ইতিহাস-গবেষক জামাল উদ্দিনের গ্রন্থ ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য’

193

রফিক আহমদ খান

আমরা গত শতাব্দীর আশির শুরুতে জন্মগ্রহণ করেছি; চট্টগ্রামী ভাষায় কথা বলেছি জীবনের প্রথম বুলি থেকে। আমাদের মা-বাবা, দাদিদের প্রথম বুলিও চট্টগ্রামী ভাষা। আমরা পড়ালেখা করেছি, বড় হয়ে গ্রামের বাইরে এসে প্রমিত বাংলায় কথা বলেছি, কথা বলি। আর আমাদের দাদা-দাদিরা ও তাদের পূর্বসূরিরা বলতে গেলে জীবনের সমস্ত কথাই বলেছেন চট্টগ্রামের ভাষায়। একুশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত চট্টগ্রামের অধিকাংশ মানুষ এক জীবনে সমস্ত কথোপকথন করেছেন চট্টগ্রামের ভাষায়। শুধু কী কথোপকথন? তারা আনন্দ-বিনোদনের জন্য গান শুনেছেন, গান করেছেন- চট্টগ্রামের ভাষায়। তারা কবিগান করেছেন চট্টগ্রামের ভাষায়। পালাগান করেছেন, ধাঁধা বলতেন চট্টগ্রামের ভাষা, নাচ করেছেন চট্টগ্রামী ভাষার গানের সুরে সুরে, তালে তালে। ঝগড়াঝাটি, গালাগালি! তা-ও চট্টগ্রামের ভাষায়। প্রবাদ-প্রবচন উচ্চারণ করেছেন। অর্থাৎ মানুষের এক জীবনে কথোপকথন, আনন্দ বিনোদন, মান-অভিমান, প্রেম-ভালোবাসা, আঞ্চলিক ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছু সাধন হয়েছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। তার মানে তারা প্রমিত ভাষা ব্যবহার করেন নি তা নয়। সঠিক কথা হচ্ছে বিংশশতাব্দী পর্যন্ত চট্টগ্রামের দাদা-দাদি, নানা-নানিদের বলতে গেলে আশি শতাংশ মানুষ প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন না। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় সব কথোপকথন করতেন তারা। মানুষ পড়ালেখা না-জানলেও কথার চলে, গল্পের চলে তখনকার মানুষ মুখে-মুখে ছড়া, গান, গল্প, ধাঁধা বানাতেন বলে ধারণা করছি— এ-বিষয়ে কিঞ্চিৎ ভাবনা চিন্তায়।
উপরে উল্লেখ করলাম প্রবাদ-প্রবচের কথা। প্রবাদ-প্রবচন একটি ভাষার অমূল্য সম্পদ। জীবনাচরণে ধর্মচর্চা, আনন্দ-বেদনা, আচার-আচরণ, রসবোধ, সংক্ষেপে জ্ঞানপ্রদান, খোঁচা ও ক্ষোভ প্রকাশে প্রতিটা ভাষার জ্ঞানী গুণী মানুষেরা একবাক্যে যে সার কথা বলতেন তা-ই প্রবাদপ্রবচন হিশেবে পরবর্তী প্রজন্ম প্রচলন রেখেছেন বা অনেকের কাছে চর্চিত হয়ে বাক্যগুলো স্থায়ীভাবে ভাষায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আগের দিনে মানুষের পড়ালেখা জানা না-থাকলেও সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মেধা থেকে তারা এ-সব বাক্য উচ্চারণ করেছেন। পৃথিবীর সব ভাষায় প্রবাদ-প্রবচন আছে। প্রবাদ-প্রবচনে বোঝা যায় ভাষা কতটা সমৃদ্ধ। চট্টগ্রামের ভাষা কতোাঁ সমৃদ্ধ ভাষা তা আমরা অনুধাবন