ইসলামী ব্যক্তিত্ব মাওলানা শেখ মুহাম্মদ আবুল বশর (রাহ্.)

58

মাওলানা মুহাম্মদ জহুরুল আনোয়ার

বিশিষ্ট সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী মাওলানা শেখ মুহাম্মদ আবুল বশর (রহ.) ১৯৪০ সালের পহেলা ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলাধীন দক্ষিণ শিলাইগড়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ভ‚মিষ্ঠ হন। তার পিতা মরহুম শেখ মুহাম্মদ রগবত আলী সর্দার সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী ছিলেন। মাতা খঞ্জন বিবি অত্যন্ত পরহেযগার ও পর্দানশীন ছিলেন। তাদের দু’সন্তান। জ্যেষ্ঠ পুত্র মরহুম শেখ মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দীক। তিনি কাস্টম্স-এর সিনিয়র কালেক্টর ছিলেন। কনিষ্ঠ পুত্র মাওলানা শেখ মুহাম্মদ আবুল বশর (রহ.)।
শিক্ষা : তিনি স্থানীয় মক্তবে শিক্ষা লাভের পর কর্ণফুলী উপজেলার শাহ্মীরপুর ফয়জুলবারী ফাযিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৩ সালে দাখিল ও ১৯৫৫ সালে আলিম, পটিয়া কালারপুল অহিদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৭ সালে ফাযিল এবং পাঁচলাইশ ওয়াজেদিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৯ সালে কামিল হাদীস ডিগ্রী অর্জন করেন।
শিক্ষকতা : বরেণ্য এ আলিমে দীন কর্ম জীবনের প্রথমে পটিয়া কালারপুল অহিদিয়া ফাযিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। পরে পটিয়া কৈনপুরা উচ্চ বিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্ম শিক্ষক পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকতায় নিযুক্ত হয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং কয়েকটি বিদ্যালয়ে বদলি শেষে শিলাইগড়া আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
শিক্ষা বিস্তার : আদর্শ শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। তবে কিছু নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকও আছেন যারা সুশিক্ষা দান ও জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানুষ গড়ার পাশাপাশি শিক্ষা বিস্তার এবং শিক্ষা প্রসারেও নানাভাবে অবদান রাখেন। তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘বারখাইন জামেয়া জমহুরিয়া ফাযিল মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি এ মাদ্রাসার স্থাপন, উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও সমৃদ্ধিতেও ব্যাপক ভ‚মিকা রাখেন।
ইসলামী ঐতিহ্য ও আদর্শ বিস্তার : তিনি ওয়ায-নাসীহাত ও খেতাবাত-এর মাধ্যমে ইসলামের নীতি-আদর্শ ও শিক্ষা-সংস্কৃতি বিস্তার এবং মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টিতে অসাধারণ ভ‚মিকা রাখেন। তিনি ইসলামী দাওয়াহ্ বিকাশে মুবাল্লিগে দীন ছিলেন। তিনি মায্হাবে হানাফী, আক্বায়িদে আহ্লে সুন্নাত, মাস্লাকে আ‘লা হযরত ও সিল্সিলায়ে আলিয়া ক্বাদিরিয়ার ইশা‘আতে আজীবন ভূমিকা রাখেন। তিনি সামাজিকভাবে ইসলামী মূল্যবোধ প্রসারে এবং মুসলিম ঐক্য ও সংহতি জোরদারে সর্বদা আন্তরিক ছিলেন। এজন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধা ও আস্থাভাজন ছিলেন। সর্বক্ষেত্রে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকায় তার আহŸানে এলাকার তিন গ্রামের মুসল্লী একত্রিত হয়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করতেন। আনোয়ারা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ঝিওরী-বারখাইন-শিলাইগড়া উচ্চ বিদ্যালয় ময়দানে দু’ঈদের জামা‘আতে তার ইমামাত, খেতাবাত শেষে মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্য-সংহতির প্রতি তার উদাত্ত আহবান মুসল্লীদের অনুপ্রাণিত করত।
জনহিতকর কর্ম ও সমাজসেবা : তিনি এলাকার শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট ও গ্রামীণ অবকাঠামোর সংস্কার ও সম্প্রসারণে আনোয়ারা সংসদীয় আসনের এমপি, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের অবহিত করতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন। গরীব ও অসহায় পরিবারের শিক্ষার্থীদের বই পুস্তক ও শিক্ষা উপকরণ প্রদানের ব্যবস্থা করতেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতার কন্যা বিবাহে আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তিনি সর্বদা পরোপকারী, মিষ্টভাষী ও সদালাপী ছিলেন।
