ইসমাইল আল জাজারি রোবট শিল্পের জনক মধ্যযুগের একজন মুসলিম প্রযুক্তিবিদ

74

শেখ বিবি কাউছার

সা¤প্রতিক সময় বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা রোবটিক্স। যা এককালে ছিল কল্পনার বিষয়। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন মধ্যযুগের একজন মুসলিম যন্ত্র প্রকৌশলী প্রথম রোবট শিল্পের উদ্ভাবক। এর মূল ধারণা প্রথম তাঁর মাথায় এসেছিল। যাঁকে প্রাক্‌-আধুনিক যুগের রোবটিকসের জনক বলা হয়। বিভিন্ন মৌলিক যান্ত্রিক উদ্ভাবনের কারণে তাঁকে আধুনিক প্রকৌশলের জনকও বলা হয়ে থাকে। নাম তাঁর আল-জাজারি, পুরো নাম বদিউজ্জামান আবুল-ইজ ইবনে ইসমাইল ইবনে রাজাজ আল-জাজারি। জন্ম ১১৩৬ সালে, বর্তমান আধুনিক তুরস্কের জাজারিয়ায়। তিনি যে শুধু যন্ত্র প্রকৌশলী ছিলেন তা কিন্তু নয়, ছিলেন একাধারে ধর্মীয় পÐিত, আবিষ্কারক, কারিগর, শিল্পী ও দক্ষ গণিতবিদ।
অনেক সময় মধ্যযুগের ইতিহাস পড়তে গেলে মনে হতে পারে যে মুসলিমরা প্রযুক্তিতে বেশ পিছিয়ে ছিল। আর আমরা এই প্রজন্মের মানুষেরা মনে করি আমাদের যুগটাই আধুনিক। প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, প্রতিটি যুগই হলো আধুনিক। কারণ প্রতিটি যুগেই এমন কিছু মানুষের জন্ম হয় যাঁদের সৃজনশীলতা সেযুগকে অন্যান্য করে তুলে। আসলেই কিন্তু তাই ; অন্তত ইসমাইল আল জাজারির জীবনী ও কর্ম জেনে ভুল ভাঙ্গবে আমাদের। আল-জাজারির শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। তবে পারিবারিকভাবেই তিনি প্রকৌশলবিদ্যা রপ্ত করেন এবং ১১৮১ সাল থেকে তিনি বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়ার দিয়ারবাকির রাজ্যের সুলতান নাসিরুদ্দিনের দরবারের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ১১৭৪ সাল থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত বিজ্ঞান সাধনায় লেগে থাকেন তিনি। বিজ্ঞানে প্রথম রোবটিক যন্ত্রের আবিষ্কার করেন এই মহান বিজ্ঞানী। তাঁর গবেষণাকর্মে সহযোগিতা করেন আদির অঞ্চলের শাসক নাসির উদ্দীন মাহমুদ (তিনি সালাহউদ্দীন আইয়ুবির বংশধর ছিলেন)। তার আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ঘড়ি, দৃষ্টিনন্দন ঝর্ণা, হাত ধোয়ার যন্ত্র, পানি উত্তোলন যন্ত্র, সুরযন্ত্র, স্বয়ংক্রিয় ফটক ইত্যাদি। আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলোর মধ্যে কয়েকটি এতই উন্নত ছিল যে, সেগুলো যে আটশো বছর পূর্বে তৈরি, সেটি জেনে অবাকই হই। চাকার শ্যাফটে একধরনের ঘূর্ণায়মান যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যাকে ক্যামশ্যাফট বলা হয়। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তৈরির জন্য আল জাজারি তৈরি করেন পৃথিবীর প্রথম ক্যামশ্যাফট। এই ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন নিজের তৈরি জলঘড়ি, অটোম্যাটা আর পানি উত্তোলন যন্ত্রেও। বেশ সহজ গঠনের এই যন্ত্রাংশটি তৈরির সাথে সাথেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ১৪ শতকে ইউরোপে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। তাঁর মৃত্যুর ১০০ বছর পর ইউরোপের বিজ্ঞানীরা সেসব ধারণা নিয়ে বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কার করেন। ইংরেজ ইতিহাসবিদ ডোনাল্ড আর হিল তাঁর রচিত ‘স্টাডিজ ইন মেডিয়েভল ইসলামিক টেকনোলজি’ পুস্তকে উল্লেখ করেন : ‘প্রকৌশলের ইতিহাসে আল-জাজারির গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আধুনিককাল পর্যন্ত আর কোনো সভ্যতা থেকে এর তুলনীয় যন্ত্রের নকশা, উৎপাদন ও বিভিন্ন নির্দেশসংবলিত তেমন কোনো রচনা পাওয়া যায়নি। এর প্রভাব পরবর্তীকালের স্টিম-ইঞ্জিন এবং অন্তর্দাহ যন্ত্রের (রহঃবৎহধষ পড়সনঁংঃরড়হ) নকশায় দেখা যায়।’