করতে পারি চট্টগ্রামী ভাষার বিপুল প্রবাদ-প্রবচন দেখে-পড়ে-শুনে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথোপকথনে প্রায়ই আমরা প্রবাদ-প্রবচন ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু আমরা হয়ত কখনো হিশাব করে দেখেনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কতগুলো প্রবাদ-প্রবচন আছে। তা-দেখে অবাক হলাম লেখক-গবেষক জামাল উদ্দিনের ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য’ নামে গবেষণাগ্রন্থে। গ্রন্থটিতে লেখক ‘লেখকের কথা’য় উল্লেখ করেছেন তাঁর কয়েক বছরের বিরামহীন প্রচেষ্টায় এই গ্রন্থ পাঠককে উপহার দিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রচেষ্টা সফল মনে করছি— বইটিতে চাটগাঁইয়া ভাষার এগারোশো ছয়টি প্রবাদ-প্রবচন দেখে। এখনো আমরা চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলার সময় প্রবাদ-প্রবচন উচ্চারণ করে থাকি। অনেকগুলো প্রবাদ-প্রবচন বিলুপ্তি হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে। জামাল উদ্দিন হারিয়ে যাওয়া সে-সব প্রবাদবাক্য সংযোজন করেছেন বইটিতে। চট্টগ্রামী ভাষার প্রবাদ-প্রবচনগুলো শুনতেও মজা লাগে। কিছু প্রবাদবাক্য উল্লেখ করছি—
‘অতি সুন্দরীর ন্কে নাই, অতি নেকাইনর্ ভাত নাই।’, ‘আধার আতর্ লডি’, ‘আদা চুরনীর মনে গুত্গুতি’, ‘উনা ভাতে দুনা বল্, ভরা পেডে রসাতল’, ‘কোলৎ মারে পোষ্যৈন্ ন দে’, ‘গরুত্তে পুছার্ গরি হাল্ ন চয়’, ‘চুরনীর মার্ বর্ গলা’, ‘ছাঅলে বিআয়্ হিয়ালে খায়’, ‘জোগর্ মুঅৎ নুন পরন্’, ‘দুক্কর রাইৎ ন ফুরায়’, ‘পঁথৎ পাইলে সোনা, কানৎ দেঅন্ মানা?’, ‘পোঁদৎ নাই তেনা, মিডাদি ভাত খানা’, ‘পোয়ার হাতৎ কেলা দিলে বুরার মন পায়’, ‘বাঁআলর্ পেডে ঘি নসয়’, ‘বাত্তির তলে আঁধার’, ‘ভাঙ্গা ঠেং গাঁতৎ পরে’, ‘ভেঁউরার বাআত্ দলা ন মারিছ’, ‘মেজ্জাইন্যা ভাতে ফইর্ বিদায়’, ‘যার্ ঘরৎ ভাত, তার্ ঘরৎ জাত্’, ‘মনে মনে মনকেলা খাঅন্’ এ-রকম মজার মজার এগারো-শো প্রবাদ-প্রবচন।
পাঁচ-শো পৃষ্ঠার সুপরিসর বইটিতে চট্টগ্রামের লোকসাহিত্যের ব্যাপক বিষয়-আশয় উপস্থাপিত হয়েছে। চট্টগ্রামের লোকসাহিত্যোর ভান্ডার বিশাল। চর্চার বাইরে থাকায় হারিয়ে যেতে থাকা লোকসাহিত্যের মণিমুক্তার বিশাল ভান্ডারের অনেককিছু তিনি আমাদের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক জায়গায় এনে গ্রন্থভুক্ত করে মূল্যবান কাজ করেছেন। তার এই বইয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রামী ভাষার লোকসাহিত্য কিছুটা সংরক্ষণ থাকলো এবং এর কিছুকিছু আমাদের আধুনিক জীবনেও ব্যবহার হবে। মানুষের যাপিত জীবনে মাঝেমাঝে পুরোনো ফ্যাশন নতুন করে