অধ্যবসায় ও জ্ঞানসাধনা : তিনি ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষা অর্জন ও প্রদানের পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞানও চর্চা করতেন এবং সমাজবাসীকেও এতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আরবী, উর্দু ও ফার্সি ভাষার প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য বহু কিতাব, রিসালাহ্, গ্রন্থ ও পুস্তক রয়েছে। তিনি জ্ঞান সাধনায় নিবিড়ভাবে মগ্ন থাকতেন।
তিনি ইমামে আহলে সুন্নাত হযরত আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল্ক্বাদেরী শেরে বাংলা (রহ.)-এর স্নেহভাজন ছিলেন।
শায়খুল হাদীস হযরত আল্লামা মুহাম্মদ আজিজুর রহমান (রহ.) ও ইমামে আহলে সুন্নাত হযরত আল্লামা ক্বাযী মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) তার শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদ ছিলেন।
আগ্রাবাদের পীরে ত্বরীক্বাত হযরত আল্লামা মুহাম্মদ সাইফুল রহমান নিযামী (মুদ্দাযিল্লুহুল আলী), বোয়ালখালীর হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইদ্রীস রিজভী (মুদ্দাযিল্লুহুল আলী), গায্যালিয়ে যামান অধ্যক্ষ হযরত আল্লামা মুহাম্মদ মুসলেহ্ উদ্দীন (রহ.), শেরে মিল্লাত হযরত মুফতী মুহাম্মদ ওবাইদুল হক নঈমী (রহ.), খতীবে বাঙ্গাল হযরত আল্লামা অধ্যক্ষ মুহাম্মদ জালাল উদ্দীন আল্ক্বাদেরী (রহ.), প্রফেসর ড. মাওলানা আ ন ম মুনীর আহমদ চৌধুরী (রহ.) বাঁশখালীর হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আশরাফ আলী (রহ.), ঝিওরী গ্রামের মাওলানা মুহাম্মদ বরকত উল্লাহ্ (রহ.), আইরমঙ্গল গ্রামের মাওলানা মুহাম্মদ আজিজুর রহমান (রহ..), শিলাইগড়া গ্রামের মাওলানা ফয়েজ আহমদ শাহ্ মাইজভান্ডারী (রহ.) প্রমুখের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি তাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ মাস্য়ালা ও ফাতাওয়া বিষয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করতেন।
সম্পত্তি বন্টনে ইসলামী আইন ও বিধান ‘ফারায়িয’ এবং মুসলিম পারিবারিক, সামাজিক সমস্যা ও তালাক বিষয়ক জরুরি ‘মাসয়ালা ও ফাতাওয়া’ প্রদানে তিনি পারদর্শী আলিম ছিলেন।
দাম্পত্য ও সন্তান-সন্ততি :  ১৯৫৮ সালের ২৬ অক্টোবর আনোয়ারা উপজেলাধীন বারখাইন ইউনিয়নের ঝিওরী গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মোজাহের দোভাষ পরিবারের মরহুম হাজী আহমদ হোসেনের জ্যেষ্ঠ কন্যা আনোয়ারা বেগমের সাথে তার শাদীয়ে মুবারক হয়। তিনি পর্দানশীন ও পরহেযগার ছিলেন। তাদের চার পুত্র এবং দু কন্যা সন্তান রয়েছে। ১ম পুত্র এসএম হোসেন চৌধুরী, ২য় পুত্র এসএম আখতার হোসেন চৌধুরী, ৩য় পুত্র মাওলানা শেখ মোহাম্মদ সরওয়ার হোসেন, ৪র্থ পুত্র শেখ মোহাম্মদ বুরহান উদ্দীন স্ব স্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নিয়োজিত আছেন। ১ম কন্যা গেলমান আরা বেগম গৃহিণী ও ২য় কন্যা জান্নাতুল ফিরদাউস শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন।
মাওলানা শেখ মোহাম্মদ সরওয়ার হোসেন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পাশাপাশি ইসলামী আদর্শ, দর্শন, মূল্যবোধ ও চিন্তাচেতনা প্রচার প্রসারে ভূমিকা রেখে আসছেন। তিনি ‘পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলাম’ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বারখাইন জামেয়া জমহুরিয়া ফাযিল মাদ্রাসা গভর্নিং বডির সদস্য হয়ে মাদরাসার উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। তিনি পারিবারিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘মাওলানা শেখ মুহাম্মদ আবুল বশর ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। ফাউন্ডেশন-এর মাধ্যমে তিনি ইসলামী আদর্শ শিক্ষা বিস্তার, জনহিতকর কর্ম ও সমাজকল্যাণে ভ‚মিকা রেখে আসছেন।
ইন্তেকাল : তিনি ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ অক্টোবর, ১৪১৪ হিজরীর ২৫ রবিউস্সানী, ১৪০০ বঙ্গাব্দের ২৭ আশ্বিন, মঙ্গলবার ইন্তেকাল করেন। তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর তার স্ত্রী ইন্তেকাল করেন। তাকেও পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। আল্লাহ্পাক তাদের জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চাসন দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।

লেখক : প্রাবন্ধিত