আল জাজারির কিছু স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বা কৃত্রিম যন্ত্রের নমুনা জানলে আপনিও অবাক হবেন। সেগুলো হলো – স্বয়ংক্রিয় ফ্লাশ মেকানিজমসমৃদ্ধ একটি ওয়াশিং মেশিন। যার মাধ্যমে বাদশাহ নাসির উদ্দীন মাহমুদ অজু করতেন। আজকের বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটাই পৃথিবীর সর্বপ্রথম রোবটিক যন্ত্র! এখান থেকেই অন্যান্য রোবটিক যন্ত্রের ধারণা তৈরি হয়। হাইড্রোপাওয়ার চালিত পৃথিবীর প্রথম দিকের একটি স্বয়ংক্রিয় দরজা তৈরি করেন জাজারি। আধুনিককালে এমন অনেক ঘড়িতে যেরকম নির্দিষ্ট সময়ে ঘন্টা দেয়ার জন্য একধরনের স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে যায়, যা থেকে কোনো পাখি বা বিশেষ বস্তু বেরিয়ে আসে, জাজারি নিজের তৈরি একটি জলঘড়িতে এমন স্বয়ংক্রিয় দরজা ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে মানুষের বদলে রোবট ওয়েটারের ব্যবহার শুরু হয়েছে খুব জোরেশোরে। যদি বলি, বিশ্বের প্রথম রোবট ওয়েটারটি আল জাজারি তৈরি করেছিলেন ! গঠনে, যান্ত্রিক কৌশলে অনেক পিছিয়ে থাকলেও জাজারির চিন্তাভাবনা ছিল বিস্ময়করভাবে অগ্রসর। অবশ্য জাজারি ওয়েটার নয়, ওয়েট্রেস বা পরিচারিকা তৈরি করেছিলেন। তার পরিচারিকাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চা, পানি কিংবা মদ পরিবেশন করতে পারতো। একটি মাঝারি আকৃতির ট্যাংকের মধ্যে থাকতে পানীয় যা ফোঁটায় ফোঁটায় প্রতি সাত মিনিটে নির্দিষ্ট পাত্র বা পেয়ালায় জমা হতো। এরপর সেটি একটি স্বয়ংক্রিয় দরজার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে পরিবেশন করতো সে পানীয়! পৃথিবীর প্রথম ফ্লাশ টয়লেটের ধারণাও আসে তারই একটি আবিষ্কার থেকে। হাত ধোয়ার জন্য একটি অত্যন্ত শৌখিন যন্ত্র তৈরি করেন আল জাজারি, যা আজকের পৃথিবীতে বসেও ভীষণ রকমের শৌখিনই মনে হবে। ‘পিকক ফাউন্টেইন’ নামক যন্ত্রটি এরূপ- দেয়ালের মধ্যে একটি যান্ত্রিক ময়ূর স্থাপিত, যার লেজে রয়েছে একটি প্লাগ। এই প্লাগ টানলেই ময়ূরের ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করবে পানি! পানিতে আপনি হাত ভিজিয়ে নিতে নিতে আরেকটি প্লাগ টানুন, ময়ূরের নিচ থেকে এবার একটি স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে গিয়ে আপনার জন্য সাবান উপস্থিত হবে। সাবান মাখিয়ে হাত ভালোমতো ধুয়ে পুনর্বার আরেকটি প্লাগ টানুন, বেরিয়ে আসবে তোয়ালে! অটোম্যাটেড ময়ূর থেকেও আরো বিস্ময়কর যন্ত্র তৈরি করেছেন আল জাজারি। আর তা হচ্ছে ‘মিউজিক্যাল অটোম্যাট’ বা একটি রোবটের ব্যান্ডদল! রাজকীয় কোনো অনুষ্ঠানে অতিথিদের বিনোদন প্রদানের জন্য জাজারি তৈরি করেন একটি রোবট ব্যান্ড। একটি ছোট নৌকার উপর বসানো থাকে চারজন কৃত্রিম সঙ্গীতজ্ঞ। নৌকাটি লেকে ছেড়ে দেয়া হলে তা লেকের ঢেউয়ের সাথে দুলতে থাকে এবং ছন্দময় সুরের সৃষ্টি করে সেই চার বাদক! ঘড়ির প্রতি আল জাজারির ছিল বিশেষ আকর্ষণ। তাই বছর জুড়ে দিনের দৈর্ঘ্যরে তারতম্য নির্ণয়ের জন্য তৈরি করেন একটি ‘এলিফ্যান্ট ক্লক’। তবে আল জাজারির সবচেয়ে চমৎকার নির্মাণ হচ্ছে তার ‘ক্যাসেল ক্লক’। ডিজিটাল ঘড়ির মতো এই ঘড়িতেও ছিল অ্যালার্ম ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট সময় পর বাদ্য বাজাতে শুরু করতো ঘড়ির নিচে অবস্থিত একদল কৃত্রিম বাদক।
তিনি শুধু একজন ভালো যন্ত্র নির্মাতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন দক্ষ চিত্রশিল্পীও। তিনি যা কিছু তৈরি করেছেন, সবকিছুরই ডিজাইন খুব সুন্দর করে এঁকে রেখেছিলেন। এই চিত্রকর্মগুলো পরে যুক্ত করেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বই ‘দ্য বুক অব নলেজ অব ইনজেনিয়াস মেকানিক্যাল ডিভাইসেস’ এ। তিনি ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন তার এই অসাধারণ বইটির জন্য। এই বইয়ে তিনি অসংখ্য যন্ত্রের যান্ত্রিক কৌশল এবং প্রস্তুত করার কার্যপ্রণালী উল্লেখ করেছেন। মূলত, উপরে তার যেসব যন্ত্রের কথা আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশরই কোনো নমুনা পাওয়া যায় না। তবে যন্ত্রগুলো যে আল জাজারি নির্মাণ করেছিলেন, তাতে ইতিহাসবিদগণ একমত। কারণ প্রতিটি যন্ত্রের নির্মাণকৌশল ছিল অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং তখনকার সময়ে নির্মাণযোগ্য। গণিতেও আল জাজারির গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন একজন দূরদর্শী প্রকৌশলী, উদ্ভাবক এবং নির্মাতা হিসেবে।
লেখক: প্রভাষক- নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