নতুন রূপে আসে। তেমন এক সময় চট্টগ্রামের মানুষ আবারো চট্টগ্রামের মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় ব্যাপক মনোযোগী হবেন নিশ্চয়ই। তখন চাটগাঁইয়া ভাষার শেকড়ে ও ইতিহাস-ঐতিহ্য খোঁজাখুঁজি করবেন অনেকেই। তখনই জামাল উদ্দিনের ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য’ ও এ-রকম শ্রমলব্ধ গবেষণাগ্রন্থগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে সার্বজনীন। তবে সমকালে ও ভবিষ্যতে বা সবসময় এই বইটি মূল্যবান আকরগ্রন্থ হয়ে থাকবে চট্টগ্রামের ভাষা ও লোকসাহিত্যের আগ্রহী লেখক-পাঠক এবং আগামীদিনের গবেষকদের জন্য। বইটিতে চট্টগ্রামী ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরেছেন লেখক। প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক কাল ও সমকালের লোকসাহিত্য চর্চা নিয়েও আলোচনা করেছেন লেখক। চট্টগ্রামের ভাষায় কীভাবে আরবী, ফারসি, উর্দু, হিন্দির পাশাপাশি অনার্য বা দ্রাবিড় ভাষা, বর্মী বা আরাকানী ভাষা, পালি শব্দ মিশ্রিত হয়েছে তা তুলে ধরেছেন উদ্ধৃত সহকারে। চট্টগ্রামের ভাষায় বহুল ব্যবহৃত ‘হোয়াইশ’ শব্দটা ফারসী ভাষা থেকে সংযুক্ত হয়েছে। এ-রকম অনেক শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায় গ্রন্থটি পাঠে। সবচেয়ে যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা হলোÑ ‘চট্টগ্রাম’ এর মূল স্থান নিয়ে আলোচনার প্রয়াস। মানে কর্ণফুলীর এপার ওপার ও মধ্য চট্টগ্রামসহ কোন স্থান আদি থেকে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলা মানুষের বাস, আর কোন স্থানে পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে এসে জনবসতি গড়ে তুলেন এবং এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম জেলায় চট্টগ্রামী ভাষার যে সামান্য পার্থক্য হয়ে গেছে তা বিস্তারিত আলোচনা সহকারে তুলে ধরেছেন গবেষক জামাল উদ্দিন। যেমন স›দ্বীপ, মিরসরাই ও সীতাকুন্ডের এক অংশের ভাষা মোটেই চট্টগ্রামের ভাষা নয়। মধ্য ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে উচ্চারণ করেন, ‘ইতা জালদি মাছ ধৈরগে’, উত্তর চট্টগ্রামে উচ্চারণ করেন, ‘ইতা জালদি মাছ ধৈর্যে’। উচ্চারণের এই ভিন্নতা অত্যন্ত চমৎকারভাবে আলোচনা করেছেন জামাল উদ্দিন। চট্টগ্রামের লোকসাহিত্যের ঐতিহ্য ‘চাঁদ সওদাগর ও মনসা-মঙ্গলের কাহিনি’, ‘পরীবানুর হঁঅলা’, ‘ভেলুয়া-আমির সওদাগরের কাহিনি’, ‘কলম সওদাগর’, ‘মলকা বানু-মনু মিয়ার প্রেম কাহিনি’ স্থান পেয়েছে বইয়ে। আরেক লোক-গবেষক শামসুল আরেফীন সংগ্রহীত চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার পুরানগড়ে জন্ম নেওয়া আস্কর আলী পন্ডিতের লেখা তিয়াত্তরটি লোকগীতি ও চন্দনাইশের মুরাদাবাদ গ্রামের খায়েরজ্জান পন্ডিতের লোকগীতি সন্নিবেশিত হয়েছে বইটিতে।
