূরী (রহঃ) ফাউন্ডেশনের উদ্দ্যেগে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) এর আয়োজন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়।আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হুজুরের দারাজাতকে আরো সমুন্নত করুন এবং আমাদেরকে উনার আদর্শ অনুসরণ ও পালনের তাওফিক দান করুন।
আমীন বেহুরমতে সায়্যিদিল মুরসালীন।

লেখক : প্রাবন্ধিক