ঘুম যারে দুধের বাছা/ ঘুম যারে তুই, / ঘুমতুন উডিলে বাছা/ কোলত লইয়ম মুই/ ঘুম যারে যাদু মনি ঘুম যারে তুই, / ঘুমতুন উডিলে বাছা / বচ্ছু দিয়ম মুই। তাই তাই তাই/ মামার বাড়িত যাই/ মামায় দিয়ে খৈয়ের মোলা দুয়ারত বই খাই,/ মামী দিয়ে কড়ই চুরা/ হাতে লইয়া যাই। ঘুমপাড়ানি ও ছেলে ভুনালো ছড়া— যে ছড়াগুলো শুনিয়ে এখনো চট্টগ্রামের গ্রাম অঞ্চলের মা-দাদিরা শিশুদের ঘুম পাড়ান সে-রকম ছাব্বিশটি ছড়া স্থান পেয়েছে। এছাড়া বৃষ্টি ডাকার গান, রোদ ডাকার গান, জেলে সম্প্রদায়ের গান, ভাবের গান, গরু দাগান্যার গান, উল্টা বাউলের গান, মাইজভান্ডারি গান, কবিয়াল রমেশ শীলের গান, বিলাপ, চড়কপূজা, ফুল পাঠ, পুঁথি পাঠ, পল্পীকবির কণ্ঠে কয়েকটি গান সংযোজন হয়েছে বইয়ে। লোকসাহিত্যের একটি অংশ ‘সওয়াল জওয়াব’। এগুলো চট্টগ্রামী ভাষায় না-হলেও চট্টগ্রামে বেশ ব্যবহার হতো এমন বিশটি সওয়াল জওয়াব আঞ্চলিক শব্দার্থসহ আমাদের জন্য লিখেছেন জামাল উদ্দিন।
‘রঙ্গুম রঙ্গিলারে’ শিরোনামে মজর এক তথ্য দিলেন লেখক। গ্রাম বাংলার তরুণেরা রঙ্গুম রঙ্গিলার দেশে, মানে বার্মার রেঙ্গুনে গিয়ে অনেকে আর ফিরে আসতো না। রেঙ্গুমের মায়াবিনী চেহারার মেয়েদের প্রেমে পড়ে, বিয়ে করে সেখানেই থেকে যেতো। এদিকে দেশে মা-বাবা, ভাইবোন আত্মীয় স্বজনের জন্য ব্যাপারটি ছিল বিরহের। এ-নিয়ে অনেক লোকগীতি গৃষ্টি হয়েছিল।
আমরা মনে করি, লোকসাহিত্যের বোদ্ধা পাঠকের জন্য যেমন বইটি মূল্যবান গ্রন্থ হিশেবে বিবেচিত হবে, তেমনি সাধারণ পাঠকদের মনের বহুরৈখিক খোরাক মেটাবে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ শেকড়ের রস-রসিকতার খোঁজ পেয়ে ঋদ্ধ হবেন। আমাদের দাদা-দাদি নানা-নানিরা এবং তাদের পূর্বসূরিদের এক জীবনের সুখ-দুঃখ, বিরহবেদনা, ক্ষোভ, খোঁচা, প্রার্থনা, গান, ধাঁধাসহ সমস্ত কথোপকথন ও কথামালার আসল নির্যাসটুকু খুঁজে পাই জামাল উদ্দিনের এই আকরগ্রন্থে। চট্টগ্রামের বাসিন্দা তথা চাটগাঁইয়াদের পাঠটেবিলে যত্নে স্থান পেতে পারে ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য’ গ্রন্থটি। এই বই পাঠটেবিলে থাকা মানে আমাদের শেকড়ের রস-রূপ-লাবণ্য-প্রাচুর্য হাতের ছোঁয়ায় থাকা। মূল্যবান এই বইটি চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশন থেকে ২০১৯ বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠকগণ ৪০ মোমিন রোড, চট্টগ্রাম বলাকা প্রকাশনের অফিস থেকে সরাসরি অথবা রকমারি ডটকম থেকে অনলাইনে সংগ্রহ পারবেন।